স্টাফ রিপোর্টার ॥ সমাজ ও জীবনকে তিনি দেখেছিলেন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। সেই জীবনের কথাই মেলে ধরেছিলেন আপন লেখনীতে। সেই সাহিত্যে বর্ণিত হয়েছে পতিতাপল্লীর জীবন যাতনা থেকে বস্তিবাসীর জীবন বাস্তবতা। উল্টোপিঠে আবার ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসে জায়গা করে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালী জাতীয়তাবোধ ও ভাষার বিবর্তন। এবার থেমে গেল পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করা সেই লেখকের জীবনের পরিভ্রমণ। প্রিয় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন একুশে পদকজয়ী প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। শুক্রবার বেলা ১১টায় রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। রেখে গেছেন একমাত্র ছেলে আবদুর রহমানসহ পরিবার-পরিজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী।
শুক্রবার বাদ আসর উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে বাসার কাছের মসজিদে রিজিয়া রহমানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় । জানাজা শেষে মিরপুর সরকারী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
লেখিকার ছেলে আবদুর রহমান জানান, কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন রিজিয়া রহমান। গত বছর থেকে তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। এছাড়া তার কিডনি একদমই কাজ করছিল না। হৃদযন্ত্র দুর্বল ছিল। এসব কারণে তিনি চিকিৎসার মধ্যেই ছিলেন। এর মাঝে শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে ১৩ আগস্ট তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়। সেখান থেকেই চলে যান না-ফেরার দেশে।
রিজিয়া রহমানের মৃত্যুর খবরে শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, লেখক, গবেষক ও নারীনেত্রী মালেকা বেগম প্রমুখ। শোকবার্তায় কে এম খালিদ বলেন, রিজিয়া রহমানের মৃত্যুতে এদেশের সাহিত্য অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্যে ছিল তার অবাধ বিচরণ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিককে দীর্ঘকাল স্মরণে রাখবে দেশের মানুষ।
মূলত ষাটের দশক থেকেই রিজিয়া রহমানের সাহিত্য জীবনের সূচনা হয়। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্যে ছিল তার অবাধ বিচরণ। রাজধানীতে বসবাস করলেও নিজেকে সব সময় নাগরিক কোলাহল থেকে মুক্ত রেখেছেন। কাটিয়েছেন নির্মোহ জীবন। রিজিয়া রহমান রচিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশের অধিক। তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ হলো- অগ্নিস্বাক্ষরা, নির্বাচিত গল্প, চার দশকের গল্প, দূরে কোথাও। উপন্যাস হলো- ঘর ভাঙা ঘর, উত্তর পুরুষ, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলা, অরণ্যের কাছে, অলিখিত উপাখ্যান, শিলায় শিলায় আগুন, ধবল জোৎস্না, সূর্য সবুজ রক্ত, একাল চিরকাল, ঝড়ের মুখোমুখি এবং প্রেম আমার প্রেম। লিখেছেন ‘অভিবাসী আমি’ ও ‘নদী নিরবধি’ নামের দুটি আত্মজীবনী।
উপন্যাসে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন রিজিয়া রহমান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য চলতি বছর অর্জন করেন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক।
রিজিয়া রহমানের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের কলকাতার ভবানীপুরে। তার পৈতৃক নিবাস কলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। তার বাবা আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ছিলেন একজন চিকিৎসক। মা মরিয়াম বেগম ছিলেন গৃহিণী। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তারা বাংলাদেশে চলে আসেন। রিজিয়া রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সেই সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। ১৯৫২ সালে বাবার মৃত্যুর পর তারা চলে আসেন ঢাকার শাইনপুকুরে নানাবাড়িতে । ১৯৬০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় রিজিয়া রহমানের লেখা গল্প ছাপা হয়। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয় তার লেখা কবিতা। ১৯৬৭ সালে ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতার সম্পাদক কামরুন নাহার লাইলির উৎসাহে তিনি ‘লাল টিলার আকাশ’ নামক গল্প লেখেন। পরে ললনা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে চলে যান রিজিয়া রহমান। সেখানে কোয়েটা গবর্নমেন্ট কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে দুই বছর লেখাপড়া করেন। কিন্তু মাইগ্রেশন সার্টিফিকেটসম্পর্কিত জটিলতার কারণে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়নি। এ কারণে তিনি দেশে ফিরে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৫ সালে এই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
রিজিয়া রহমান সাহিত্য পত্রিকা ত্রিভুজের সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কার্য পরিচালক হিসেবে। তিন বছর বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ।
শৈশব থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় রিজিয়া রহমানের কবিতা ও গল্প ছাপা হলেও তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই গল্পগ্রন্থে থাকা ‘লাল টিলার আকাশ’ গল্পটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ অশ্লীলতার অভিযোগে ছাপাতে নারাজ ছিল। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সম্পাদনা বোর্ডকে রাজি করিয়ে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। পরে ললনা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তার ‘ঘর ভাঙা ঘর’ ছাপা হয়। যা বই আকারে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। বস্তির মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-ক্লেদ নিয়ে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসে তিনি চট্টগ্রামে হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারির চিত্র তুলে ধরেন। এতে চিত্রিত হয়েছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস। নীল বিদ্রোহের পরবর্তী সময় খুলনা অঞ্চলের বিপ্লবী রহিমউল্লাহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বীরত্বগাথা নিয়ে লিখেছেন ‘অলিখিত উপাখ্যান’। ২০০৪ সালে প্রকাশিত ‘বাঘবন্দী’ উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন বঞ্চনা থেকে মুক্তির আবশ্যকতা। প্রাচীন নগরীতে যাত্রা উপন্যাসে তিনি লিখেছেন ঢাকার অতীত ও বর্তমান জীবনযাপন। ‘অভিবাসী আমি’ তার আত্মজীবনীমূলক প্রথম বই। এতে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার শৈশবের বর্ণনা দিয়েছেন। তার দ্বিতীয় আত্মজীবনীমূলক বই ‘নদী নিরবধি’ ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি আপন শৈশবের পাশাপাশি লেখকজীবনের বর্ণনা দিয়েছেন।
পারিবারিক জীবনে রিজিয়া রহমান মোঃ মীজানুর রহমানের সহধর্মিণী। মীজানুর রহমান ছিলেন একজন খনিজ ভূতত্ত্ববিদ।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: