ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরগঞ্জের হাওড়ে চাঁইপল্লী

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ১৭ আগস্ট ২০১৯

কিশোরগঞ্জের  হাওড়ে চাঁইপল্লী

জেলার হাওড় অধ্যুষিত উপজেলাগুলো বর্ষা মৌসুমে চিংড়িসহ দেশীয় মাছ আহরণের গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের হাওড় উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী, করিমগঞ্জ ও তাড়াইল উপজেলার জেলেপাড়াগুলোর স্থায়ী বাসিন্দা হাজার হাজার জেলে ছাড়াও এসব এলাকার মৌসুমী বেকার হাজার হাজার লোক বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরা পেশায় সম্পৃক্ত হয়। বিভিন্ন ধরনের জালের পাশাপাশি বাঁশের তৈরি চাঁই দিয়ে তারা মাছ শিকার করেন। ভরা বর্ষায় বিশেষ করে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত চিংড়ি মাছ শিকারের জন্য এ অঞ্চলে চাঁইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকে। আর এ কারণে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করার উপায় চাঁই তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে চাঁইপল্লী। হাওড় উপজেলা ইটনা সদরের হাজারিকান্দা, দাসপাড়া, ঈমানপাড়া ও নয়াপাড়া এ চারটি চাঁইপল্লীতে কাজ করছেন চার শতাধিক কারিগর। তারা চাঁই তৈরির কাজ করে তাদের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে। অভাবের কারণে একসময় কলহ ও অশান্তিতে থাকা বিষণ্ণ মুখগুলোতে এ কাজ এনে দিয়েছে হাসি। সরেজমিনে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে হাওড়াঞ্চলের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের বাড়িতে এখন চাঁই তৈরির ধুম পড়েছে। বাঁশ, প্লাষ্টিকের বস্তা, গুনা ও সুতা দিয়ে চাঁই তৈরির কাজ করে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হচ্ছে তারা। অথচ ১৫-২০ বছর আগেও এখানকার লোকজন এ কাজে সেভাবে যুক্ত ছিলেন না। চাষবাস করে কোনরকমে চলে যেত তাদের। কিন্তু মৌসুমী বেকারত্ব আর আগাম বন্যায় ফসলহানি তাদের মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়। প্রকট দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে এলাকার অনেকেই কাজের খোঁজে পাড়ি জমায় দেশের নানা প্রান্তে। ভিটেমাটি আঁকড়ে যারা গ্রামে পড়ে ছিল, তাদের কেউ কেউ সাময়িক বেকারত্ব ঘুচাতে যুক্ত হয় চাঁই তৈরির কাজে। তাদের তৈরি করা চাঁই গুণেমানে ও টেকসইয়ের দিক থেকে বেশ ভাল হওয়ায় মাছ শিকারীদের কাছে এগুলোর কদর বেড়ে যায়। ফলে এ কাজে অন্যদেরও আগ্রহ তৈরি হয় এবং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে চাঁই তৈরির কারিগরের সংখ্যা। হাজারিকান্দা, দাসপাড়া, ঈমানপাড়া ও নয়াপাড়া মিলিয়ে বর্তমানে চাঁই তৈরির কারিগরের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়াও চাঁই তৈরির বিভিন্ন পর্যায়ে আরও বহু লোক জড়িয়ে আছে এ পেশায়। সবমিলিয়ে কর্মমুখর গ্রামজুড়ে কেবল অভাব জয়ের উদ্যোগ। বেশ কয়েকজন চাঁই কারিগরের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, হাজারিকান্দা ও দাসপাড়া গ্রামের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে চাঁই তৈরির কাজ করছেন। একজন কারিগর প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি চাঁই তৈরি করতে পারেন। তবে বর্তমানে চাঁই তৈরির বিভিন্ন উপকরণ যেমন বাঁশ, প্লাষ্টিকের বস্তা, গুনা ও সুতার দাম এখন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চাঁই তৈরির খরচও বেশ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় তারা দাম পান না। এ সময় অনেকে জানায়, বর্ষায় এ এলাকার হাজার হাজার লোক চাঁই দিয়ে চিংড়ি মাছ শিকার করেন। এ কারণে সে সময় চাঁইয়ের প্রচুর চাহিদা থাকে। এ জন্য তাদের পুরো বছর ধরে চাঁই তৈরি করতে হয়। তবে নিজেদের মূলধন না থাকায় চাঁই তৈরি করতে গিয়ে তাদের বেপারীদের নিকট থেকে দাদন নিতে হয়। চাঁই তৈরি করে তাদের আবার বেপারীদের নিকটই বিক্রি করতে হয়। একেকটি চাঁইয়ে তারা মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকা লাভ পান। এ কারণে বছরের পর বছর ধরে কারিগর হিসেবে কেবল চাঁই তৈরি করে গেলেও কষ্ট করেই পরিবার পরিজন নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। -মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ থেকে
×