ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ছবি

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ১৭ আগস্ট ২০১৯

বঙ্গবন্ধুর ছবি

সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বর্ণা অবাক। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ও দেখে আব্বা গোসল সেরে ফেলেছেন। মা ব্যস্ত পায়ে নাস্তার জোগাড় করছেন। আপু আর ভাইয়া ঝুমুর তুলে পড়ছে। একটু পরে নাস্তা সাজিয়ে মা তাগিদ দেন, : ওঠ ওঠ, টেবিলে যা, নাস্তা জুড়িয়ে যাচ্ছে। আম্মা আপনিও আসেন। গরম গরম না খেলে ভাল লাগবে না। আম্মা মানে স্বর্ণার দাদি। দাদি স্বর্ণাদের কাছেই থাকেন। অনেক বয়স হয়েছে তার। এখন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটেন। নাস্তা বড় সাধাসিধে। কোনদিন আটার রুটি আলু ভাজি বা সবজি, কোনদিন ফ্যান ভাত আলু বেগুন ভর্তা আবার কোনদিন পরোটা ডিম সুজির হালুয়া। যেদিন পরোটা হয় সেদিন কেমন যেন একটা সুগন্ধ ছড়ায় বাতাসে। দাদি আসেন লাঠি ঠুকঠুক করে। আপু আর ভাইয়া তাড়াতাড়ি টেবিলে বসে প্লেট টেনে নেয়। হাত দিয়ে পরোটা নিতে গিয়ে গরম লেগে উহ্ করে ওঠে। মা হাসেন, পরিতৃপ্তির হাসি। মুখে বলেন, : আরে একটু রয়ে সয়ে। পালিয়ে তো যাচ্ছে না আপু বলে, : রোজ কেন পরোটা কর না মা? পরোটা খেতে বেশ মজা। মা কিছু বলেন না। ওরা কি করে বুঝবে রোজ পরোটা বানানোর অনেক খরচ। ওরা ছেলেমানুষ ওদের এসব বলে লাভ কী! পরোটা হলে অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে খায় আপু ভাইয়া। একটু করে পরোটা ছেড়ে আরেকটু করে ডিম আর সামান্য সুজি। যেন অনেকক্ষণ থাকে, না ফুরোয় এমনই ওদের ইচ্ছে । কিন্তু এক সময় ফুরিয়ে যায়। আপু বলে, : আবার কবে পরোটা বানাবে মা? : বানাব। মা কোন নির্দিষ্ট তারিখ বলেন না। আপুও আর জোর করে না। ও জানে এর চেয়ে বেশি উত্তর মার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। স্বর্ণা ছোট বলে ওর ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। ও স্কুলে ভর্তি হয়নি তাই নাস্তা খেয়ে স্কুলে যাবার ব্যাপার নেই। যেদিন খুব বেলাতেও ওর ঘুম ভাঙে না, মা ঘুম ভাঙিয়ে দেন। হাতে সময় থাকলে নিজে খাইয়েও দেন। আবার কোন কোনদিন নিজেই উঠে পড়ে স্বর্ণা। আজ ও নিজেই উঠেছে। উঠে দেখে আব্বা গোসল করেননি। কেমন যেন উস্কোখুস্কোভাবে বিষণ্ণ মুখে বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন। মাও মলিন মুখে নাস্তার তদারক করছে। আপু ভাইয়াও চুপচাপ। আজ ওদের পড়া শোনা যাচ্ছে না। তাদের পড়া শোনা যাচ্ছে না বলে কেউ ওদের কিছু বলছেও না। দাদি লাঠি টুকঠুক করে এসে আব্বার পাশে বসলেন। কোন কথা বললেন না। মা টেবিলে নাস্তা রাখলেন। নাস্তা ঠান্ডা হতে থাকল। অনেকক্ষণ কাউকেই ডাকলেন না মা। তারপর যেন খেয়াল হলো তার। : নাস্তা খেয়ে নে, আম্মা খান, তুমিও আসো। ধীরে ধীরে উঠল আপু-ভাইয়া। আব্বা উঠলেন না। দাদিও না। আপু ভাইয়া আস্তে আস্তে রুটি ছিঁড়তে লাগল। তারপর মুখে পুরল। যেন চিবাতে কত কষ্ট হচ্ছে । একটা করে রুটি খেয়ে উঠে পড়ল। অন্যদিন হলে মা বকে একসা করতেন। জোর করে আর একটা করে রুটি আর খানিকটা সবজি খাওয়াতেন। আজ মা কিছুই বললেন না। স্বর্ণা আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠল। মা আজ ওকে নিজে হাতে মুখ ধোওয়ালেন না বা হাত মুখ ধোয়ার তাড়াও দিলেন না। ওর খুবই ক্ষুধা পেয়েছে। কেউ ওকে খেতেও ডাকল না। কান্না পেলো ওর। ওর কথা কি সবাই ভুলে গেছে। ভাবল, আজ আর উঠবে না। না খেয়েই থাকবে। কিন্তু পারল না। জোর ক্ষুধা লেগেছে। ও উঠল। হাত মুখ ধুয়ে টেবিলের দিকে গেল। এতক্ষণে মার খেয়াল হলো। : তুই উঠলি কখন? আমি খেয়াল করিনি : তুমি তো আমাকে খেয়ালই করো না। আধো বোলে বলল স্বর্ণা। অন্যদিন হলে মা হাসতেন, হয়ত কিছু বলতেন। স্বর্ণাকে আদরও করতেন। আজ ওসব কিছুই করলেন না। ওকে ধরে টেবিলে তুলে দিলেন। ও নাস্তা করে বাইরের ঘরে এসে বসল। আব্বা আর দাদিও এসে বসলেন বাইরের ঘরে। আব্বা কেন উঠছেন না, অফিসে যাবেন না, আপু ভাইয়াও তো স্কুলের ড্রেস পরেনি। ওরা স্কুলে যাবে না? : আব্বা অফিস যাবে না? : না মা, আজ ছুটি : কেন? : আজ জাতীয় শোকদিবস : শোক দিবস কি ? আব্বা কথা বললেন না। স্বর্ণা একে একে সবার দিকে তাকালো। সবার মুখ যেন আরো গম্ভীর , আরও করুণ হলো। এবার লাঠি ঠুকে ঠুকে দাদি এসে স্বর্ণার পাশে বসলেন। সবার দিকে চেয়ে বললেন, : ও জানতে চাচ্ছে, বলছ না কেন? : তবু সবাই চুপ এবার দাদিই শুরু করলেন, ‘এদেশে শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন মহৎ মানুষ ছিলেন। তাঁর ডাকনাম খোকা। তিনি এদেশের নেতা। তাঁকে বলা হয় ‘জাতির পিতা’। তিনি আমাদের সবার পিতা। তাঁর আরেক নাম ‘বঙ্গবন্ধু ।’ তিনি ধনী দরিদ্র ফকির বাদশা সবার বন্ধু ছিলেন । তাই তিনি বঙ্গবন্ধু, বাংলার বন্ধু। : তিনি কোথায় ? তাকে দেখব : দেখাবো । আগে শোন । এদেশ এক সময় দখল করে রেখেছিল পাকিস্তানীরা। হাজার মাইল দূরে তারা থাকে। কিন্তু তারাই আমাদের শাসন করত । আমাদের ফসল তারা লুটে নিত। আমাদের ছেলেদের খারাপ চাকরি দিয়ে তারা ভাল চাকরি নিত। আমাদের টাকায় তারা পশ্চিম পাকিস্তানে কারখানা বানাতো, প্রাসাদ বানাতো, আর খবরদারি করত। তারা বলত, বাংলা এদেশের রাষ্ট্রভাষা হবে না, হবে ওদের ভাষা উর্দু। : কেন কেন? ওরা তো ভারি খারাপ লোক। বাংলা কত সুন্দর ভাষা! : হ্যাঁ তাই। তা আমাদের ছেলেরা রেগে গেল। তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইল । অনেক আন্দোলন হলো । অনেক সোনার ছেলে শহীদ হলো। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে ভেসে গেল। তারপর অনেক অন্দোলনের পর শুরু হল স্বাধীনতা যুদ্ধ। তুমি কি সে যুদ্ধের কথা কখনও শুনেছ? সে যুদ্ধের নেতা কে ছিল জান? খোকা, শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু। : হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি। আব্বা একদিন আমাকে যুদ্ধের গল্প বলেছে । নয় মাস যুদ্ধ হয়েছিল। আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। : সেটা হল ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন । যুদ্ধ শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো পাকিস্তানে। মরণপণ লড়াইয়ের পর দেশ স্বাধীন হল। তারপর অনেক দুঃখ যন্ত্রণা সয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন ১৯৭২ সালে। দেশে ফিরেই দেশ গঠনে মন দিলেন তিনি। দিন রাত পরিশ্রম করেছেন দেশটাকে সুন্দর করার জন্য। এর মধ্যে ৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হলো। একের পর এক বিপদ। তিনি দমলেন না। এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি তিনি ফোটাবেনই । সেদিন ছিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। আজ সেই দিন, ১৫ আগস্ট। সেদিন সকালে একদল লোক তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করল। তিনি বিশ্বাস করেননি তাঁকে কেউ মারতে পারে। তিনি নেমে এসেছিলেন নির্ভয়ে। সিঁড়ির ওপরে গুলি করে মারল তাঁকে ষড়যন্ত্রকারীরা। তাঁকে মেরেই ওরা থামলো না। একের পর এক মারল তাঁর স্ত্রী তিন পুত্র, পুত্রবধূ, আত্মীয় পরিজনদের। শিশু রাসেলকে পর্যন্ত তারা রেহাই দিলো না। শুধু বিদেশে থাকায় বেঁচে গেলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা। আজ সেই দিন। সেই পিতা হারানোর দিন, মাতা হারানোর দিন, ভাই হারানোর দিন, বন্ধু হারানোর দিন। আজ আমাদের শোকের দিন। শোকদিবস। তাই তো স্কুল কলেজ অফিস সব আজ বন্ধ। তাই সবাই কাঁদছে। বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন দাদি। স্বর্ণা তাকিয়ে দেখল সবার চোখে জল। দাদি উঠলেন। বললেন, : বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চেয়েছিলে, চলো দেখাই- বঙ্গবন্ধুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্ণা। ওর চোখ থেকে গড়িয়ে নামা জল মুছলো না ও, পড়তে দিল।
×