ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড

ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল ইনডেমনিটি সংস্কৃতি লালনকারীরা

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ১৬ আগস্ট ২০১৯

ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল ইনডেমনিটি সংস্কৃতি লালনকারীরা

মোরসালিন মিজান ॥ অন্যায় হবে। বিচার হবে না। আইন সুরক্ষা দেবে খুনীদের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর বিচারের পথ রুদ্ধ করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বা এ্যাক্ট নামে এই কালাকানুনের জন্ম দেয়া হয়েছিল। সামরিক স্বৈরশাসক, প্রধান বিচারপতি, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এক প্রধানমন্ত্রীসহ বেনিফিসিয়ারিরা এই বর্বর আইন সযতেœ সংরক্ষণ করেন। এভাবে দীর্ঘ ২১ বছর যারা দায়মুক্তির ঘৃণ্য সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তারা রয়ে গেছেন বিচারের উর্ধে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ও সংরক্ষণে প্রকাশ্যে বা গোপনে কার কী ধরনের ভূমিকা ছিল তা বিস্তারিত প্রকাশ করার দাবি উঠেছে আজ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নারী শিশুর রক্তে ভেসে যায় ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়ি। নীতিভ্রষ্ট উছৃঙ্খল ও দেশদ্রোহী কয়েক সেনা কর্মকর্তা বর্বর হত্যাকা-ে নেতৃত্ব দেয়। ওইদিনই খুনীদের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রপতি হন খন্দকার মোশতাক। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে শপথ নেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি। ক্ষমতা গ্রহণের পর তার প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষা করা। সেই মতে ২৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বলে ‘দি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করেন তিনি। এতে খন্দকার মোশতাক নিজে স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষর করেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানও। অধ্যাদেশটি ভাল করে পাঠ করে দেখা যায়, অত্যন্ত সুচতুর ভাষায় এটি লেখা হয়েছে। এর কোথাও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বা পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। কোন হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে প্রথম অংশে লেখা হয়েছে: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবত আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রীমকোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়া গ্রহণ করা যাবে না। দ্বিতীয় অংশে লেখা হয়েছে: রাষ্ট্রপতি উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ বিরাট অন্যায় হবে। কিন্তু বিচার করা যাবে না। এমন নির্মম নিষ্ঠুর এবং অপরিণামদর্শী অবস্থান কোন রাষ্ট্র নিতে পারে না। মোশতাক তা-ই করেন। অবৈধ রাষ্ট্রপতির দেয়া কলঙ্ক গায়ে মাখতে হয় বাংলাদেশকে। এত কিছুর পরও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন মোশতাক। যাদের বুট চেটে মসনদে বসেছিলেন, সেই পেছনের শক্তি কাজ শেষে টিস্যু পেপারের মতো ছুড়ে ফেলে তাকে। কিন্তু রয়ে যায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ওই সময়ের ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, অন্যায় অধ্যাদেশ বহাল রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন বিচারপতিরাও। এমনকি ভিন্ন ভিন্ন দু’টি সময়ে দুই দুইজন প্রধান বিচারপতি বিচারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। তাদের একজন আবু সাদাত মোঃ সায়েম। সুপ্রীমকোর্টের এই প্রধান বিচারপতি ৬ নবেম্বর নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। পরবর্তীতে তার লেখা বইয়ে বক্তৃতাটি উদ্ধৃত করা হয়। সেখানে প্রথমবারের মতো হত্যাকা- ও খুনীদের কথা উল্লেখ করলেও বিচার এড়িয়ে যাওয়ার আভাস দেন তিনি। বক্তৃতায় সায়েম বলেন, ‘গত ১৫ আগস্ট কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকুরিরত সামরিক অফিসার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার-পরিজনকে হত্যা করে...।’ পরবর্তী সময়েও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের কোন উদ্যোগ তিনি নেননি। এই ধারাবাহিকতায় দৃশ্যপটে আসেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ে সমর্থন দেয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আগেই ছিল। এবার অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করে অভিযোগের সত্যতাই যেন প্রমাণ করেন তিনি। এর আগে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে জিয়া নিজে রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রহসনের নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়। সংসদে প্রবেশ করেই জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক আইনের আওতায় আরও যত অধ্যাদেশ, যত ঘোষণা সবগুলোকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনী বৈধতা দেয়া হয়। ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’ পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। জানা যায়, দায়মুক্তি লাভ করে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা হত্যকা-ের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে থাকে এবং এক ধরনের বাহবা নেয়ার চেষ্টা করে। দেশের ভেতর বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু করে তারা। এভাবে জাতির জনকের খুনীদের, নারী ও শিশু হত্যাকারীদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেন জিয়া। অন্যায় করলে, খুন করলে, বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না- ভয়ঙ্কর এই বার্তাটিও সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অথচ একই সময় জিয়া নিজে সেনা কর্মকর্তাদের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত দেখিয়ে সামরিক আইনে ফাঁসি দিতে থাকেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তারও। দায়মুক্তির যে সংস্কৃতিকে জিয়া উৎসাহিত করেছিলেন সেই সংস্কৃতির শিকার হন তিনি নিজেও। ১৯৮১ সালের ৩০ মে অন্য একটি সেনাদলের হাতে নিহত হন তিনি। ওইদিনই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান উপ-রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার। তিনিও সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময়ের মধ্যে জিয়া হত্যার বিচার চললেও, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কোন উদ্যোগ তিনি নেননি। সামরিক স্বৈর শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় নয় বছর। তিনিও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারে লক্ষ্যে আইনটি বাতিল করেননি। জানা যায়, তার সময় আত্মস্বীকৃত খুনী শাহরিয়ার রশিদ ও বজলুল হুদা দেশে ফিরে আসেন। তাদের আসতে দেয়া হয়। তারা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনীতি শুরু করেন। পরে বজলুল হুদা ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেন। পরে ১৯৮৫ সালে লে. কর্নেল ফারুক ও লে. কর্নেল রশিদ ঢাকায় এসে ‘১৫ আগস্ট বিপ্লবের আদর্শ বাস্তবায়ন’ সংগঠনের নামে রাজনৈতিক কর্মকা- শুরু করেন। এরশাদের সময় ১৯৮৮ সালে ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদে প্রবেশ করেন বজলুল হুদা। এভাবে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা সামরিক সরকারগুলো ইনডেমনিটি জারি রাখেন। ১৯৯১ সালে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। কিন্তু জিয়াউর রহমান পতœীও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। উল্টো মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতাকারী জামায়াত শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতা পোক্ত করার দিকে দৃষ্টি ছিল তার। এ অবস্থায় জনগণের শক্তিতেই ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ওই বছরের ১২ নবেম্বর ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল এ্যাক্ট-১৯৯৬’ সংসদে পাস হয়। এরই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের সকল বাধা দূর হয়। কিন্তু কালাকানুনটি যারা করেছিলেন, যারা ২১ বছর ধরে এটিকে সংরক্ষণ করেছিলেন তাদের কাউকে কোনদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ও বহাল রাখার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে বা গোপনে কার কী ভূমিকা ছিল বিস্তারিতভাবে জানা যায়নি আজও। এ প্রসঙ্গে নিজের হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের মতো বর্বর আইন আর হতে পারে না। এর মাধ্যমে জাতির জনকের খুনীদের রক্ষার চেষ্টা হয়নি শুধু, খুন সংবিধান লঙ্ঘন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের মতো বহু অন্যায়কে প্রশয় দেয়া হয়েছে। সমাজে রাষ্ট্রে এর যে প্রভাব পড়েছিল আজও তা থেকে মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ। এত বড় ক্ষতি যারা করেছে তাদের সকলের নাম প্রকাশ ও বিচারের মুখোমুখি করা ইতিহাসের আরেক দায় বলে মন্তব্য করেন তিনি। ইনডেমনিটি বাতিলের ঐতিহাসিক বিল সংসদে উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে কোনকালে এমন কালো আইন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অথচ জাতির দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে এটি বলবত ছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনীরা হত্যাকা-ে অংশ নেয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে। এরপরও তাদের বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা হয়নি। বরং বাঁচানোর সব চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ শাসকরা তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি ব্যবহার করেছে। সরকার ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এত বড় অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া এবং সংবিধান পরিপন্থী কর্মকা-ের জন্য ওই সমস্ত শাসক ও নেপথ্যের ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা যেতে পারে। আগামীদিনের বাংলাদেশের সুরক্ষার প্রয়োজনে অভিযুক্তদের এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান তিনি।
×