ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাসায়নিক প্লাস্টিক কারখানা, গুদাম সরে না কেন- প্রশ্ন জনমনে

পুরান ঢাকায় বারবার আগুন লাগে-মানুষ মরে, সরে না কারখানা

প্রকাশিত: ১০:০৩, ১৭ আগস্ট ২০১৯

 পুরান ঢাকায় বারবার আগুন লাগে-মানুষ মরে, সরে না কারখানা

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ পুরান ঢাকার ইসলামবাগের পোস্তার ঢালের ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের প্লাস্টিক কারখানা ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঈদের ছুটি থাকায় বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ঢাকার চুড়িহাট্টাসহ প্লাস্টিক কারখানা ও কেমিক্যাল গুদামে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের বহু প্রাণহানির পরও টনক নড়েনি কারও। পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল, প্লাস্টিক কারখানা ও গুদাম কেন সরানো গেল না- তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। পোস্তার চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, এখান থেকে আমাদের ব্যবসা সরানোর জন্য কত কিছু হয়েছে। অথচ এখানে ঘিঞ্জি অলিগলির মধ্যে বাসাবাড়িতে শতাধিক প্লাস্টিক কারখানা গড়ে উঠেছে। মাঝে মধ্যেই পুড়ছে ওসব প্লাস্টিক কারখানা, ঘটছে বহু প্রাণহানির ঘটনা, এরপরও সরছে না প্লাস্টিক কারখানা। পোস্তার বাসিন্দা চামড়া ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান জানান, এর আগেও এই পোস্তায় প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লেগেছে। আমার বাড়ির ছাদ পুড়ছে। প্রতিবাদ করেছি, আপত্তি জানাইছি। মাগার কাম হয় নাইক্কা। সবাই নেতা। সবাই প্রভাব খাটায়। হের লাইগাই তো সরে না প্লাস্টিকের কারখানা। লালবাগের উর্দু রোড থেকে কেবি রুদ্র লেন হয়ে চাঁদনীঘাটের দিকে যেতে অদূরেই ইসলামবাগ ওয়াটার ওয়ার্কস রোড। পার্শ্ববর্তী এলাকাটি পোস্তার ঢাল। এর চতুর্দিকে আলীনগর ঘাট, চুড়িহাট্টা, দেবিদাশ ঘাট, গনি মিয়ার ঘাট, লালবাগ কিল্লার মোড়, শহীদ নগর বেড়িবাঁধ, রহমতগঞ্জ লেন ও ফইড়া পট্টি। এসব এলাকায় রাস্তার দুই ধারে শত শত একতলা, দোতলা, চারতলা বাড়ি। অধিকাংশ বাড়ির নিচেই রয়েছে প্লাস্টিক পণ্যের কাঁচামাল, রাসায়নিকের গুদাম অথবা কারখানা। সরু অলিগলিতে কয়েকটি ভবনে রয়েছে পলিথিন কারখানাও। এসব কারখানায় শত শত শ্রমিক কাজ করে। ভবনগুলোর বিভিন্ন তলায় নারী, পুরুষ, শিশুসহ পরিবারের বাস। প্রতিদিনই অসংখ্য লোক সমাগম ঘটে। পুরান ঢাকায় সাম্প্রতিক বেশিরভাগ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে এসব গুদাম-কারখানা থেকে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রাণ গেছে ৭৮ জনের। ওই অগ্নিকান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্লাস্টিকের গুদামকে দায়ী করা হয়। চালানো হয় অভিযান। গত বছরের ২৪ আগস্ট আলীরঘাট এলাকার একটি প্লাস্টিক কারখানায় লাগা আগুনে ৮ থেকে ১০ ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন তখন বলেছিলেন, ‘প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকের কেমিক্যাল থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। গত বুধবার রাতে পোস্তার ঢালে ওয়াটার ওয়ার্কস রোডে আগুনে পুড়ে যাওয়া ‘টিপু হাজী’ নামে ভবনের নিচ তলায় প্লাস্টিক কারখানাও ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে পার্শ¦বর্তী কয়েকটি প্লাস্টিক ও জুতার কারখানা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই অকুস্থল টিপু হাজী ভবনের লাগোয়া ভবনটি ফজলুল রহমানের। তিনি জানান, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এর আগে চুড়িহাট্টার আগুনের পর প্রতিবাদ করা হয়েছে। কারখানা পরিচালনায় আপত্তির কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু লালবাগের আবাসিক এলাকা থেকে প্লাস্টিকের কারখানা সরানো যায়নি। বৃহস্পতিবার রাতের আগুনে বারবার মনে হইতাছিল, এই বুঝি আমার ঘরেও আগুন লাগব। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে গেছে রাতটা। আল্লাহ সহায় ছিল বলে বাঁইচ্চা গেছি। ওই ভবনটির আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, আগুন জ্বলে, ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভায়। এরপর কিছুদিন তোড়জোড় চলে। এরপর আবার অদৃশ্য কারণে সব বন্ধ হয়ে যায়। আবার কেমিক্যাল গুদাম চলা শুরু করে আগের মতোই। এর পেছনে সরকারদলীয় কিছু লোকের প্রভাব রয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়। গত বুধবার রাতের আগুনে দুই তলা ভবনটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিক এলাকা হলেও গলিপথ সরু। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার মতো স্পেস নেই। নেই পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও। চোখে পড়েনি একটা ফায়ার হাইড্রেন্টও। বাসিন্দারা জানান, এই এলাকায় ব্যবসা করি। কিন্তু আমার এখানে কারখানা-গুদাম, পরিচালনায় জোর আপত্তি আছে। কারণ আমরাই এখানে থাকি। আমাদেরও বাচ্চারা এখানে বেড়ে ওঠে। প্লাস্টিকের একটি কারখানা পুড়ল। কিন্তু এখানে প্লাস্টিকসহ অন্যান্য ৩০-৩৫ কারখানা আছে। দাহ্য পদার্থও রয়েছে। তাহলে এভাবেই ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করতে থাকব আমরা? ওই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী বাসিন্দা সোবহান মিয়া জানান, আজ আগুনে একটি কারখানা পুড়ল। কাল হয়ত অন্য কোথাও লাগবে। এই লাগার পরেই আবাসিক এলাকা থেকে কারখানা উঠিয়ে দেয়ার তোড়জোড় করে সিটি কর্পোরেশন। এরপর কয়েকদিন বাদেই সব গুটিয়ে যায়। ফের আগুন লাগে ফের তোড়জোড় শুরু হয়। নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা- এই দেখে আসছি আমরা। এখানেই ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের প্রতিবাদে কোন কাজ হয়নি হয় না। এই আগুনই প্রমাণ করেছে যে, এখানে কারখানা আছে। পুড়ে যাওয়া ভবনটির সামনে ও পেছনে তিনটি বড় বড় ট্রান্সফরমার লাগানো, পেছনেও। সাধারণত যতটা ওপরে বসানো থাকে ট্রান্সফরমার তার চেয়ে অনেক নিচেই একটি খুঁটিতে বসানো হয়েছে। পুড়ে যাওয়া কারখানার মালিক বশির আহমদের বোন আয়শা আক্তার মালা জানান, প্লাস্টিকের ¯ূÍপসহ আগুনের ধ্বংসাবশেষও আমাদের সরিয়ে নিতে বলেছে ফায়ার সার্ভিস। ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভবনটি ভাঙতে বলেছে সিটি কর্পোরেশন। আজ (শুক্রবার) সেটা শুরু করা হয়েছে। আগুনের কারণে তিন কোটি টাকার মতো মালপত্র ও মেশিন পুড়ে গেছে। মালিক বশির ভাই টেনশনে এখন শয্যাশায়ী হাসপাতালে ভর্তি।
×