ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বার্ষিক সভার অজুহাতে আটকে আছে

দীর্ঘদিনেও বঙ্গবন্ধুর তিন খুনীর শেয়ার বাজেয়াফত হয়নি

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ১৬ আগস্ট ২০১৯

দীর্ঘদিনেও বঙ্গবন্ধুর তিন খুনীর শেয়ার বাজেয়াফত হয়নি

রহিম শেখ ॥ দীর্ঘদিনেও ফয়সালা হয়নি কুষ্টিয়ার জুবিলী ব্যাংকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীদের শেয়ার বাজেয়াফতের কার্যক্রম। বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) না হওয়ার অজুহাতে আটকে আছে এ প্রক্রিয়া। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী কর্নেল (অব) ফারুক রহমান এবং কর্নেল (অব) কেএম রশীদের নামে এখনও জুবিলী ব্যাংকে ৮৫ হাজার শেয়ার আছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী মেজর (অব) বজলুল হুদারও শেয়ার রয়েছে ব্যাংকটিতে। এগুলো বাজেয়াফত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ব্যাংকটিতে বিভিন্ন সময়ে কাদের মালিকানা ছিল, পরিচালনা পর্ষদে কারা ছিল, খুনীদের শেয়ারের কী অবস্থা এসব জানানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য দিয়ে অবগত করেছে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতর, আরজেএসসি। চিঠিতে আরজেএসি জানায়, ইতোমধ্যে হালনাগাদকৃত শেয়ারহোল্ডার তালিকায় বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী কর্নেল (অব) ফারুক রহমান এবং কর্নেল (অব) কেএম রশীদের মোট ৮৫ হাজার শেয়ার বাজেয়াফতের প্রক্রিয়াধীন দেখিয়েছে জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড। ফলে ওই শেয়ার বাজেয়াফতের আগে কারও নামে হস্তান্তর করা যাবে না। হাইকোর্টের আদেশের পর বাজেয়াফত করা হলে সরকারের ওপর ন্যস্ত হবে। চিঠিতে বলা হয়, শেয়ার হোল্ডারদের হালনাগাদ তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোর পর এখন হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এজিএম অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং জুবিলী ব্যাংকের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান মোঃ শাহ আলমকে সহযোগিতা করছে আরজেএসসি। সূত্র জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) ১৯৯০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জুবিলী ব্যাংকের বার্ষিক মূলধন বিবরণী যাচাই করে। তারা জেনেছে, ব্যাংকটিতে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী মেজর (অব) বজলুল হুদারও শেয়ার রয়েছে। আরজেএসসির নিবন্ধক মোঃ আতিকুর রহমান ওই যাচাই প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালের বার্ষিক মূলধনের বিপরীতে মেজর (অব) বজলুল হুদাকে জুবিলী ব্যাংকের পরিচালক দেখানো হয়। কিন্তু সে সময় তার কী পরিমাণ শেয়ার ছিল তার উল্লেখ নেই। কর্নেল (অব) ফারুক ও কর্নেল (অব) আব্দুর রশিদের নামে কী পরিমাণ শেয়ার ছিল, তার তথ্যও আরজেএসসিতে জমা দেয়া হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯২ সালের বিবরণীতে পরিচালকের তালিকায় বজলুল হুদার নাম নেই। এরপর পরিচালকের তালিকায় ঘন ঘন পরিবর্তন এসেছে। ১৯১৩ সালের ১৫ এপ্রিল ‘খোকসা জানিপুর জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড’ নামে কোম্পানি হিসেবে আরজেএসজিতে নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধন নম্বর : সি-২৩৭৩। ১৯৮৭ সালের ২৬ জানুয়ারি নাম পরিবর্তন করে ‘জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড’ করা হয়। নিবন্ধনের পর থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এটির হিসাব আরজেএসসির রেকর্ডপত্রে নেই। ১৯৯০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হিসাব আরজেএসসিতে দাখিল করা হয়। প্রথমে স্বর্ণবন্ধকী ব্যবসা পরিচালনার সীমাবদ্ধতা রেখে মাত্র একটি শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স পায়। পরবর্তী সময় স্বর্ণ বন্ধকের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কুটির শিল্প ও চাষীদের সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয় ব্যাংকটিকে। এটি দেশের অ-তফসিলি পাঁচটি ব্যাংকের একটি। আরজেএসসির প্যানেল আইনজীবী বলছে, এজিএম সম্পন্ন হলে হাইকোর্টে এফিডেভিট অব কপ্লায়েন্স দাখিল করে বাজেয়াফতির প্রাপ্ত সংবলিত দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। শেয়ার বাজেয়াফত করতে উচ্চ আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। আরজেএসসির তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর তিন খুনীর জুবিলী ব্যাংকের মালিকানার তথ্য দীর্ঘদিন গোপন করে জুবিলী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে সাজা ঘোষণার পাশাপাশি খুনীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফত করার নির্দেশ দেন আদালত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জুবিলী ব্যাংকে থাকা দুই খুনীর শেয়ার বাজেয়াফত করার জন্য ২০১৬ সালের ২৯ জুন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত না থাকায় বাজেয়াফত করার বিষয়ে অপারগতা জানিয়ে ওই বছরেরই ২৬ জুলাই মন্ত্রণালয়কে ফিরতি চিঠি দেয় বিএসইসি। জুবিলী ব্যাংক দেশের কোন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত নয়। ফলে ওইসব শেয়ার বাজেয়াফত করার সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দেয় বিএসইসি। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের শেয়ার থাকাসহ বিভিন্ন কারণে জটিলতায় থাকা কুষ্টিয়ার জুবিলী ব্যাংক গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আদালতের নির্দেশনার আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোঃ শাহ আলমকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান করা হয়। নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিয়ে দ্রুততম সময়ে ব্যাংকটির স্থগিত থাকা সব এজিএম করারও কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। জানা গেছে, মালিকানার দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরে জুবিলী ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ২০১২ সালে এজিএম করা নিয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা করেন ব্যাংকটির পরিচালক মোঃ শহীদুল্লাহ। জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ২৩ জানুয়ারি জুবিলী ব্যাংকের দাখিল করা ১৯৯০ সালের বার্ষিক মূলধন বিবরণী অনুযায়ী, এর অনুমোদিত মূলধন ১০ কোটি টাকা, যা ২৫ টাকার মোট ৪০ লাখ শেয়ারে বিভক্ত। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর দুই খুনী কর্নেল (অব) ফারুক ও কর্নেল (অব) আব্দুর রশিদ পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত ছিল। ১৯৯২ সালের বার্ষিক মূলধন বিবরণী অনুযায়ী, ১০ কোটি টাকা মূলধনের ৪০ লাখ শেয়ারের (প্রতিটি ২৫ টাকার) মালিকানা ছিল ১৬৫ জনের। ১৯৯৫ সালের হিসাবে দেখানো হয়েছে, অনুমোদিত মূলধন আট কোটি টাকা, যা ৩২ লাখ শেয়ারে (প্রতিটি ২৫ টাকার) বিভক্ত। শেয়ারধারীর সংখ্যা দেখানো হয় ১৬৯ জন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের বিবরণীতে শেয়ারের সংখ্যা অপরিবর্তিত। মালিকানা ১৮১ জনের। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকটিতে থাকা বঙ্গবন্ধুর তিন খুনীর শেয়ার বাজেয়াফত করার উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধককেও (আরজেএসসি) এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া হয়।
×