ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ম্যাজিস্ট্রেটের ফেসবুক স্ট্যাটাসে তোলপাড়

কুমিল্লা মেডিক্যালে চিকিৎসা নিতে বিড়ম্বনা

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ১৭ আগস্ট ২০১৯

 কুমিল্লা মেডিক্যালে চিকিৎসা নিতে বিড়ম্বনা

মীর শাহ আলম, কুমিল্লা ॥ কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্ত্রীর চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়ে ভুক্তভোগী এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। ম্যাজিস্ট্রেট তার উপলব্ধিতে বলেছেন, ‘গরিবদের চিকিৎসা নেই। স্বাস্থ্যসেবা ২৪ ঘণ্টার নয়, বরং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের (সরকারী-বেসরকারী) মর্জি মোতাবেক নির্ধারিত সময়।’ স্থানীয়রা বলছেন, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার স্ত্রীর চিকিৎসা সেবা নিতে এসে এমন দুঃসহ বিড়ম্বনার শিকার হলে সাধারণ রোগীদের অবস্থা কি, তা সহজেই অনুমেয়। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু রোগীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা ও অগ্রাধিকার দিয়ে সেবা দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও দু’দিন ধরে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ডাক্তারের দেখা পাচ্ছেন না বলে ক্ষোভ জানিয়েছেন রোগীর অভিভাবক। কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের প্রথম শ্রেণীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার শুক্রবার সকাল ৬টা ৫৮ মিনিটে (plaban imdad) নামে তার ফেসবুক পেইজে স্ট্যাটাসে লিখেন, রাত ৩টা ৩০ মিনিটে তার স্ত্রীর পেটে তীব্র ব্যথা হলে ইমারজেন্সি এ্যাম্বুলেন্সের অনেকগুলো নম্বরে ফোন করেও রিসিভ না হওয়ায় কোন এ্যাম্বুলেন্স পাননি। পরে পায়ে হেঁটে ও সিএনজিযোগে ভোর সাড়ে ৪টায় তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে পৌঁছেন। তিনি ফেসবুকে উল্লেখ করেন, ইমারজেন্সি তখন ঘুমাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে ডিউটি ডাক্তার সাহেবের ঘুম ভাঙ্গানো হলো। উনি কাগজ লিখে দিয়ে ৪ তলায় ৪১৭নং ওয়ার্ডে যেতে বলেন। ওখানে ১৫ মিনিট কাউকে না পেয়ে অবশেষে এক সিস্টার বা আয়া এমন কাউকে পাওয়া যায়। জানালেন, ডাক্তার সাহেব ঘুমাচ্ছেন। আধাঘণ্টা ধরে দরজা নক করার পর ডাক্তার এলেন, দেখলেন। তারপর ব্যবস্থাপত্র লিখতে গিয়ে দুটি কলমই কালিশূন্য পেলেন। আবার চলে গেলেন তার কক্ষে, ফিরলেন আরও ১০-১২ মিনিট পর। এদিকে বেশ কয়েকজন রোগী জমে গেছে। অবশেষে স্ত্রীর ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ লিখলেন। সঙ্গে ওই ডাক্তার সাহেব অতিরিক্ত ২টি স্লিপ ধরিয়ে দিলেন। ১নং স্লিপে ৭টি টেস্টের নাম। ২নং স্লিপে বাদুরতলার শেফা ও আজাদ ক্লিনিকের নাম। মুখে বলে দিলেন ওই টেস্টগুলো যেন ওখান থেকে করাই। অনেকটা আদেশের মতো। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার ফেসবুকে আরও উল্লেখ করেন, এরমাঝে কথা হলো দেবিদ্বার থেকে আসা ডেঙ্গু আক্রান্ত এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে। তার মহিলা রোগীর প্লাটিলেট কমেই চলছে। এই নিয়ে ওই রোগীর স্বজন উদ্বিগ্ন। কিন্তু ওয়ার্ডে কোন ডাক্তার নেই। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক ওই রোগীর স্বজনের ইন্টারভিউটি ভিডিও ধারণ করে তার ফেসবুকে ছেড়ে দেন। পরে তিনি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে স্ত্রীর ইনজেকশনটা একটি বেসরকারী হাসপাতালে পুশ করেন। এ অবস্থায় ওই ম্যাজিস্ট্রেট তার ফেসবুক পেইজে ৫টি উপলব্ধির কথা উল্লেখ করেন। উপলব্ধি-১: গরিবদের জন্য কোন চিকিৎসা নেই। উপলব্ধি-২: ডেঙ্গু নিয়ে প্রান্তিক লেভেলে সরকারের নির্দেশনা কতটা ফলো করা হচ্ছে তা ভেবে দেখার আছে। উপলব্ধি-৩: আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ২৪ ঘণ্টার নয়, বরং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের (সরকারী- বেসরকারী) দায়িত্বশীলদের মর্জি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে। উপলব্ধি-৪: অধিকাংশ বেসরকারী ক্লিনিক শুধু সকাল-সন্ধ্যায় দোকান খোলে, ব্যবসা শেষে দোকান বন্ধ। রোগী জাহান্নামে যাক। যা আইনত দন্ডনীয়। ক্লিনিকে অবশ্যই ইমারজেন্সি ডাক্তার থাকা আবশ্যক। উপলব্ধি-৫: এ তিনি (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) যত দায় আমাদের- এ শিরোনামে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের ঘুম হারাম করে ও রাত জেগে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন। মেডিক্যাল সেক্টরের এহেন দশার জন্য করুণা জানিয়ে তিনি স্র্রষ্টার নিকট হেদায়েত দানের আবেদন জানান। এদিকে তার এ স্ট্যাটাসটি ফেসবুকে ভাইরাল হলে শুক্রবার দিনব্যাপী শুরু হয় তোলপাড়। চিকিৎসা সেবা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়। একজন মন্তব্য করেন- আপনার উপলব্ধি এ হাসপাতালের প্রতিদিনের চিত্র। একজন লিখেছেন, কেউ যেন রাতে অসুস্থ না হয়। কেউ কেউ বলছেন, বিচারকের আসনে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার স্ত্রীর চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে এমন বিড়ম্বনার শিকার হলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কি তা সহজে অনুমান করা যায়। অপরদিকে শুক্রবার ওই হাসপাতালে সরেজমিন পরিদর্শনকালে ১৮নং ওয়ার্ডের মহিলা বেডের ডেঙ্গু রোগী শুরভী আক্তারের পিতা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ৪নং শ্রীপুর ইউনিয়নের বাঘারপুস্কুরনী গ্রামের বজলুর রহমান (৭০) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মেয়ের অবস্থা খারাপ। দুই দিন ধরে ডাক্তারের কোন দেখা পাচ্ছি না। শুক্রবার পর্যন্ত এই হাসপাতালে ৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ স্বপন কুমার অধিকারী বলেন, সাংবাদিকের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ফেসবুকে স্ট্যাটাসের বিষয়টি জানতে পেরেছি। শনিবার (আজ) এ বিষয়ে খতিয়ে দেখব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীরা ডাক্তারের দেখা পাচ্ছে না এমন অভিযোগ সত্য নয়। তারপরও এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×