ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাজানো সংসার তছনছ ॥ চলন্তিকা বস্তিতে সর্বনাশা আগুন

প্রকাশিত: ১১:০৯, ১৮ আগস্ট ২০১৯

সাজানো সংসার তছনছ ॥ চলন্তিকা বস্তিতে সর্বনাশা আগুন

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর রূপনগর ঝিলপাড় বস্তিতে পোড়া ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। কেউ কেউ পুড়ে যাওয়া জিনিস হাতড়ে মূল্যবান জিনিসপত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন। সর্বনাশা আগুন তাদের সাজানো সংসার তছনছ করে দিয়েছে। সব হারিয়ে আজ ওরা নিঃস্ব। সর্বনাশা আগুন ঘরে থাকা নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, দামী আসবাবপত্র, টেলিভিশনসহ অনেকের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিয়েছে। শত শত বস্তিবাসীর পোড়া টিন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঈদের কারণে বস্তিতে থাকা বেশির ভাগ বাসিন্দা গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। আগুনের খবর পেয়ে অনেকে ফিরে এসেছেন তাদের আবাসস্থল ঝিলপাড় পোড়া বস্তিতে। মূল্যবান জিনিসপত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন। নি¤œবিত্ত এই মানুষগুলো সব হারিয়ে বাকরুদ্ধ। এদিকে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুনে বস্তিতে থাকা তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ কিংবা চাপা পড়ে রয়েছে কিনা তা তল্লাশি করে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের নিকটস্থ আরামবাগ মাঠে প্যান্ডেল টানিয়ে রান্নাবান্না ও খাবারের বন্দোবস্ত করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। শুক্রবার রাতে রূপনগর ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে সর্বস্ব হারা বাসিন্দাদের পথে বসে আহাজারি করছেন অনেকে। খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবার। আগুন লাগার খবর শুনে কাছাকাছি জেলার অনেকে আজ শনিবার ভোর থেকে ঝিলপাড় বস্তিতে এসেছেন। তারা এখন তাদের ঘর খোঁজার চেষ্টা করছেন। সেখানে পোড়া টিন পড়ে আছে। তার মধ্যেই সেখানে তারা নিজেদের অবশিষ্ট জিনিসপত্র খুঁজছেন। ভয়াবহ আগুনে সবকিছু শেষ। কিছুই খুঁজে পায়নি তারা। শনিবার ভোরে নরসিংদীর মনোহরদী থেকে এসেছেন সুমাইয়া (২৫)। তিনি জানান, তিনি বাড়িতে বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। স্বামী একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। বস্তির সাত নম্বর রোডের নয় নম্বর গলিতে তার ঘর ছিল। ঈদের ছুটিতে স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। আগুন লাগার খবর রাতে শুনেই স্বামীকে নিয়ে ভোরে এসে পৌঁছেছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুমাইয়া জানান, আগুনে তার সাজানো সংসার পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। কোথাও ঘর বলে কিছু নেই। পুড়ে সব সমান হয়ে গেছে। ঈদের আগে কাপড় চোপড়সহ যেসব জিনিস সঙ্গে নিয়ে গেছি। সেগুলো ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন কোথায় থাকব, তা জানি না। শুনেছি স্কুলে থাকতে দেয়া হবে। সুমাইয়ার মতো এ রকম শত শত নারী-পুরুষ-শিশু রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে কষ্টে দিন কাটচ্ছেন। তাদের সাজানো-গোছানো আশ্রয়স্থল হারিয়ে আজ বাকরুদ্ধ। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে চলবে এমন দুশ্চিন্তা ভর করেছে তাদের মনে। সব হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তির বাসিন্দাদের আহাজারিতে সেখানে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। বস্তির বাসিন্দা জাহাঙ্গীর জানান, যখন আগুন লাগে তিনি ও তার স্ত্রী ঘরে ছিলেন। চেষ্টা করেও আগুন নেভাতে পারেননি। পরনের কাপড় নিয়ে কোন রকমে বাইরে রাস্তা এসে প্রাণে রক্ষা পান। আর একটু হলে কেউ জানে রক্ষা পেতেন না। পরনের লুঙ্গি ও শার্ট ছাড়া কিছু নাই। আমার সব শেষ। তিনি জানান, আমার স্ত্রীসহ চার মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে পাঁচটি ঘরে এখানে থাকতাম। এখন কি খাব, কোথায় থাকব। তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছি। শনিবার দেখা গেছে, পোড়া বস্তিতে পাশে রাস্তায় সত্তোর্ধ রিজিয়া বেগম বিলাপ করছিলেন। তিনি কষ্ট ও বেদনা জানায়, বস্তিতে ২৫ বছর ধরে আছি। অনেক কষ্ট করে বস্তিতে ছোট দোকানটা করেছিলাম। এই দোকান করে আমার তিন ছেলে ও এক মেয়েকে মানুষ করেছি। এই দোকানই আমার সব ছিল। আগুনে আমার সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। কষ্টই এখন সম্বল। এখন থাকব কোথায় করব কি, কিছুই জানি না। শুক্রবার বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছি।’ পোশাক শ্রমিক তানিয়া জানান, আগুন লাগার সময় তিনি ঘরে ছিলেন না। আগুন লাগার পর ছুটে এসে দেখেন, তার বস্তি ঘর পুড়ে ছাই। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, চারজন মিলে বস্তির একটি ঘরে থাকতাম। আমরা সবাই সুস্থ আছি। বেঁচে থাকার সম্বল বলতে আর কিছু নেই। সব হারিয়ে আলমগীর অন্ধকার দেখছেন। বস্তির মাঝামাঝিতে ছয়টি ঘরে পরিবারের ১৩ সদস্য নিয়ে থাকতেন তিনি। পেশায় সুইপার আলমগীর কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমার ঘরের সব জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন আমি ক্যামনে চলমু। এ সময় তিনি ধ্বংসস্তূপ থেকে তার শখের লোহার খাটটি খুঁজছিলেন। এদিকে আগুনে ঘরবাড়ি সব হারিয়ে পথে বসে আহাজারি করছেন সোহাগ নামে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক। গ্রামের বাড়ি শেরপুর সদরে। এই বৃদ্ধ বিলাপ করছিলেন। তিনি জানান, নিজের বলতে তেমন কিছুই তার ছিল না। তারপরও যেটুকু ছিল, তার কিছুই ঘর থেকে বের করতে পারেননি। সঠিক সময়ে নিরাপদ স্থানে সরতে না পারায় আগুনে দগ্ধ হয়েছেন এক নারী। মর্জিনা বেগম নামে এক বৃদ্ধা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, মোবাইল ফোনসেটটি তার হাতে ছিল, শুধু সেটিই রক্ষা পেয়েছে। আর ঘরে থাকা সব কিছুই পুড়েছে। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর। সেখানে স্বজনদের কাছে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু এখন তার নিজের খাওয়ারই কোন সংস্থান রইল না। বস্তির বাসিন্দা শামীম হাসান জানান, আগুন তার বস্তিঘর পুড়ে গেছে। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। সকাল থেকে ঘর খোঁজার চেষ্টা করেছি। ঈদে বউ আর বাচ্চা জামালপুরে বাড়ি গেছে। আগুন লাগার কথা শুনে দৌড়ে বস্তিঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি। কিছু সঙ্গে আনতে পারিনি। এদিকে ঝিলপাড় বস্তির পাশেই রূপনগরের চলন্তিকা এলাকার দুই নম্বর রোডের বাসিন্দা দিলদার আহমেদ জানান, আগুন দেখে তারা ভয় পেয়েছিলেন। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। বস্তির পাশাপাশি মসজিদসহ আশপাশের চারটি বাড়িতে ওই আগুন ছড়াতে দেখেন তিনি। শনিবার পোড়া বস্তির পাশে একটি বাড়ি ও মসজিদ আগুনে বেশি পুড়ে গেছে। স্থানীয় অনেক লোক বলছেন, মিরপুর ৭ নম্বরের বস্তিটি অবৈধ। এখানে বেশির ভাগ বাড়ি টিন ও কাঠের। একেকটি বাড়ি টিন দিয়েই তিন-চারতলা করা হয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তরি করা এসব ঘরের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। বস্তির আশপাশের বাড়িগুলোতেও আগুন নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়। স্থানীয় বাসিন্দা খায়রুল বাশার জানান, বস্তির অদূরে তাদের বাসা। আগুন ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে দ্রুত বাড়ি থেকে সবাই বের হয়ে নিরাপদে চলে আসি। আগুন নেভানো সম্ভব হওয়ায় তারা রক্ষা পেয়েছেন। সংবাদ সম্মেলন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা যা বললেন ॥ শনিবার বেলা ১১টায় অগ্নিকাণ্ড স্থলে তথ্য কেন্দ্রে এক সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের সহকারী পরিচালক মোঃ রেজাউল করিম জানান, রাজধানীর মিরপুর সেকশন-৭ চলন্তিকার মোড়ে ঝিলপাড় বস্তির অগ্নিকাণ্ডে প্রায় সাড়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’ ঘর পুড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। আগুনের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ কিংবা চাপা পড়ে রয়েছে কিনা, তা তল্লাশি করে দেখা হচ্ছে। তিনি জানান, এখানে আমাদের তিনটি ইউনিট এ কাজ করছে। বস্তিতে লাগা ভয়াবহ আগুন সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে পুরোপুরি নির্বাপিত হয় রাত দেড়টার দিকে। সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম জানান, বস্তির অধিকাংশ ঘর টিনশেড কাঁচাঘর হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়। এখন পর্যন্ত আগুনে আহত চারজন। তারা হচ্ছেনÑ কবির (৩৫), হাবিব (১৯), রফিক ও শরিফ। তাদের স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে কেউই দগ্ধ কিংবা গুরুতর আহত হননি। এক প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম জানান, আগুনের উৎস আমরা এখনও বের করতে পারিনি। তবে আগুনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। অনুসন্ধান শেষে আগুনের উৎস নিশ্চিত করে বলা যাবে। তিনি জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রধান সমস্যা বস্তির এন্ট্রি পয়েন্ট একটি এবং সরু গলির কারণে বস্তি পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যায়নি। যার ফলে ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া পানির সঙ্কট ছিল। আমরা গাড়ির মাধ্যমে এবং আশপাশের গার্মেন্টস থেকে পানি নিয়ে কাজ করেছি। আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেটি আমরা রোধ করতে পেরেছি। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ॥ ঝিলপাড় বস্তির আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্যের একটি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে উপপরিচালক (এ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেনকে। বাকি দুই সদস্য হচ্ছেন, সহকারী পরিচালক (অপারেশন্স) আব্দুল হালিম এবং উপসহকারী পরিচালক (ঢাকা জোন-২) নিয়াজ আহমেদ। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি)। তদন্ত কমিটির সদস্য উপসহকারী পরিচালক (ঢাকা জোন-২) নিয়াজ আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিকে এদিন দুপুরে রূপনগর ঝিলপাড় বস্তির আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বশেষ অবস্থা পরিদর্শন যান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সিটি কর্পোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা চালিয়ে যাবেন। আগুনের পুড়ে যাওয়া ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব ফখরুল যা বললেন ॥ শনিবার দুপুর ১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, অতীতেও মিরপুরে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কোন ব্যক্তি জড়িত কিনা। তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এর আগে শুক্রবার রাতে ঝিলপাড় বস্তিতে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অরুণ কান্তি শিকদার। আগুনের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও জানান তিনি। শুক্রবার রাতে মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, মিরপুরের রূপনগরের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা, আহার ও বাসস্থানসহ সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে। মেয়র বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বস্তিবাসীর জন্য বাউনিয়া বাঁধে ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছেন। এখানকার ১০ হাজার বস্তি পরিবারকে পর্যায়ক্রমে সেখানে স্থানান্তর করা হবে। সে সময় স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্যা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। তারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সহায়তা আশ্বাস দেন।
×