ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজপথে আন্দোলনে সায় নেই অধিকাংশ বিএনপি নেতার

প্রকাশিত: ১০:২৩, ১৯ আগস্ট ২০১৯

 রাজপথে আন্দোলনে সায় নেই অধিকাংশ  বিএনপি নেতার

শরীফুল ইসলাম ॥ কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সনের মুক্তির জন্য রাজপথে আন্দোলনে নামতে সায় নেই দলের অধিকাংশ নেতার। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সিনিয়র নেতাদের ওপর চটেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনের পক্ষের সিনিয়র নেতারা আন্দোলনে ব্যর্থতার দায় নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার কৌশল নিয়েছেন। সূত্র মতে, সম্প্রতি লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের মহাসচিবসহ কয়েক সিনিয়র নেতার কাছে ক্ষুব্ধকণ্ঠে জানতে চান- কেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাজপথের আন্দোলন শুরু করা যাচ্ছে না? তখন তারা তারেক রহমানকে জানান, দলের বিশাল নির্বাহী কমিটির অধিকাংশ নেতাই রাজপথের আন্দোলনে সায় দিচ্ছে না। এমনকি দলের স্বাভাবিক কর্মসূচীতেও তারা আসতে চায় না। আর নেতারা যদি আন্দোলনে সায় না দেয় তাহলে কর্মীদের কিভাবে মাঠে নামানো যাবে। তারপরও তারেক রহমান যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাজপথে আন্দোলন শুরু করার তাগিদ দেন। আন্দোলনের বিষয়ে তারেক রহমানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পরও দলের বিভিন্ন স্তরের নেতার সঙ্গে রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচী শুরুর বিষয়ে যখন আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেল না তখন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কোন কোন নেতা কৌশলে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন। ১৬ আগস্ট বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আক্ষেপ করে বলেন, খালেদা জিয়াকে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করতে না পারা আমাদের দুর্ভাগ্য। কারণ, আমরা তার মুক্তির জন্য এখন পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি। এ বক্তব্যের মাধ্যমে বিএনপি মহাসচিব পরোক্ষভাবে বলতে চেয়েছেন, দলের নেতারা আন্দোলনে সায় দিচ্ছে না বলেই রাজপথে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করতে পারছে না বিএনপি। আর রাজপথে আন্দোলন না থাকায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের মুক্তিও হচ্ছে না। ওই অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল দলের সাধারণ নেতাকর্মীর উদ্দেশে বলেন, আইনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। তাই আমাদের সুসংগঠিত হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে দলের সবাইকে রাজপথে আন্দোলনে নামার শপথ নিতে হবে। এর আগে ৯ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলের নেতাকর্মীর উদ্দেশে বলেন, কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে বিএনপি ব্যর্থ। তার মুক্তির জন্য মানববন্ধনসহ বিএনপি যেসব কর্মসূচী পালন করেছে তা সামাজিক কর্মসূচী। এমন কর্মসূচী দিয়ে তাকে মুক্ত করা যাবে না। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী কিন্তু আমরা নির্বাক তাকিয়ে আছি। তিনি জেলে যাওয়ার পর আমরা তাঁর মুক্তির জন্য কার্যকর আন্দোলন করতে পারিনি। তাই তাকে আমরা মুক্ত করতে পারিনি। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে কাজ হবে না। রাজপথের জোরালো আন্দোলন ছাড়া তাকে মুক্ত করা যাবে না। তবে আমরা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে চাই কিনা সে সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে। দল থেকে আন্দোলনের ডাক না দিলেও নিজেদের অবস্থান থেকেই আন্দোলন শুরু করে দিতে হবে। মির্জা ফখরুলের মতো গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যেও দলের নেতাদের যে এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাজপথের আন্দোলনে অংশ নেয়ার আগ্রহ নেই তা প্রকাশ পেয়েছে। দলের নেতাদের মধ্যে অনেকেরই আন্দোলনে সায় না থাকায় খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য দল থেকে আন্দোলন কর্মসূচী নাও হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই গয়েশ্বর রায় সাধারণ নেতাকর্মীর উদ্দেশে বলেছেন, নিজেদের অবস্থান থেকেই আন্দোলন শুরু করতে হবে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ মামলায় সাজা পেয়ে কারাগারে যাওয়ার দিনে রাজধানীর রাজপথে জোরালো বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিএনপি। তবে ওইদিন দলের কিছু নেতা গ্রেফতার হওয়ায় এর পর থেকে তার মুক্তির জন্য মানববন্ধন ও প্রতীকী অনশনসহ কিছু কর্মসূচী পালন করলেও রাজপথে জোরালো কোন কর্মসূচী পালন করেনি দলটি। এ বিষয়ে সাধারণ নেতাকর্মী কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তাদের জানানো হয় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে তিনি নিজেই কঠোর আন্দোলন চাচ্ছেন না। সূত্র মতে, আদালতের রায়ে খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ায় তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী দিলে এ কর্মসূচী প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে এমন একটি ভাবনা থেকে খালেদা জিয়া নিজে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করতে বলেন। কারাবন্দী হওয়ার পর বিভিন্ন সময় তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া আত্মীয়স্বজন, দলের নেতা ও আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাতকালে তিনি তার এমন অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। আর এ কারণেই খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তৃণমূল নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে কঠোর আন্দোলনের চাপ থাকলেও বিএনপি আইনী লড়াইয়ের পাশাপাশি দায়সাড়া আন্দোলন কর্মসূচী পালন করেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাজপথের আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু দলের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা এ আন্দোলনে সায় দেয়নি। তাই নির্বাচনের আগে আর তারা রাজপথের আন্দোলনে নামতে পারেনি। নির্বাচনের পর আবারও আন্দোলন শুরু করতে চাইলে নেতাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই কোন কোন নেতা কথায় কথায় আন্দোলনের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত আর তা হয়নি। এক পর্যায়ে বিএনপির সিনিয়র নেতারা তারেক রহমানকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে হঠাৎ আন্দোলন না করে আস্তে আস্তে প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে হবে। কিন্তু জুলাই মাসের শেষের দিকে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগীয় সদরে ৩টি সমাবেশ করেও নেতাকর্মীদের আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই সম্প্রতি আবারও দলের সিনিয়র নেতাদের রাজপথে আন্দোলন শুরু করার তাগিদ দেন তারেক রহমান। ২০১৫ সালে টানা ৯২দিনের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় দেশ-বিদেশে বিএনপির এ আন্দোলন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিশেষ করে বিদেশে দলটির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। আর এ সহিংস আন্দোলনের কারণেই কানাডার আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যায়িত করে। এ পরিস্থিতিতে আবারও কঠোর কোন কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়তে চায় না দলের অধিকাংশ নেতা। আর এ কারণেই তারা আন্দোলনেও সায় দিচ্ছে না। তবে আন্দোলন না হওয়ায় দলের সিনিয়র নেতারা তারেক রহমানের রোষানলে পড়ছেন। উল্লেখ্য, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপি এ পর্যন্ত যেসব স্বাভাবিক কর্মসূচী পালন করেছে তা সফল করতে দলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। অধিকাংশ কর্মসূচীতেই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি ছিল কম। তবে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এসব কর্মসূচী পালনের চেষ্টা করেছে। অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে- পুলিশী বাধার কারণে তারা কোন কর্মসূচীই ভালভাবে পালন করতে পারছে না। কর্মসূচী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ নেতাকর্মীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি শুরু করে। আর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় কর্মসূচী পালনের নামে রাজপথে যেন কেউ শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে না পারে সেজন্যই তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাজপথে আন্দোলন শুরু করতে সম্প্রতি তারেক রহমান নির্দেশ দিয়েছেন। সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ আন্দোলনে নামার জন্য প্রস্তুত। আবার কোন কোন সিনিয়র নেতা আন্দোলনে নামার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ কারণে এখনও রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচী শুরু হয়নি। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি যে আন্দোলন জোরদার করতে পারেনি এটা তো সত্যি। তাই কোন কোন নেতা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য দল কিছু করতে পারেনি বলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বলছেন।
×