ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাল থেকে ঢাকায় পরের সপ্তাহে সারাদেশে

নির্ধারিত দামে চামড়া কেনাবেচা হবে

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ১৬ আগস্ট ২০১৯

নির্ধারিত দামে চামড়া কেনাবেচা হবে

এম শাহজাহান ॥ অবশেষে সরকার নির্ধারিত দামে কোরবানির কাঁচা চামড়া কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। আগামীকাল শনিবার থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত শুধু ঢাকার চামড়া কিনবে পোস্তার পাইকারি ব্যবসায়ী, আড়তদার ও সাভারের ট্যানারি মালিকরা। পরবর্তী সপ্তাহ থেকে ঢাকার বাইরের চামড়াগুলো বেচাকেনা হবে। ঢাকায় সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বেচা হয় কি না- তা যাচাইয়ে বাজার মনিটরিং করা হবে। মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারী সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন চায় পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তমালিকরা। অন্যদিকে ট্যানারি শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকারী সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। নির্ধারিত দাম কার্যকর হলে বড় আকারের একটি গরুর চামড়া দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারী সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তমালিকরা। তাদের মতে, সরকারী সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সরাসরি লবণ মিশ্রিত চামড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভালদামে রফতানি করা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয় কাঁচা চামড়া সংগ্রহে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এতে করে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। গরুর ভাল দাম পাবেন খামার মালিকরা। চামড়ার দাম বাড়লে মাংসের দামও কমবে। ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায্যদামে গরুর মাংস কিনতে পারবেন। এ কারণে কাঁচা চামড়া রফতানির একটি স্থায়ী রূপরেখা তৈরি ও নীতিমালা করা প্রয়োজন। এ ধরনের একটি নীতিমালা হলে চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ হবে। ট্যানারিগুলোও ভাল চলবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, কোন ব্যবসায়ই খয়রাতি বা দানখয়রাতের উপর ভর করে চলতে পারে না। ট্যানারি মালিকরা কোরবানির চামড়া নামমাত্র মূল্যে কিনে তা উচ্চমূল্যে বিদেশে রফতানি করছেন। এই দাম বছরের অন্যান্য সময় বহাল রাখছে ট্যানারি মালিকরা। ফলে গুটিকয়েক উদ্যোক্তা লাভবান হলেও ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ খামারিরা। কোরবানির সময় এতিম, মিসকিন ও গরিব মানুষ তাদের ন্যায্য হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ বছর লাখ লাখ পিস চামড়া নষ্ট হয়ে গেল শুধু ট্যানারি মালিকদের খামখেয়ালির কারণে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ টিপু সুলতান জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনবেন পাইকারি ও আড়তদাররা। কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারী সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি বলেন, সরকার এই ঘোষণা আগে দিলে একপিস চামড়া কোথাও নষ্ট হয় না। সবাই নিজ নিজ এলাকায় চামড়া মজুদ করে রফতানির সুযোগ নিত। তিনি বলেন, দাম না পেয়ে হতাশা থেকে চামড়া ফেলে দেয়া হয়েছে। অথচ এটি জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। তিনি বলেন, কাল শনিবার থেকে পাইকারি ও আড়তদার ব্যবসায়ীরা ঢাকার চামড়াগুলো খরিদ করা শুরু করবেন। এক সপ্তাহ পরই ঢাকার বাইরের চামড়া সংগ্রহ করবেন ব্যবসায়ীরা। তিনি জানান, ট্যানারি মালিকরা কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার দাবি করেছে। কোনভাবেই তাদের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। কাঁচা চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই তা রফতানির সুযোগ দিতে হবে। উল্লেখ্য, এবার ঢাকায় প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫-৫০ এবং ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হবে। এছাড়া সারাদেশে প্রতিবর্গফুট খাসির চামড়া ১৮-২০ এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় বেচাকেনার ঘোষণা দেয়া দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিশ্বের কোন দেশে এত কমদামে আর চামড়া বিক্রি হয় না। কিন্তু এই কমদামও এবার কার্যকর করেনি এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটি কোটি টাকার চামড়া নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দাম না পেয়ে চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। এমনকি ডাস্টবিন ও ময়লার ভাগারে চামড়া ফেলে দেয়াসহ ও মাটিতে পুঁতে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে। অথচ কাঁচা চামড়ার কদর রয়েছে বিশ্বের প্রায় সবদেশে। এদিকে, সরকার নির্ধারিত দামে আগামীকাল শনিবার থেকে সাভার শিল্পনগরীর ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের অনুরোধে এবার দ্রুত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। সংগঠনটির সভাপতি মোঃ শাহিন আহমেদ জানিয়েছেন, সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কেনা হবে। এ কারণে কাঁচা চামড়া রফতানির বিষয়টি সরকারের পুনঃবিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে যাতে ট্যানারিগুলো বন্ধ না হয়ে যায় সেদিকেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছে ট্যানারি মালিকরা। সরকার দ্রুত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। জানা গেছে, সারাদেশে এ বছর প্রায় সোয়া কোটি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। মৎস্য, পশু ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সারাদেশে এ বছর কোরবানি হবে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ গবাদিপশু। এর মধ্যে ৪৫-৫০ লাখ গরু, বাকি ৬৫-৭০ ছাগল, বকরি ও ভেড়া কোরবানি হবে বলে জানানো হয়। তবে দেশীয় পশুর বাইরেও এবার স্বল্প পরিমাণ গবাদিপশু মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল ও ভারত থেকে এসেছে। সবমিলিয়ে রেকর্ড সংখ্যক কোরবানি হয়েছে এ বছর। অর্থাৎ গত কয়েক বছরে চামড়ার উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে দেশে। যদিও ট্যানারিগুলো বলছে, কোরবানির সব চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সক্ষমতা রয়েছে তাদের। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছে, কোরবানির বাইরে সারাবছরে আরও প্রায় সোয়া কোটি গবাদিপশুর চামড়া আসে ট্যানারিগুলোতে। অর্থাৎ আড়াই কোটি পিস চামড়ার বাজার রয়েছে দেশে। এসব চামড়া ১৫৫টি ট্যানারিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারী সংস্থা বিসিক বলছে, এখন পর্যন্ত পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে রয়েছে ১২৩টি ট্যানারি। তবে বিটিএ বলছে, উৎপাদনে থাকা ট্যানারির সংখ্যা আরও কম। এই বাস্তবতায় উৎপাদিত সব চামড়া ট্যানারিগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে পারছে কি না তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। ইতোমধ্যে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় দেশের উত্তরবঙ্গসহ চট্টগ্রামে আরও দুটি ট্যানারি শিল্পনগরী করার পরিকল্পনা করছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহ রয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে, ট্যানারিগুলোর সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে কাঁচা চামড়া রফতানির বিষয়টি দ্রুত কার্যকর করা উচিত বলে মনে করছে এ শিল্পের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, দেশে গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চামড়ার দাম কমে যাওয়া। অথচ চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত হলে গরুর মাংসের দামও কমে আসবে বলে মনে করেন সংগঠনটির মহাসচিব মোঃ রবিউল আলম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, যেকোন মূল্যে চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে হবে। চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কারণে মাংস ব্যবসায়ীদের বেশি দামে মাংস বিক্রি করতে হচ্ছে। খামার মালিকরা লোকসান গুনছেন। অথচ চামড়ার সঠিক দাম পাওয়া গেলে এসব সমস্যার সমাধান হয়।
×