ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আই উইল নট ডিফেন্ড মাইসেলফ ॥ ১৭ আগস্ট, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১৭ আগস্ট ২০১৯

আই উইল নট ডিফেন্ড মাইসেলফ ॥ ১৭ আগস্ট, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিন তিন বাঙালী নাবিক সুতলেজ নামক এক পাকিস্তানী জাহাজ পরিত্যাগ করে আসে মনট্রিলে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায় তারা পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া নিরাপদ মনে করেননি। তারা জাহাজটিকে সহযোগিতা করাও পছন্দ করেননি, যেটি পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো অস্ত্র পরিবহন করছিল। পাকসেনাদের একটি বিরাট দল নদীর পাড় দিয়ে এবং সঙ্গে সৈন্য বোঝাই তিনটি নৌকা শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে নৌকার আরোহী ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের নদীর পাড় দিয়ে আসা দলটির প্রবল চাপে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে। মুক্তিবাহিনী সারদা পুলিশ একাডেমিতে অবস্থানরত পাকিস্তানী কোম্পানির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই দুঃসাহসিক অভিযানে মুক্তিযোদ্ধা দলের একজন ব্যতীত সকলেই শহীদ হন। মুক্তিবাহিনীর সুন্দরবন ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কনফারেন্স ডাকেন। এ কনফারেন্সে বরিশালের চারটি থানা আক্রমণের জন্য পৃথক পৃথক দল গঠন করা হয়। দলগুলো হচ্ছেÑ ভা-ারিয়া থানার জন্য সুবেদার আজিজ এবং লতিফের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল; কাউখালী থানার জন্য কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল; রাজাপুর থানার জন্য সুবেদার রুস্তমের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল ও মঠবাড়িয়া থানা আক্রমনের জন্য ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি দল। নৌকমান্ডোর আরও একটি ইউনিট মাঝির ছদ্মবেশে রাতে চাঁদপুরের নিকট দিয়ে নদী পাড়ি দেন। এমন সময় নৌ-কমান্ডোরা ঝড়ের মুখে পতিত হন। এর ফলে নৌ-কমান্ডোদের চরের মধ্যে বেশকিছু সময় নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত্রে কিন্তু ওই দিনটি মেঘাচ্ছন্ন দুর্যোগপূর্ণ থাকায় নৌ-কমান্ডোদের পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ায়, অভিযান দুই দিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৭ আগস্ট রাত ১১টায় কমান্ডোরা প্রথম অভিযান পরিচালনা করে। এর আগে দিনের বেলায় চাঁদপুর শহর ও নদীপথ ভালভাবে পরিদর্শন করা হয়। কমান্ডোদের ছয়টি দলে ভাগ করে প্রত্যেককে একটি করে লিমপেট মাইন পেটে বেঁধে উল্টাপথে সাঁতার দিয়ে টার্গেটের দিকে অগ্রসর হওয়ার সংকেত দেয়া হয়। সংকেত পেয়ে দুইটি মাইনসহ সবাই রওনা দেয়। দুজন ছাড়া সবাই তাদের টার্গেটে মাইন লাগাতে সমর্থ হয়। এরপর কমান্ডোরা সাঁতরিয়ে পদ্মার মুখে এসে পড়ে। এমন সময় সৈন্যবাহী জাহাজ গাজী মুক্তিফৌজকে বাধা দেয়। তখনই জাহাজে লাগানো মাইন বিকট আওয়াজে বিষ্ফোরিত হয়। জাহাজের ভেতরে তখন হৈহুল্লোড় চিৎকার শুরু হয়ে যায়। তখন দুই ধার থেকে হানাদার বাহিনী নদীর মধ্যে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা গুলির মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার মতো করে আত্মরক্ষার জন্য দ্রুত সরে পড়ে। অন্য দুই দলসহ আরও ছয়জন কমান্ডো তখন পদ্মা নদীর মুখে গাজী জাহাজের সামনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তখন প্রায় ভোর হয়ে আসছিল। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর সবশেষে লাগানো আরও একটি মাইন জেটির খুব কাছাকাছি এলাকায় বিস্ফোরিত হলে পদ্মা নদীর মুখে অবস্থান নেয়া পাকসৈন্য বোঝাই জাহাজ গাজী দ্রুত বেগে নদীর মুখ থেকে ভেতরে চলে যায়। ওই সুযোগে অবরুদ্ধ কমান্ডোরা পদ্মার মুখ পার হয়ে পাটক্ষেতের পাশে ঢুকে পড়ে নিরাপদে ঘাটিতে ফিরে আসে। কুড়িগ্রামের চিলমারীর পূর্বদিক দিয়ে এগিয়ে গেল ৮ম ইস্ট বেঙ্গল। নাস্তানাবুদ হয়ে গেল দুটি হানাদার পজিশন। নিহত হয় ৪ জন পাক হানাদার সৈনিক। জায়গা বদল করে এগুচ্ছে ফার্স্ট বেঙ্গল, থার্ড বেঙ্গল। রক্তক্ষয়ী চিলমারীর বুকে তিন দিন তিন রাত ধরে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল বীরের বাহিনী ইস্ট বেঙ্গল; শত্রুর লেটেস্ট আর্টিলারি ও সফিস্টিকেটেড আর্মসের সামনে কটা এসএস-এর আর থ্রি-নট-থ্রি নিয়ে। টাঙ্গাইলে ভাতকুরা ও পয়লার মাঝখানে মুক্তিবাহিনী ও পাকবর্বরদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা বাকু শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধা বিমান বিহার দাস পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। সিলেটে পাকহানাদার বাহিনী ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে। বানিয়াচং থানা সদর থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এক বিশাল দল মাকালকান্দি গ্রামের উপর হামলা চালিয়ে ৮৭ জন নিরীহ নিরপরাধ লোককে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হয় আরও কয়েকশ’ লোক। লুণ্ঠিত হয় পুরো গ্রাম। পাশের হারুনি গ্রামের ৫ জনকেও পাকবর্বররা হত্যা করে। নাগোয়ার আব্দুর রশিদকে কোম্পানি কমান্ডার ও মোঃ সেলিম সাজ্জাদকে কোম্পানি টু-আই-সি করে ময়মনসিংহের বিদ্যুত স্টেশন উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। অপারেশন শেষে ফেরার পথে ময়মনসিংহের গোয়াতলা বাজার সংলগ্ন নদীতে নৌকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের এ্যামবুশের কবলে পরে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সকল অস্ত্রই নদীতে নিমজ্জিত হয়। বাকি কয়েকটি অস্ত্র ও গ্রেনেড দিয়ে প্রায় ৫ ঘণ্টা শত্রুদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করে স্থানীয় জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে প্রেরণ করা হয়। এই যুদ্ধে বাঘমারার ইদ্রিস আলম শাহাদাতবরণ করেন। বাংলাদেশের অবিভক্ত সিলেট জেলার হবিগঞ্জ উপ-বিভাগের অধীনে চারদিকে হাওড় বেষ্ঠিত মাকালকান্দি গ্রামটি প্রাকৃতিক দুর্গের মতো দেখতে। স্থানীয় এমপি গোপাল কৃষ্ণ মহারত্ন তার পরিবারকে সুরক্ষার জন্য মাকালকান্দি গ্রামে পাঠান। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক হিন্দু শরণার্থী হিসেবে মাকালকান্দি গ্রামে আশ্রয় নেয়। মেজর দুররানির নেতৃত্বে পুলিশ অফিসার জয়নাল আবেদিন এবং স্থানীয় রাজাকার সৈয়দ ফজলুল হকসহ পাকহানাদারের একটি দল খুব ভোরে নৌকায় করে সকাল নয়টার দিকে মাকালকান্দি গ্রামে এসে পৌঁছে। গ্রামবাসীরা ভিসারি পূজার আয়োজনরত ছিল। হঠাৎ, পাকিস্তানী সৈন্যরা নৌকা থেকে গুলি চালানো শুরু করে। গ্রামবাসীরা যে যেদিকে পারে, পালাতে থাকে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৌকা থেকে নেমে চান্দিমন্ডপ থেকে বারোজন গ্রামবাসীকে ধরে ফেলে এবং চান্দিমন্ডপের সামনে একই সারিতে দাঁড় করায় এরপর হানাদাররা সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজে বিশজন লোককে গুলি করে হত্যা করে দেহগুলো সুতা নদীতে ফেলে দেয়। মহিলাদের ধর্ষণ করা হয় এবং রাজাকাররা লুটপাটের পর পুরো গ্রামে পেট্রোল ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগের ১৬ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে ২৩ আগস্টের মধ্যে সামরিক আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। লাহোরে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আজম বলেন, ভারত পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করার ব্যাপারে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী (মুক্তিযোদ্ধা) পাঠিয়ে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে এবং যুদ্ধের মাধ্যমেই পাকিস্তানকে তার জবাব দিতে হবে। গোলাম আজম আওয়ামী লীগের ৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের আসন বহাল থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বিচার চলাকালে ডিফেন্স ল’ইয়ার হিসেবে একে ব্রোহীকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল পাকিস্তান সরকার। বঙ্গবন্ধু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আই উইল নট ডিফেন্ড মাইসেলফ। বিকজ ইয়াহিয়া খান ইজ দি প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান। ইয়াহিয়া খান ইজ দি চিফ মার্শাল’ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটটর। হি ইজ দি কনফার্মিং অথরিটি অব মাই ডেথ সেনটেন্স। অলরেডি হি টোল্ড, মুজিব ইজ এ ট্রেইটর। যেহেতু রায় দেওয়া হয়ে গেছে। সুতরাং আমি নিজকে ডিফেন্ড করবো না।’ লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×