ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

হাওড়ের নাম নিকলী

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১৬ আগস্ট ২০১৯

হাওড়ের নাম নিকলী

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। হুট করেই মাথায় চেপে বসল ঘোরার নেশা। মেসেঞ্জারে নক করলাম আরেক ভ্রমণপাগলা হানিফকে। শুরুতে নিছক মজা করছি, এ রকমটাই ভাবল। কিন্তু যখন ওর ইজ্জতে আঘাত করে লিখলাম, বাপের বেটা হলে এখনি বাইক নিয়ে চলে আয়। সে আর সহ্য করতে না পেরে ঠিকই চলে এলো। এরপরেও ও ভাবল, হয়ত আশপাশে ঘুরব। কিন্তু আমি তাকে সোজা নিকলীর পথে যেতে বললাম। এমনটা ও কল্পনা করতে পারেনি! শুধু জানালো তুমি যেতে পারলে, আমিও পারব। সাব্বাশ- এ রকম পাগলুদেরকে নিয়ে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ। আশুলিয়া বেড়িবাঁধ হয়ে মোটরবাইক চলছে। গভীর রাতেও মহাযানজট। গাজীপুর পৌঁছতেই বাসায় খবর হয়ে গেল। একেএকে পরিবারের সহ বংশের ছোট-বড় অনেকেই ফোন দিয়ে ফেরাতে চাইল। বাসায় কাউকে বলে যায়নি। এক কাপড়েই বের হয়ে গেছি। এতেই যত বিপত্তি। কারও ফোন কলই ফেরাতে পারল না। আমি ভ্রমণ নেশায় বিভোর! যদি ফিরে আসি তাহলে হানিফকে যা লিখে ঘর থেকে বের করেছি, এখন সে উল্টো তা আমাকেই ফিরিয়ে দেবে। না না, তা হতে পারে না। গুনগুন করে গান গাইতে ইচ্ছে হলো। আমায় ডেকোনা/ফেরানো যাবে না/ফেরারি পাখিরা/কুলোয় ফিরে না। গাজীপুর চৌরাস্তা পার হয়ে খাস্তা পরোটা আর ডিম ভাজা দিয়ে রাতের খাবারটা সেরে নিলাম। এসব হোটেলগুলো যেন আমাদের মতো ভ্রমণ উন্মাদদের জন্যই খোলা রাখে। খাওয়া-দাওয়া শেষে বাইক স্টার্ট। রাতের নীরবতা ভেদ করে মোটরবাইক চলছে। চকচকে পিচের প্রশস্ত ফাঁকা রাস্তা। একপশলা বৃষ্টি এসে আমাদের বাড়ি ফিরে যেতে বলল, কে শোনে কার কথা। ছুটছি অবিরাম। হৃদয় পুরের গন্তব্য বলে কথা। চলতে চলতে মহাসড়ক ছেড়ে, ডানে মোড় নিয়ে কাপাসিয়ার সড়ক ধরে চলছি। মধ্য রাত। নিকষ আধাঁর। দুপাশে ঘন শালবন। মাঝে সরু সড়ক। রাত গভীরে গা ছমছম করা সুনসান নিরিবিলি পথ। অন্যরকম একটা অনুভব। যেতে যেতে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর করা ফকির মজনু শাহ্ সেতু পার হয়ে মিয়ার বাজারে ব্রেক। রাত তখন প্রায় আড়াইটা। এক দোকানি এই রাত গভীরেও এ রকম গ্রাম্য জনপদে, তার চায়ের পসরা নিয়ে বসে আছে। চা, বিস্কুট, পান চিবুতে চিবুতে আবারও ছুটে চলা নিকলীর পথে। এপাশে রাতজাগা কুকুরগুলোর শান্ত বিচরণ। ঘেউ ঘেউ না করেই, ছুটে এসে আবার ফিরে যায়। প্রায় সুবহে সাদেকের সময় কিশোরগঞ্জের বিন্নাটির মোড়ে পৌঁছলাম। রাতজাগা দোকানিদের থেকে নিকলি যাবার সঠিক পথ জেনে আগাতে থাকি। অল্প সময়ের মধ্যেই পুলের ঘাট বাজারে পৌঁছলাম। ঠা-া পানি, বিস্কুট খেতে খেতে দোকানিদের সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। তারা এ রকম সময়ে না যাওয়ার জন্য যেমন বলছে আবার নিরাপত্তারও কোন সমস্যা নেই, সে বিষয়েও অভয় দিচ্ছে। মানে ফিপটি ফিপটি। ওদিকে ফজরের আজান ও জামাত হতে আরও অনেক দেরি। ঘরের কাছে এসে কার মনে চায়, অযথাই সড়কের পাশে সময় কাটাতে। সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আগাবে নাকি। তার সোজা উত্তর তোমার ইচ্ছে। ইচ্ছে যখন আমারই তখন চলো আল্লাহর নাম নিয়ে আগাই। যেতে যেতে ফজর আজান। পথের পাশের এক মসজিদে নামাজ আদায় করেই স্পিড রাইড। নতুন করে শখ জেগেছে, নিকলী গিয়ে সূর্যদোয় দেখব। চলার পথে সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে, মাঝে মধ্যেই থমকে যাই। গ্রাম-বাংলার অসাধারণ নয়নাভিরাম রূপ নিকলীর পথে পাশের গ্রামগুলোর ওপর ভর করেছে। ভোরের আলোয় চেনা-অচেনা পাখির কলতান সঙ্গী করে বাইক চলে মন্থর গতিতে। পথের প্রেমে পড়ে সূর্যদোয়ের কথা ভুলেই যাই। নিকলী বেড়িবাঁধে যখন ঢুকি তখন মনে হলো, এ যেন প্রকৃতির স্বপ্নপুরী! এখানে আমরা হলাম উদ্ভটের মতো অনাহুত আগন্তুক। উপজেলা পরিষদের ভবন পেছনে ফেলে আরও এগিয়ে যাই। একেবারে বেড়িবাঁধের শেষ অবদি। যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। সে এক অপরূপ দৃশ্য। হাওড়ের নাম নিকলী। কিশোরগঞ্জ জেলার অন্যতম নয়নাভিরাম হাওড়। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ ভাললাগার। নিকলী বেড়িবাঁধ, হাওড়ের নান্দনিকতা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জেলেদের মাছধরার কর্মযজ্ঞ। ভ্রমণপিপাসুরা ইচ্ছে করলে, ছৈতোলা নৌকায় ভেসে বেড়াতে পারবেন। যাওয়া যাবে অথৈ পানির মাঝে ছোট্ট দ্বীপের মতো জেগে থাকা গ্রামগুলোতে। হাওড়ের সূর্যদোয়-সূর্যাস্তর মনোরম দৃশ্য, সাগর তীর থেকে দেখতে পাওয়া হতে কম নয়। হিজল, করচ গাছগুলো টইটুম্বুর পানির বুকে মাথা উঁচু করে জানান দেয়, শত প্রতিকূলতার মাঝেও কিভাবে টিকে থাকতে হয়। ভ্রমণ শুধু বিনোদনই নয়, শিক্ষা লাভেরও অন্যতম মাধ্যম। দেখা হয় পাট হতে আঁশ তোলা শ্রমজীবী মানুষের কায়িক পরিশ্রম। তবুও তাদের চোখেমুখে সুখের হাসি। আসলেই সুখী হতে হলে জীবনে প্রাচুর্যতার চাইতে, সুন্দর একটি মনই যথেষ্ট। ভ্রমণকালীন আমি প্রকৃতির রূপ-লাবণ্য উপভোগ করার পাশাপাশি, স্থানীয় মানুষের যাপিতজীবন সম্পর্কেও ধরণা নিতে পছন্দ করি। ঘুরতে ঘুরতে চোখ আটকাল এক ঝুপড়ি দোকানে। কাছে যেতেই দেখি ধোঁয়া তোলা চিতই পিঠা আর নানা ভর্তা। আহ্ না খেয়ে আর পারলাম না। সাত-সকালের নাশতার পর্বটা তরুণী সুরমার হাতে বানানো পিঠা দিয়েই সেরে নিলাম। এবার ফেরার পালা। তাহলে বন্ধুরা আর দেরি কেন। আপনারাও ঘুরে আসুন কিশোরগঞ্জ জেলার মোট ৯৭টি হাওড়ের মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধ ও দৃষ্টিনন্দন নিকলী হাওড় হতে। কিভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সরাসরি বাস ও ট্রেনে যাওয়া যাবে কিশোরগঞ্জ। কিশোরগঞ্জ সদর হতে সিএনজিতে নিকলী। সকাল সকাল রওনা দিলে, দিনে দিনে ঘুরে আসা যাবে। আর যারা মোটরবাইক চালাতে পারদর্শী, তাদের জন্য নিকলী ভ্রমণ হবে অনন্য। বাস-ট্রেন ছাড়ার সময়সূচী : মহাখালী ও সায়েদাবাদ টার্মিনাল হতে দিনে-রাতে বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছেড়ে যায়। কমলাপুর হতে সকাল ৬টা ৩০ মিনিট হতে ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত তিনটি ট্রেন ছেড়ে যায়। দুপুরেও ট্রেন আছে। তবে দিনে দিনে ফেরার জন্য সকালের ট্রেনে যাওয়াই ভাল।
×