ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নদীতীরে মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি-ঢেউয়ের নাচনে মুগ্ধ মন

প্রকাশিত: ১১:৪৩, ১৮ আগস্ট ২০১৯

নদীতীরে মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি-ঢেউয়ের নাচনে মুগ্ধ মন

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে ॥ বর্ষা পেরিয়ে অবশেষে ভাদ্রে এসে যৌবনে ফিরেছে। রাজশাহীর পদ্মায় কতদিন আগে হাওয়ায় ঢেউয়ের নাচন ছিল তা প্রায় ভুলতেই বসেছিল নদীপারের মানুষ। তবে এবার স্বরূপে ফিরে এসেছে এ নদী। এখন আবারও সেই যৌবনা পদ্মা। শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্রে ফুলে-ফেপে উঠেছে এককালের যৌবনা প্রমত্তা পদ্মা। শরতের শুভ্র মেঘ আর সূর্য্যরে লুকোচুরিতে ¯্রােতস্বিনী পদ্মা এবার দেখা দিয়েছে নিজস্ব রূপে। দীর্ঘদিন পর পদ্মার বুকে এখন পালতোলা আর ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলচলে মুগ্ধকরা দৃশ্য। যেন প্রাণ পেয়েছে দীর্ঘদিন ঝিমিয়ে পড়া পদ্মাপারের জেলে আর মাঝিরা। স্রোত আর ঢেউ যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের সুর, পদ্মার ঢেউ রে ...। কবির সেই গানে কণ্ঠ মিলিয়ে এখন পুলকিত পদ্মা পারের মানুষ। পদ্মা নদী দীর্ঘদিন পর আসল চেহারায় ফিরে আসায় একদিকে যেমন মানুষ পুলকিত নিগাঢ় নিস্বর্গের রূপে। পানি বৃদ্ধির কারণে এ কূলে (শহর অংশে) ফিরে এসেছে চির যৌবনার উচ্ছ্বাস। এপারের মানুষের মধ্যে পদ্মার নিস্বর্গ রূপে নেচে উঠেছে মন। সকাল দুপুর সন্ধ্যায় পদ্মার রূপ দেখতে মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন নদীপারের বোলনপুর ঘাট থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে। টাইলসের কারুকাজ করা নদীপার ঘিরে এখন বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। পদ্মা পারের বাসিন্দারা জানান, এবার মাঝবর্ষা থেকেই পদ্মা অনেকটাই আসল চেহারায় ফিরেছে। নৌকা চলছে ¯্রােতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, মাঝিরা চরম ব্যস্ত যাত্রী পারাপার নিয়ে। জেলেরাও মাছ ধরে জীবিকার উৎস খুঁজে পেয়েছে। নদীর ¯্রােতের কলকলানি শব্দ মনেও দোলা দিয়েছে। শনিবার নগরীর পদ্মা পারে গিয়ে দেখা যায় সর্বত্র কোলাহল। পদ্মার যৌবনা রূপ দেখতে সব বয়সী মানুষের জটলা। কেউ কেউ নৌকা ভ্রমণে যাচ্ছেন পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ¯্রােতস্বিনী পদ্মার রূপ দেখতে। স্থানীয়রা জানান, বছর ঘুরে আবারও যৌবনা হয়ে উঠেছে মরা পদ্মা। চঞ্চলা আর দুরন্ত হয়ে ছুটে চলছে উথাল-পাথাল ঢেউ। দিনে নদীর টলমল পানির মাঝে ছোট ছোট ঢেউ। তার ওপর নেচে বেড়াচ্ছে সূর্যের আলো। রাতের জোছনায় থৈ থৈ নদীর চারপাশ- বহুদিন পর ফিরে এসেছে উত্তাল রূপে পদ্মা নদী। নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা উত্তরের শহর রাজশাহীর সব সৌন্দর্য যেন সেখানেই। বছরের অধিকাংশ সময়ই বুকে বালুচর নিয়ে জেগে থাকে পদ্মা। বছরে একবার হলেও বর্ষায় প্রাণ ফিরে পায় এক সময়ের যৌবনা এই নদী। এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর প্রথম দিকেও পদ্মা ছিল খালের মতো। বৃষ্টি না হওয়ায় আষাঢ়েও পানি ছিল না। তবে শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে পদ্মায় পানি আসতে শুরু করে। বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পদ্মা ফিরে পায় তার যৌবন। আর এতেই খুশি রাজশাহীর পদ্মাতীরের মানুষগুলো। নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ায় মাঝিদের ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে। এখন ভরা বর্ষায় পদ্মায় নৌকা ভাসছে। সকাল থেকে বিকেল বিনোদন প্রেমীরা ভিড় করছেন নদীর ঘাটে। দল বেঁধে ঘণ্টা চুক্তিতে নৌ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ছেন। এরই মধ্যে শরতের হাওয়ায় দুলছে পদ্মার ঢেউ। নগরীর বড়কুঠি ঘাটে বেড়াতে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী ইসমত আরা, গোলাম ফারুক, রাজশাহী কলেজের ছাত্রী সারমিন বলেন, কেবল এ সময়টাতেই পদ্মায় পানি থাকে। অন্য সময় চর। তবে চরে বেড়ানোর চেয়ে নৌকা ভ্রমণের আনন্দ বেশি। তাই নির্মল বাতাসে নদীর বুকে নৌকায় বেড়ানোর জন্য তারা মাঝে মাঝেই দল বেঁধে আসেন পদ্মায়। মাঝবয়সী এক মাঝি বলেন, নৌকার ভাড়া পেয়ে তার মতো মৌসুমি মাঝিরা এখন খুশি। সকাল আর বিকেল এই দুই সময়ে বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। কেউ ঘণ্টা চুক্তিতে আবার কেউ জনপ্রতি ভাড়া দিয়ে নৌ ভ্রমণ করেন। এখানে কোন ভাড়া নির্দিষ্ট নেই। যার কাছে যেমন পাওয়া যায়। তবে সাধারণত দেড় থেকে ২ শ’ টাকা ঘণ্টার চুক্তি পেলেই তারা খুশি। এর কম-বেশিও হয় বলেন তিনি। মহানগরীর পদ্মা তীরবর্তী ফুদকিপাড়া এলাকার আলাউদ্দিন জানান, কেবল বর্ষায় মৌসুমী জেলেরা পদ্মায় মাছ ধরেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুমের প্রথম দিকে পানি না থাকায় তারা হতাশ হন। এবার শ্রাবণের শুরুতে নদীতে পানি আসায় তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। রাজশাহীর সবকিছুই যেন এখন পদ্মা নদীকে ঘিরে। গ্রীষ্ম, শীত, বর্ষা কিংবা শরত সব ঋতুতেই সব সময় পদ্মা নদীকে ঘিরেই মানুষের আনাগোনা। গ্রীষ্মে শুকিয়ে কাঠ হওয়া পদ্মা আর বর্ষায় টইটম্বুর সব সময় মানুষকে কাছে টানে। নিয়ে যায় এর নৈসর্গিকতায়। কারণ পদ্মারপার ঘিরেই রাজশাহীবাসীর বিনোদনের সেরা ঠিকানা। সকাল নেই, দুপুর নেই, সব সময় পদ্মাকে ঘিরে নতুন প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত পদ্মারপার। পদ্মার ধার ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াকওয়ে। উন্নতমানের এ সড়ক দিয়ে সহজেই বিনোদন পিপাসুরা হেঁটে হেঁটে পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে পারেন। পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে ব্যবসা বাণিজ্যও জমে উঠেছে। সারাদিন মানুষের আনাগোনায় মুখরিত নদীপারে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক বাণিজ্যকেন্দ্র। বুলনপুর এলাকায় বট গাছের নিচে এখন সারাক্ষণ মানুষের জটলা। সেখান থেকে পেরিয়ে সামান্য এগুলেই চোখে পড়বে ‘টি-বাঁধ’। আরও একটু পরে ছোট পরিসরে পার্ক তৈরি করেছে বর্ডার গার্ড বিজিবি। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বহির্নোঙ্গর’ আর ‘সীমান্তনোঙ্গর’ অবকাশ। হাল্কা সব ধরনের খাবার আয়োজন রয়েছে এখানে। সেইসঙ্গে ছোট ছোট আম বাগানের ফাঁকে ফাঁকে বাসার সুরম্য স্থান। সেখানে বসে অনায়াসে নদীর সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। এখানে নদী ভ্রমণে আগ্রহীদের জন্য সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে ছোট আকারের নৌকা। রাতের আঁধারে রঙিন নিয়ন আলোয় আরও ফুটে উঠে এ স্পটের চেহারা। রাজশাহীতে হাতেগোনা কয়েকটি বিনোদন স্পট থাকায় মানুষের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরেই থাকে পদ্মারপার। ছোট-বড় সবার কাছে সমান পছন্দ এ পদ্মারপার। নদীর পারে এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন ভ্রমণ পিপাসুরা।
×