ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীরা প্রযুক্তি ও সনাতন উভয় পদ্ধতিতেই তৎপর

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১৭ আগস্ট ২০১৯

জঙ্গীরা প্রযুক্তি ও সনাতন উভয় পদ্ধতিতেই তৎপর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রযুক্তির পাশাপাশি সনাতন পদ্ধতিতেও চলছে জঙ্গী তৎপরতা। সনাতন পদ্ধতিতে তৎপরতা চালানোর সঙ্গে জড়িত জঙ্গীরাই সংগঠিত হয়ে বড় নাশকতা চালানোর ষড়যন্ত্র করছে। এ জন্য একই এলাকায় স্বল্প দূরত্বের ব্যবধানে তারা একাধিক জঙ্গী আস্তানা গড়ে তুলছে। ঢাকার পল্লবীতে সম্প্রতি ছয় দিনের ব্যবধানে খুব কাছাকাছি দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলে। আস্তানা দুটি থেকে গ্রেফতার হওয়া ছয় জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ ছাড়া জঙ্গী সংগঠনগুলো দলের মধ্যে নানা উইং সৃষ্টি করছে। একেক উইং একেক পদ্ধতিতে কাজ করছে। কোন কোন উইং প্রযুক্তিগতভাবে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। উইংটি মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতেই এ কৌশল নিয়েছে। পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, গত ২৬ জুলাই রূপনগরের ২৮ নম্বর সড়কের ২৩ নম্বর বাড়ির তিন তলা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার আহাম্মদ আলী (৫৬), তার স্ত্রী সালমা বেগম (৪৮), মেয়ে ফেরদৌসি রিফা (২৭) দুই ছেলে হাফেজ আবু সালেহ মোহাম্মদ জাকারিয়া (২৪) ও হাফেজ কিবরিয়াকে (২১) গ্রেফতার করা হয়। আস্তানা থেকে উদ্ধার হয় জঙ্গীবাদের হাজার হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট, সিডি, বোমা তৈরির রাসায়নিক পদার্থ ও পুলিশের ওপর আক্রমণ করার কলাকৌশলসহ নানা আলামত। পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, পরিবারটি প্রায় ১২ বছর ধরে ওই বাড়িতে বাস করলেও আশপাশের পরিবারের সঙ্গে তাদের কোন প্রকার যোগাযোগ ছিল না। অভিযানকালে দুই ছেলে ও মেয়ে রামদা ও চাপাতি দিয়ে হামলা করলে পুলিশের তিন সদস্য আহত হয়। তারা বাসার ভেতরে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটালে আগুন ধরে যায়। পরে তারা বাড়ির সব ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে আগুন নেভায়। অভিযানকালে গুলিতে জাকারিয়া গুলিবিদ্ধ হয়। এমন খবর জানার পরও বাবা-মা ভাই বোন একেবারেই নির্বিকার। তাদের মনোভাব এতটাই জঙ্গীপ্রবণ যে, জাকারিয়া পুলিশের গুলিতে মরে গেলেও কোন অসুবিধা ছিল না। বরং সে বেহেশত পেত। তাদের পুলিশ হত্যার চক্রান্ত ছিল। কিন্তু তা সহজ ছিল না। এজন্য তারা শুধু শুধু আত্মঘাতী না হয়ে পুলিশের হাতে ধরা দিয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আনসার আল ইসলামের সদস্য হলেও তারা আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের অনুসারী। প্রাপ্ত নথিপত্র মোতাবেক, জাকারিয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে গণিতে অনার্স পাস। ’১২ সালে সে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। এরপর তার মাধ্যমেই পরিবারের সব সদস্যই জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। এমনকি তারা আত্মঘাতী জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। জাকারিয়ার মা সালমা বেগম রীতিমতো বাসায় অন্য মহিলাদের জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত বয়ান করতেন। একমাত্র মেয়ে রিফা উদ্ভিদবিজ্ঞানে এমএসসি পাস। আর ছোট ছেলে কিবরিয়া একটি কলেজে অনার্সে পড়ে। সেও জঙ্গীবাদ বিস্তারে কাজ করে। জঙ্গীদের সম্পর্কে তারা আরও তথ্য দিয়েছে। সেই তথ্য মোতাবেক গত ২ আগস্ট রাতে পল্লবীর ডি ব্লকের ২৫ নম্বর সড়কের একটি জঙ্গী আস্তানা থেকে মাহাদী হাসান ওরফে শান্ত হাসান (২০) নামে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে বহু উগ্রবাদী বই, জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন অপারেশনে ব্যবহৃত দুটি বিদেশী চাকু উদ্ধার হয়। পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহিদুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, মাহাদীর বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে। সে খুলনা, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার অন্তত নয়টি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছে। সর্বশেষ সে মিরপুর-১২ নম্বরে অবস্থিত একটি কওমি মাদ্রাসায় যাতায়াত করত। যদিও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, মাহাদী এ মাদ্রাসার ছাত্র ছিল না। তবে নিয়মিত মাদ্রাসায় যাতায়াত করত। কী কারণে যাতায়াত করত, তা তাদের অজানা নেই। জিজ্ঞাসাবাদে মাহাদী জানায়, ইমাম মেহেদীর নামানুসারে বাবা-মা তার নাম রাখে মাহাদী হাসান। তার পরিবারও ধর্মভীরু। তবে মাহাদীর পরিবার জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী কিনা সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মাহাদী প্রথমে ফেসবুকের মাধ্যমে জাকারিয়ার গ্রুপের সঙ্গে পরিচিত হয়। ওই গ্রুপের সদস্য ছিল অনেক। গ্রুপটির মধ্যে যারা ধর্মান্ধ পরবর্তীতে তারাই একটি পৃথক গ্রুপ তৈরি করে। ওই বিশেষ গ্রুপের মাধ্যমেই জাকারিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা মাহাদীর। তারা একটি সিক্রেট গ্রুপের সদস্য হিসেবে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল। মাহাদীর আগের আস্তানা থেকে আটক জাকারিয়া ও তার কয়েক সহযোগী জঙ্গীসহ বিট কয়েন সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। বিট কয়েনের মাধ্যমে সংগঠনের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক সামগ্রী কেনার পরিকল্পনা ছিল তাদের। সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য তারা সংগঠনের ভেতরে একটি স্পেশাল সিক্রেট (বিশেষ গোপনীয়) উইং চালু করে। এবিটি সদস্যদের প্রশিক্ষণ, উগ্রবাদী বই ক্রয়, বিতরণ, সদস্যদের অন্যান্য খরচ, অনলাইনে জঙ্গী ও উগ্রবাদ প্রচারণার জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে মাহাদী অর্থ সংগ্রহ করত। ইতোপূর্বে আটক জাকারিয়ার ছোট ভাই কিবরিয়ার মাধ্যমে দেশী অস্ত্র কেনার জন্য মাহাদী বহুবার জাকারিয়াকে টাকা দিয়েছে। মাহাদীর কাছ থেকেই জাকারিয়া প্রশিক্ষণ নেয়ার তীর, ধনুক, চাকুসহ দেশী অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, চার দিনের রিমান্ড শেষে মাহাদী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক ওই জবানবন্দীতে মাহাদী জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। পল্লবী থেকে ইতোপূর্বে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। ওই পরিবার মাহাদীকে জঙ্গী তৎপরতা চালাতে অর্থায়ন করত বলে জানায়। মাহাদী কয়েক দফায় পরিবারটির কাছ থেকে অনেক অর্থ পায়। এমনকি সমমনা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে মাহাদীকে অর্থ জোগাড় করে দেয়ার সঙ্গেও সোনালী ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত। দুটি আস্তানা আটক ছয় জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আটক জঙ্গীরা জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে প্রযুক্তির পাশাপাশি তার যে সনাতন পদ্ধতিতেও তাদের তৎপরতা চালায় সেকথা কথা জানায়। তাদের দাবি, সনাতন পদ্ধতিতে অপারেশন চালাতে দেরি হলেও তা অনেক নিরাপদ ও ফলপ্রসূ। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক, একেকটি জঙ্গী সংগঠনের রয়েছে একাধিক উইং। একটি উইং দেশে প্রকাশিত বিভিন্ন বইপত্র, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিনসহ প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ওপর নজর রাখে। আরেকটি উইং টার্গেট করা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। জঙ্গী সংগঠনের শূরা কমিটির বৈঠকে ‘টার্গেট’ ব্যক্তির শাস্তি নির্ধারিত হয়। শাস্তি হিসেবে সাধারণত মৃত্যুদ-ই দিয়ে থাকে তারা। আর ওই মৃত্যুদ-প্রাপ্ত নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করে অপারেশনাল উইং। অপারেশনাল উইংয়ের সঙ্গে কাজ করে গোয়েন্দা উইং। এই উইং ‘টার্গেট’ করা ব্যক্তি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে। টার্গেট কিলিং করতে সুবিধাজনক স্থানসহ সার্বিক বিষয় বুঝিয়ে দেয়। অপারেশনাল উইংকে অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য সীমান্তে একটি উইং কাজ করে। তারা অস্ত্র সংগ্রহ করে অপারেশনাল উইংয়ের কাছে পৌঁছে দেয়। ওই অস্ত্র গোলাবারুদ চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে প্রশিক্ষণ উইং। এই উইং জঙ্গী সদস্যদের আত্মঘাতী প্রবণ হতে নানাভাবে অডিও, ভিডিও, পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ ও হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। যারা অপারেশনে অংশ নেয়, তাদের একটি আবদ্ধ জায়গায় রাখা হয়। ‘তারা অপারেশনাল চালাতে গিয়ে মরলে শহীদ হবে। পরকালে বেহেশত নিশ্চিত হবে। কারণ সে ধর্মের জন্য জীবন দিতে যাচ্ছে। এভাবেই বোঝানো হয় তাদের।’ দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তা জানান, জঙ্গী সংগঠনগুলোর একটি উইং সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে প্রযুক্তিনির্ভর জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। আটকের পর তারা এমন সব তথ্য দিচ্ছে, যা যাচাই-বাছাই করতে রীতিমতো গলদগর্ম হতে হচ্ছে। কোন সময় জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্য মিথ্যা হলে এবং সে বিষয়ে তথ্যদাতা জঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলে ভিন্ন উত্তর মিলছে। তারা বলছে, তিনি যা বলেছেন তাই তিনি সত্য হিসেবে জেনেছেন। সেটি যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে তথ্যদাতা তাকে ভুল তথ্য দিয়েছে। এক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই বলে যুক্তি দাঁড় করায়। এতে করে জঙ্গীদের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করতে দীর্ঘ সময় লাগছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে নাম নিয়ে। অধিকাংশ জঙ্গীই ছদ্মনামে পরিচিত। জিজ্ঞাসাবাদে প্রকৃত নাম ঠিকানা সম্পর্কে জঙ্গীরা ছদ্ম নামটিই বলছে। ফলে তাদের প্রকৃত নাম বা তাদের সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য হালে জঙ্গী সংগঠনগুলো সনাতন পদ্ধতিতেই বেশি তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা কাছাকাছি জায়গায় এক বা একাধিক আস্তানা গড়ে তুলছে। আস্তানায় থাকা জঙ্গীদের মধ্যে বিভিন্ন তৎপরতা চালানোর তথ্য আদানপ্রদান হচ্ছে চিঠি বা চিরকুটের মাধ্যমে। এসব চিঠি ও চিরকুট জঙ্গী সংগঠনটির নিজস্ব সাংকেতিক ভাষায় লেখা। ফলে কোন চিঠি বা চিরকুট উদ্ধার হলেও তার প্রকৃত তথ্য সহজেই উদ্ধার করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এমনকি তথ্য আদান-প্রদানকারী জঙ্গীদের সহজেই গ্রেফতার করাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ যেসব জঙ্গী সনাতন পদ্ধতিতে জঙ্গী কর্মকা- চালাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই থাকছে প্রযুক্তির বাইরে। চিঠি, চিরকুট বা সাংকেতিক ভাষায় লেখা পত্র হেঁটে গিয়ে নির্ধারিত জঙ্গীর কাছে পৌঁছে দেয়। এজন্য কাছাকাছি দূরত্বে জঙ্গীরা একাধিক আস্তানা গড়ে তুলছে, যাতে সহজেই তথ্য হস্তান্তর করা যায়।
×