ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সবুজ পাহাড় ধু-ধু মরুভূমি

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ১৭ আগস্ট ২০১৯

সবুজ পাহাড় ধু-ধু মরুভূমি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ উখিয়ায় সবুজ পাহাড় আর নেই। প্রাকৃতির দান আগের সেই পাহাড়গুলো কেটে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে রোহিঙ্গা পল্লী। ঘন সবুজ পাহাড়ের বনজঙ্গল সাবাড় করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিবাস। এতে সরকারের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জানা যায়, উখিয়ার কুতুপালং থেকে শুরু করে টেকনাফের রইক্ষ্যং পর্যন্ত ছিল বিশাল বনজসম্পদ। পাহাড়গুলোতে ছিল সংরক্ষিত ও সামাজিক বনায়ন। দুই বছর আগেও টেকনাফ-উখিয়ায় ছিল গায়ে গা লাগানো অসংখ্য ছোটবড় পাহাড়। উখিয়া সীমান্ত দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা স্রোত অনুপ্রবেশের আগে ওইসব এলাকার চিত্র ছিল ভিন্ন। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই শুধু সবুজ আর সবুজ পাহাড়। এ যেন মনজুড়ানো অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলা। পর্যটকরা গাড়িতে চড়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে টেকনাফ যাবার সময় ওসব দৃশ্য দেখে তাকিয়ে থাকত। আকাশে হেলান দিয়ে থাকা ওসব পাহাড়ের গহিন অরণ্য ছিল বণ্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। যে কারণে সড়কের কিছুদূর পরপরই বন বিভাগের সতর্কতামূলক বিলবোর্ড (হাতি চলাচলের রাস্তা) চোখে পড়ত। সন্ধ্যা, এমনকি দিনের বেলায়ও দেখা যেত বন্যহাতি। পথচারীরা সাবধানে পথ পাড়ি দিত অন্যরকম এক অনুভূতি নিয়ে। এমন দৃশ্য এখানে দুই বছর আগেও ছিল। কিন্তু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে গিয়ে ভাঙ্গাগড়ার মুখে পড়ে পাহাড় ও সবুজ বন বনানী সব শেষ। উখিয়ার সেই সবুজ পাহাড় এখন ধু-ধু মরুভূমি। বন্যপশু প্রাণীর অভয়ারণ্য মধুরছড়া, লম্বাশিয়া এলাকায় অর্ধশত বুলডোজার দিয়ে পাহাড় কেটে শ্রেণী পরিবর্তন করা হয়েছে। আর শত শত ডাম্পার গাড়িতে করে মাটিগুলো অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লন্ডাখালী থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সড়কপথে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে মধুরছড়া ও লম্বাশিয়া এলাকায় এনজিও কর্মকর্তারা বুলডোজার দিয়ে পাহাড়কে সমতল করে ফেলেছে। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল ঠিক করতে গিয়ে সরকার বরাদ্দ করেছে প্রায় ৬ হাজার দুইশত একর বনভূমি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্থায়িত্ব দৃঢ় করার জন্য এনজিওগুলো অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে। সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার পরিস্থিতিও পাল্টে যেতে থাকে। দ্রুত সময়ের মধ্যে চমকে ওঠার মতো পরিবর্তন সেখানে। পাহাড় কেটে পাকা রাস্তা, কংক্রিটের ব্রিজ, আরসিসি পিলারের ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। এনজিও ও বিভিন্ন সংস্থার এসব কর্মকা- দেখে মনে হবে যে রোহিঙ্গারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। মানবিক সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বিদেশ থেকে যে কোটি কোটি অর্থ আসে, তার এক অংশ ব্যয় হয় রোহিঙ্গা শিবিরে। আর বিশাল অংশ ব্যয় হচ্ছে এনজিও কর্মকর্তাদের ভোগ বিলাসে। পর্যটন শহরের বিভিন্ন হোটেল থেকে সকালে বের হয়ে সহজে পৌঁছা যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখান থেকে সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে একাধিক এনজিও প্রতিনিধি নানা রকমের ফুর্তিতে মেতে ওঠে। অন্য কোথাও সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে সরকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে ওই এনজিওগুলো। ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, বনের গাছগাছালি কেটে সাবাড় ও পাহাড়-টিলা কেটে সমতল করে সেখানে গড়ে উঠেছে হাটবাজার, বিপণিবিতান, বিভিন্ন এনজিওর স্কুল, মাদ্রাসা ও হাসপাতাল। সকাল-বিকেল শত শত দামী গাড়ি চলাচলে মুখরিত থাকে রোহিঙ্গা শিবির। প্রায় সময় দীর্ঘ যানজটেও পড়তে হয় পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে ওঠা উপসড়কে। উখিয়ার বালুখালী পশ্চিমপাড়া, জুমেরছড়া, থাইংখালীর লন্ডাখালী, ময়নারঘোনা, তাজনিরমারখোলা, কুতুপালংয়ের মধুরছড়া, লম্বাশিয়ার পাহাড় কেটে নতুন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। পাহাড়ের বুকচিরে, ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে পাকা রাস্তাঘাট। সেখানে অবলীলায় চলছে মালবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস, এনজিওদের দামী জিপ, অটোরিক্সা, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন। এত সুযোগসুবিধা পেয়েও রোহিঙ্গাদের নীতি বদলাচ্ছে না। সন্ধ্যার পরপরই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা ঘুরে বেড়ায়। হুমকি দেয় মিয়ানমারে ফিরে না যেতে। রাতে অস্ত্র চালানো প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। অবৈধভাবে দোকান খুলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই হাজার টাকায় বাংলাদেশী বিভিন্ন অপারেটরের সিম কিনে ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন। নির্বিচারে কেটে ন্যাড়া করা পাহাড়গুলোতে রোহিঙ্গা ঝুপড়ি ছাড়াও গড়ে উঠেছে স্কুল মাদ্রাসা। কোন কোন স্কুলে রোহিঙ্গা ভাষাতেই শিক্ষাপাঠ চলছে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেসব স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ওইসব স্কুলে রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা পাঠ্যবই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। স্থানীয়রা বলেন, কয়েকবছর আগেও উখিয়া সদরে ছিল বড় বাজার। কিন্তু সেই জৌলুস এখন আর নেই। কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী এবং পালংখালী রোহিঙ্গা শিবিরের সামনে ও ভেতরে বড় বাজার বসেছে। রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতর স্বর্ণালঙ্কার, প্রসাধনী থেকে শুরু করে সব পণ্যেরই দোকান আছে। ওই দোকানগুলোর মালিক সবাই রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের কক্ষের একপাশ ব্যবহৃত হচ্ছে থাকা-খাওয়ার কাজে, অন্যপাশ দোকানদারিতে। এসব ছোটখাটো দোকান ছাড়াও ক্যাম্পে বেশকিছু বড় বড় দোকান ও স্থায়ী বাজার গড়ে উঠেছে। ইলেকট্রনিক্স পণ্য, জামা-কাপড়, জুতা, ওষুধ, জ্বালানি কাঠ, গ্যাসের সিলিন্ডার, দা-বঁটি-কুড়াল, রড-সিমেন্ট, দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই পাওয়া যায় এখানে। বার্মিজ সোনা, মোবাইল থেকে শুরু করে এমন কোন মূল্যবান সামগ্রী নেই যে সেখানে বেচা-কেনার দোকান নেই। বার্মিজ ভাষায় দোকানের নাম রয়েছে। স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, এমন সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে রোহিঙ্গারা কি আদৌ মিয়ানমারে ফিরে যাবে?
×