ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আক্কেলপুরে বছরে একবার বসে ঘোড়ার হাট

অশ্বশক্তিতে গড়ে উঠেছে নতুন পৃথিবী, কদর হারিয়ে যায়নি

প্রকাশিত: ১০:২৩, ১৯ আগস্ট ২০১৯

 অশ্বশক্তিতে গড়ে উঠেছে নতুন পৃথিবী, কদর হারিয়ে যায়নি

সমুদ্র হক ॥ ঘোড়া। যার আরেক নাম ঘোটক। দ্রুতগামী চতুষ্পদ জন্তু। পিঠে চড়ে দুলকি চালে ছোটা যায়। পথ যত এবড়োথেবড়োই হোক ঘোড়া টগবগিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটবেই। তাই এদের বলা হয় তুরগ ও তুরঙ্গম। প্রায় ৫ কোটি বছর আগে ইউসিন যুগে পৃথিবীতে ঘোড়ার আবির্ভাব। সেই থেকে ঘোড়া রাজ্যজয়ের যুদ্ধসহ রাজাদের সৈন্যের শক্তির অন্যতম উৎস। ঘোড়ার শক্তিকে ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা ইঞ্জিনের শক্তির একক নির্ণয় করে হর্স পাওয়ার (অশ্বশক্তি)। যে ধারায় গড়ে ওঠে নতুন পৃথিবী। একুশ শতকের নতুন বিশ্বে ঘোড়া এখনও রাজশক্তির প্রতীকে পরিচিত। আজও ব্রিটেনের রানীর মর্যাদার ঐতিহ্যবাহী বাহন ঘোড়াগাড়ি। নতুন পৃথিবীতে ঘোড়ার কদর কতটা! প্রশ্ন যতই থাক- ঘোড়ার হাটের সন্ধান মিলেছে, যেখানে বেচাকেনা চলে। আয়োজকদের দাবি দেশের একমাত্র ঘোড়ার হাট। জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুরে প্রতি বছর বসে ঘোড়ার হাট। দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে গোপীনাথপুর মন্দির থেকে অল্প দূরে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এ বছরও বসেছিল ঘোড়ার হাট। জনশ্রুতি আছে এমন হাট পাঁচ শ’ বছরের পুরনো। আগে বসত গরু মোষের হাট। গত ৪০ বছর ধরে ওখানে ঘোড়া বিক্রি হচ্ছে। এই ঘোড়ার হাটের পরিচিতি পেয়েছে দেশজুড়ে। দূরদূরান্ত থেকে হাটে আসে নানাজাতের নানা বর্ণের ঘোড়া। দর্শনার্থী ও ক্রেতা বিক্রেতারা আসেন। ঘোড়ার সঙ্গে মানুষে মানুষে মিলনমেলা। প্রায় তিন কিমি এলাকাজুড়ে বসে ব্যতিক্রমী এই ঘোড়ার হাট। হাটে ওঠা ঘোড়ার নামগুলোও বাহারি। জরিনা বিজলী সুইটি কিরণবালা মণিবালা। ক্ষিপ্রতা ও দ্রুতগতি বলে দেয় এদের তেজ। হাটের পাশেই বিরাট পাথার, যেখানে ঘোড়ার দৌড় ও ক্ষিপ্রতা পরখ করেন ক্রেতা। এরপর দরদাম। কুষ্টিয়ার ঘোড়া ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম প্রায় ২০ বছর ধরে এই হাটে আসছেন। বললেন প্রথম দিকে ঘোড়ার আমদানি কম ছিল। এখন বেড়েছে। চারটি ঘোড়া এনেছিলেন। আট ফুট উচ্চতার একটি তাজি ঘোড়া এক লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। নওগাঁর ধামইরহাটের আব্দুস সবুর এনেছিলেন ছয়। মাঝারি গড়নের ঘোড়াগুলো বিক্রি করেছেন ৪০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। টাঙ্গাইলের সোলায়মান বললেন, টাট্টু ঘোড়া খুব কমই মেলে। চরের বালিতে এই ঘোড়া স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে। হাটে টাট্টু জাতের অন্তত ৪শ’ ঘোড়াসহ নানা জাতের প্রায় তিন হাজার ঘোড়া উঠেছিল। কুষ্টিয়ার শৌখিন ঘোড় সওয়ার ফরিদ আলী বললেন, কেউ ঘোড়ায় চরা শিখতে চাইলে আনন্দের সঙ্গে শিখিয়ে দেন। ঘোড়ার মুখে লাগাম গলায় ঘুঙুর আটকানো থাকে। ঘোড়ার পিঠের আসনকে বলা হয় জিন। একহাতে চাবুক আর অন্য হাতে লাগাম টেনে ঘোড়াকে ছুটিয়ে নিয়ে যান তিনি। ময়মনসিংহের আব্দুস সালাম যশোরের এক ব্যক্তির কাছ থেকে সাড়ে নয় ফুট উচ্চতার ক্ষিপ্রগতির তেজি ঘোড়া কিনেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। বললেন ঘোড়া পোষা খুব কষ্টসাধ্য। ঘোড়ার খাবার ছোলা বুট ডিম ও ঘাস। উইকপিডিয়া থেকে জানা যায়, ঘোড়ার উপজাত ক্যাবালাসকে পোষ মানানো যায়। এদের কিছু পোষ্য দলে বিভক্ত হয়ে বুনো ঘোড়ার মতো আচরণ করে। ঘোড়ার পূর্বপুরুষ ইউহিপ্পাসের জীবাশ্ম উত্তরপশ্চিম আমেরিকায় পাওয়া গেছে। বনজ অবস্থায় আকার ছোট ও আঙ্গুলযুক্ত পা ছিল। পরে তৃণভূমি সৃষ্টি হলে বড় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ঘোড়ার পায়ের তৃতুল আঙ্গুলটি ক্ষুর হিসেবে দ্রুত দৌড়াতে সহায়তা করে। ষাটের দশকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঘোড়দৌড় ছিল আকর্ষণীয়। এরপর ঘোড়া হারিয়ে যাওয়ার পথে পা ফেলে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের ঘোড়ার গাড়ি বিলুপ্তির পথে। দুই ধরনের ঘোড়া গাড়ি ছিল। দুই ও চার ঘোড়ায় চালিত এক্কাগাড়ি। অনেকটা ট্রামগাড়ির মতো বড়। আরেকটি টাঙ্গা বা টমটম। এটা এক ঘোড়ায় চালিত। এক্কাগাড়ি ব্যবহার করতেন জমিদাররা। এখনও পুরান ঢাকার কোন বড় অনুষ্ঠানে ও রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সম্মানে এক্কাগাড়ি পথে নামে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘোড়ারগাড়ি বা টমটম টিকে আছে, একে সাজিয়ে বিয়েবাড়ির হলুদের অনুষ্ঠান, শহর ও নগরে বর্ণাঢ্য র‌্যালিতে দেখা যায় টমটম। ব্রহ্মপুত্র যমুনা পদ্মা মেঘনার চরে মালপত্র বহনের বড় মাধ্যম ঘোড়াগাড়ি, যা টাট্টু ঘোড়ায় চালিত। ঘোড়ার শক্তি এখনও বিলীন হয়ে যায়নি। কোরবানি ঈদের সময়টায় যেমন দেশজুড়ে গরু ছাগলের হাট বসে তেমনই বছরের কোন সময়ে বসে ঘোড়া বেচাকেনার হাট। পৃথিবীর বিবর্তনের পালায় ইক্যুস ফেরাস ক্যাবলাস উপজাতির ইক্যুয়েড ঘোড়া পরিবারের অদ্ভুত দর্শন বক্রপদ ক্ষুরওয়ালা স্তন্যপায়ী প্রাণীতে রূপ নেয়। এরাই আজকের ঘোড়া বা ঘোটক। ঘোড়ার মেজাজ তিন ভাগে বিভক্ত। সহনশীল ঘোড়া সজীব। উষ্ণ বক্র ড্রাফট ঘোড়া। ঠা-া বক্র টাট্টু ঘোড়া। খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে ঘোড়াকে পোষ মানিয়ে মানুষ পোষা শুরু করে। প্রাচীনকাল থেকে বহু যুগ পার হয়ে ঘোড়া আজও শক্তির উৎস। এই শক্তির হাটও বসে। যেমন বসে আক্কেলপুরের গোপীনাথপুর মেলায়।
×