ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর জন্য বুক পেতে দিয়েছিলেন যিনি

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২০ আগস্ট ২০১৯

বঙ্গবন্ধুর জন্য বুক পেতে দিয়েছিলেন যিনি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সামরিক সচিব কর্র্নেল জামিল উদ্দীনকে শেষবারের মতো কল দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কর্নেল জামিলকে বলেছিলেন, তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে, ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে। পরে লাইন কেটে যায়। যে কালরাতে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, নগরীকে ঘিরে ধরেছিল অনিশ্চয়তা এবং দেশের নেতৃত্ব অচল হয়ে পড়েছিল, তখন কর্নেল জামিল তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি। তিনি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ্সহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কল করেন এবং তাদের সেনা পাঠাতে বলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টকে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার নির্দেশ দেন এবং তৎক্ষণাৎ ৩২নং রোডের বাড়ির দিকে ছুটে যান। শান্তভাবে নিজের পিস্তল খাপে রেখে স্ত্রী-সন্তানদের বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বিপদ। কীভাবে আমি না গিয়ে পারি?’ জীপে চড়ার আগে স্ত্রীর প্রতি তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘আমার কন্যাদের খেয়াল রেখ।’ অন্ধকার ভেদ করে গাড়ি চলল ৩২নং রোডের বাড়ির দিকে। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছলে পিজিআর কনভয় কর্নেল জামিলকে থামান। তিনি কারণ জানতে চান। তাঁকে বলা হয় সামনে সেনা ইউনিট রয়েছে এবং গোলাগুলি চলছে। তিনি সেনাদের সামনে যাওয়ার জন্য বোঝাতে চেষ্টা করলেন। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি জীপে চেপে বসলেন এবং নিজে গাড়ি চালিয়ে ৩২নং রোডে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। গুলি করা হলো বীর সেনানী কর্নেল জামিলকে। গাড়ির ভেতর লুটিয়ে পড়লেন তিনি। শাহাদাত বরণ করলেন কর্নেল জামিল, যিনি অন্যদের মতো বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার শপথ নিয়েছিলেন। নীতি এবং কর্তব্যের প্রতি অবিচল আনুগত্য কর্নেল জামিলকে দান করেছে শহীদের মর্যাদা। যে রাতে অনেক সাহসী মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছেন। কর্নেল জামিল এক চুলও টলেননি তাঁর কর্তব্যবোধ থেকে। সাহসিকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন কর্নেল জামিল। জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন কর্তব্যবোধকে। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দুপুর প্রায় দুটো পর্যন্ত কর্নেল জামিলের পরিবার জানত কী ঘটেছিল তাঁর ভাগ্যে। ফোন করলেন জেনারেল শফিউল্লাহ্, যাকে ভোরে কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে সেনা পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। ফোন ধরলেন মিসেস জামিল। স্বামীর মৃত্যু সংবাদ মিসেস জামিলকে দিতে গলা ধরে আসছিল জেনারেল শফিউল্লাহ্র। চলে গেলেন বাংলাদেশের একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। কর্নেল জামিল অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কর্নেল জামিল জিম্মি অবস্থায় ছিলেন পাকিস্তানে। একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর আন্তরিকতা এবং পেশাদারিত্বে মুগ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে তাঁর সামরিক সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। কর্নেল জামিল এবং কেএম শফিউল্লাহ্ এক সঙ্গে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন। অনেক বছর পর বন্ধুর ম্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেএম শফিউল্লাহ বলেন, ‘সেই দিনগুলোতে জামিল ভাই, আমি এবং কিছু বাঙালী অফিসার পাকিস্তানে ছিলাম এবং আমাদের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। সে সময় বাঙালী জাতীয়তাবাদ ছিল উদীয়মান অবস্থায়। পাকিস্তানের অধিকাংশ জনসংখ্যা বাংলাদেশের হওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখেছি সেনাবাহিনীত আমাদের প্রতিনিধিত্ব কত কম ছিল। যখনই আমাদের সাক্ষাত হতো আমরা এ বিষয়ে কথা বলতাম। আমাদের মধ্যে জামিল ভাইয়ের জাতীয়তাবোধ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী এবং মাঝে মাঝে তিনি ক্রোধে বেপরোয়া হয়ে যেতেন।’ ২০১০ সালে কর্নেল জামিলকে মরণোত্তর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল র‌্যাঙ্ক দেয়া হয় এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই সকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচানোর জন্য যে অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণে অনেক দেরিতে এই সম্মান দেয়া হয় কর্নেল জামিলকে। কারণ, এদেশে স্বজনপ্রীতির লেন্সের মাধ্যমে দেখা হয় দেশপ্রেম, ত্যাগ এবং সাহসিকতাকে। আমাদের জাতির জন্য কর্র্নেল জামিলের আত্মগ্যাগ এক বিরল উদাহরণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ মহান বীরের আত্মত্যাগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কর্র্নেল জামিলের জ্যেষ্ঠ কন্যা তাহমিমা এনায়েত বলেন, ‘জামিলের আত্মা শান্তিতে থাকবে এবং আমিও মরে যাব। আমার বাবা ছিলেন একজন সৎ কর্মকর্তা। আমি গর্বিত, আমার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।’ জামিলের অমর আত্মদান বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁকে আমাদের মাঝে। দেশের ডাকে তিনি সাড়া দিয়েছেন এবং কর্তব্য পালনের জন্য হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। জাতি যখন দাঁড়িয়েছিল অনিশ্চয়তার বাঁকে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল দেখিয়েছেন অনুপম দেশপ্রেম ও নৈতিক সাহসিকতা, যা তাঁকে করেছে মহান এবং সত্যিকারের মহানায়ক। লেখক : সম্পাদক, ঢাকা কুরিয়ার, এডিটর ইন চিফ, ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি)
×