ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

কাশ্মীর কোন্ পথে

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২০ আগস্ট ২০১৯

 কাশ্মীর কোন্ পথে

॥ আট ॥ দিল্লীর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার অনীল কাচরুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দুই যুগ আগে বোম্বেতে (অধুনা মুম্বা)। পরিচয় শুধু নয়, রীতিমতো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। কাশ্মীরের সেই হতভাগ্য তিন লাখ উদ্বাস্তুর একজন অনীল। ওর উদ্বাস্তু জীবনের কথা তখন শুনেছিলাম। ১৯৯৯-এর কারগিল যুদ্ধের পর কাশ্মীর যাব এবং জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে লিখব শুনে ও খুবই উৎসাহিত হয়েছিল। জম্মুতে ওর বাবা-মা থাকেন। আমার সফরসূচী অনীলকে আগেই জানিয়েছিলাম। জম্মুতে আমার সঙ্গে ও হোটেলে দেখা করেছে। বললাম, তোমার শরণার্থী জীবনের কথা আমি ক্যামেরায় রেকর্ড করতে চাই। অনীল বলল, শাহরিয়ার, আমি ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলোর কথা ভুলে যেতে চাই। এখনও ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্ন দেখি। আমি ঘুমোতে পারি না। ক্যামেরার সুইচ অন করে বললাম, তুমি ভুলে যাও ক্যামেরার সামনে কথা বলছ। বোম্বেতে যেভাবে আমাকে বলেছিলে সেভাবে বল। ‘তখন আমার বয়স ছিল আঠারো।’ অনীল বলল, ‘আমার বাবা কলেজে অধ্যাপনা করতেন। বাবা, মা, আমি আর আমার চেয়ে আড়াই বছরের ছোট ভাই অরুণকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার ছিল। বাবা বেতন পেতেন ১৪ হাজারের মতো। এই টাকায় শ্রীনগরে তখন একটি পরিবার খুব ভালভাবে থাকতে পারত। আমি তখন ব্যাঙ্গালুরুতে থাকি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, ছুটিতে বাড়ি যাই। ‘সেই রাতটা সম্ভবত ’৮৯-এর ডিসেম্বরের হবে। আমরা খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে যাব, এমন সময় বাইরে শুনি কোলাহল। হঠাৎ সারা শহরের আলো চলে গেল। বাইরে হইহুল্লা বাড়তে লাগল। মসজিদের মাইক থেকে বলা হচ্ছিল সব মুসলমানকে বেরিয়ে আসার জন্য, হিন্দুস্তানী ফৌজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কয়েকদিন ধরে আমরা শুনছিলাম জঙ্গীরা শ্রীনগরে কোন হিন্দু রাখবে না। কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দুকে তারা এরই মধ্যে হত্যা করেছিল। এদের ভেতর হাইকোর্টের একজন বিচারপতিও ছিলেন। আমাদের জানাশোনা কিছু কিছু হিন্দু পরিবার গোপনে শ্রীনগর থেকে জম্মু চলে গিয়েছিল। তবু আমরা ভেবেছিলাম অবস্থা গুরুতর কিছু হবে না। কাশ্মীরে হিন্দুরা মেনেই নিয়েছিল তাদের মুসলমানদের কর্তৃত্বে থাকতে হবে। স্কুলে যখন পড়তাম মুসলমান ছেলেদের অনেকে পণ্ডিত বলে ক্ষেপাত।’ অনীলকে জিজ্ঞেস করলাম- স্কুলে তোমার কোন মুসলমান বন্ধু ছিল না? ‘আমার বেশিরভাগ বন্ধুই ছিল মুসলমান। তবে মুসলমান ছাত্ররা সাধারণভাবে ভারতবিদ্বেষী। স্কুলে ওরা সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সঙ্গীত গাইত না। আমাদের শিক্ষকরা অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু। তাঁরা এ নিয়ে মুসলমান ছাত্রদের কিছু বলার সাহস পেতেন না। স্কুলে আমাকে এ ধরনের কথা প্রায়ই শুনতে হয়েছে- তোরা তোদের ইন্ডিয়ায় চলে যা। কাশ্মীর আমাদের।’ সাম্প্রদায়িকতার এ চেহারা আমাদের অচেনা নয়। ওকে বাধা দিয়ে বললাম- ঠিক আছে অনীল, সেই রাতের কথা বল। ‘আমরা সেই কোলাহল আর চিৎকারে ভীষণ ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কোথায় যাব এই অন্ধকারে? আমাদের এক মুসলমান প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় চাইলাম। তারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল বটে, তবে সে বাড়ির পুরুষদের দেখেছি উত্তেজিত হয়ে বেরিয়ে যেতে। ‘সকালে আমাদের বাড়ি ফিরে এলাম। সারা শহর থমথমে। হিন্দুরা সবাই আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাবা আমাকে জোর করে ব্যাঙ্গালুরুতে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, পরিস্থিতি খারাপ হলে তারা জম্মু চলে যাবেন। ‘ব্যাঙ্গালুরুতে ফিরে একটা দিনও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারিনি। খবরের কাগজে দেখতাম হিন্দুদের ওপর কী ধরনের অত্যাচার হচ্ছে। বাবার কলেজ তখন বন্ধ, হাতে টাকা পয়সা ছিল না। অপেক্ষা করছিলেন কলেজ খোলার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে এক মুসলমান প্রতিবেশীর হাতে বাড়ির চাবি দিয়ে রাতের অন্ধকারে আমার বাবা-মা আর ছোট ভাই শ্রীনগর ছেড়ে চলে এসেছে। মিলিট্যান্টদের চোখে পড়ার ভয়ে সঙ্গে কিছুই আনতে পারেনি। ‘বাবা প্রথমে আমার এক চাচার বাসায় উঠেছিলেন। পরে রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেন। আমাকে ক্যাম্পে যাওয়ার কথা জানাননি। তাঁরা জম্মুতে এসেছেন শুনে আমি দেখতে এলাম। চাচার বাড়িতে গিয়ে শুনি তারা ক্যাম্পে আছেন। খুঁজে বের করলাম তাদের। বিশ্বাস কর শাহরিয়ার, আমার বাবা-মা আর ভাইকে ক্যাম্পের সেই শ্বাসরুদ্ধকর অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় দেখে মনে হয়েছিল আমি পাগল হয়ে যাব। এখন দুটো পরিবারের জন্য বরাদ্দ ছিল একটা তাঁবু। দুটো তক্তপোষ পাশাপাশি, দুটো পরিবারের জন্য। টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। খাবার পানির ব্যবস্থা নেই, যৎসামান্য যে টাকা সরকার দিত তাতে কিছুই হতো না। ‘বাবা আমাকে এই দুর্দশার কথা জানাননি আমার পড়াশোনার ব্যাঘাত হবে বলে। আমার ছোট ভাইটা তখন স্কুলে পড়ত। এখানে কোন স্কুল নেই। অরুণ দু’বছর স্কুলে যেতে পারেনি। এখানকার স্কুল বলেছে ও কাশ্মীর বোর্ডের আন্ডারে ছিল। জম্মু বোর্ডের অধীনে কোন স্কুলে পড়তে পারবে না। ওর শিক্ষা জীবন থেকে মূল্যবান দুটি বছর নষ্ট হয়ে গেছে।’ ওকে বললাম, ‘কাশ্মীরে ভাল মুসলমান আমি অনেক দেখেছি, যারা জঙ্গীদের এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পছন্দ করে না।’ ওকে পুরখু ক্যাম্পের মাংস বিক্রেতা বশীরের কথা বলেছি, যে কাশ্মীর থেকে উৎখাত হওয়া ৫০ হাজার মুসলমানের একজন, যারা জঙ্গীদের কোন রকম সহযোগিতা প্রদান করতে অস্বীকার করছিল। বশীর বলেছে, গ্রামের সাধারণ মুসলমানদের জঙ্গীরা ভয় দেখিয়েছে- কেউ ওদের সহযোগিতা না করলে সে কাফের হয়ে যাবে। গ্রামে এ রকম অনেকে ‘কাফের’ ছিল যারা জঙ্গী সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করেছে। যার ফলে তাদের ভাগ্যে জুটেছে হিন্দু পণ্ডিতদের মতো যাতনাময় উদ্বাস্তু জীবন। ফারুখ আবদুল্লাহর সরকার উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল কাশ্মীরে। ওদের জন্য কিছু প্যাকেজও ঘোষণা করা হয়েছিল। জম্মুর শরণার্থীরা এ বিষয়ে আগ্রহী নন। প্রত্যেকে বলেছেন, যেখানে ফারুখ আবদুল্লাহর নিজের জীবনের নিরাপত্তা নেই, সশস্ত্র পাহারা ছাড়া যিনি এক পা চলতে পারেন না, সেখানে আমাদের নিরাপত্তা কে দেবে? ঘরবাড়ি, জমিজমা সবই আমাদের আছে। আমরা চাই নিরাপত্তা। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলেই আমরা ঘরে ফিরে যাব। অনীল আমাকে বলছিল, ‘একটা বিরাট জনগোষ্ঠী কিভাবে চিরকালের মতো শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্য করে দেখেছ? আমি নিজেই এখন কাশ্মীরী ভাষা বলি না। কাশ্মীরী বহু উদ্বাস্তু দিল্লীতে, ইউপিতে, হরিয়ানায়, পাঞ্জাব আর মধ্যপ্রদেশে আছে, যাদের বংশধররা কখনও জানবে না কী গর্বিত এক জাতির উত্তরাধিকারী তারা।’ সেবার দেশে ফেরার পর অনীলের একটি মর্মস্পর্শী চিঠি পেয়েছিলাম, যা আমার বইয়ে আছে। অনীল লিখেছিল- ‘প্রিয় শাহরিয়ার, বহুদিন পর বাড়ি ফিরে পরিবারের সান্নিধ্য পেয়ে নিশ্চয়ই তোমার খুব ভাল লাগছে। সেদিন তোমার সঙ্গে আমার আলোচনা চিরদিন মনে থাকবে। তোমাকে আমি কিছু কথা বলেছি, যা বহুদিন আমার বুকের ভেতর চাপা ছিল। তোমাকে বলতে পেরে কিছুটা হালকা লাগছে। শুধু আমার নয়, কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত পণ্ডিতদের সবার বুকের ভেতর আগুন চাপা পড়ে আছে। যখন থেকে তারা জম্মুতে এসে আশ্রয় নিয়েছে তখন থেকে এ আগুন জ্বলছে। ‘দীর্ঘ দশ বছর কেটে গেছে। উপত্যকার উদ্বাস্তু কারও কারও জীবন মিশে গেছে সমতলের মানুষের জীবনের সঙ্গে। হয়ত ভুলে গেছে কী ঘটেছিল অতীতে। আমাদের অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, অনেকে মিশে যেতে চাইছে ভারতের মূলধারার সঙ্গে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক কাশ্মীরী যাদের তুমি জম্মুর শরণার্থী শিবিরে দেখেছো- ফিরে যেতে চাইছে নিজেদের বাসভূমিতে, যেখানে তারা ছিল হাজার বছর ধরে। ‘হয়ত এমন এক সময় আসবে যখন আমরা ভুলে যাব অতীত, ভুলে যাব কাশ্মীর, আমাদের শৈশব এবং অন্যসব ভারতীয়র মতো জীবনযাপন করব। এটা যখনই ভাবি তখনই আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়। তাহলে কি আমাদের শেকড় বলে কিছু থাকবে না? আমাদের সংস্কৃতি বলে কিছু থাকবে না? কোন পরিচয় থাকবে না আমাদের সন্তানদের বলার জন্য? আমি কী করে ভুলি ডাল লেকের সেই দিনগুলো, পাহাড়ের ভেতর সুন্দর রোমাঞ্চকর সব গুহা, চারপাশে বরফে ঢাকা সুউচ্চ পর্বতমালা, পাহাড়ী ঝর্ণা ও নদী, চিনার গাছের সারি, মন্দির- যা একান্তভাবে আমার এবং সবকিছু এত প্রিয়! তোমাকে এসব কথা লিখতে গিয়ে আমি কাঁদছি। এভাবেই গোপনে কাঁদতে হবে বাকি জীবন, যখন মনে হবে আমার যা কিছু আপন ছিল কিছুই নেই। ‘আমরা যদি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে না পারি আমাদের দায়ী হতে হবে কাশ্মীরী পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত একটি গোটা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। আমরা বছরের পর বছর শরণার্থী শিবিরে থেকে অনন্তকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারি না- কবে ভারত সরকার আমাদের থাকার জন্য পৃথক একটি রাজ্য বা ভূখণ্ড দেবে! অথচ এছাড়া আমাদের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা কীভাবে অব্যাহত থাকবে তাও জানি না। ‘আমি জানি না আগামী পঞ্চাশ বছরে আমরা কোথায় থাকব। আমাদের কেউ তা জানে না। হতে পারে কাশ্মীরী কাবাবের স্বাদ বোঝাবার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গেছি দিল্লীর তাজমহল হোটেলে। শুধু তাদের এটা বোঝাবার জন্য যে, তারা কাশ্মীরী। কখনও ভাবি এমন দিন দেখার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। পরবর্তী প্রজন্মকে কে শোনাবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের অর্জন ও সাফল্যের কথা?...’ জম্মুতে বিদায় নেয়ার সময় অনীল বলেছিল, আমার সঙ্গে পরিচয় না হলে মুসলমানদের সম্পর্কে চিরকাল ওর একটা ভুল ধারণা থেকে যেত। অনীলকে আমি বলিনি, সেবার একুশ দিন জম্মু-কাশ্মীর আর দিল্লীতে কাটিয়ে, শরণার্থী পণ্ডিতদের দুঃসহ যাতনার কথা শুনে, ইসলামের নামে মানবতার চরম লাঞ্ছনার কথা জেনে আমার নামের সঙ্গে যে মুসলমান পরিচয় রয়েছে, তার জন্য লজ্জায় মাথা নত হয়ে গিয়েছিল। (ক্রমশ.)
×