ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আকতার বানু আলপনা

শিক্ষকদের কাছেও ছাত্রীরা নিরাপদ নয়

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ১৬ আগস্ট ২০১৯

শিক্ষকদের কাছেও ছাত্রীরা নিরাপদ নয়

কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন নির্যাতনসহ নানা অনৈতিক আচরণের অভিযোগ মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় ওঠে। অভিযুক্তদের মধ্যে খুব কম জনেরই যথার্থ শাস্তি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করা যায় না। তা ছাড়া কিছু প্রভাবশালী শিক্ষক নানা কূটকৌশল অবলম্বন করে এসব অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচানোর চেষ্টা করেন বা বাঁচিয়ে দেন। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন একটি ভয়াবহ অপরাধ। এই অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণ আছে। ১. শিক্ষকদের নৈতিকতাবোধের অভাব ও চারিত্রিক স্খলন : আগেকার দিনের শিক্ষকরা ছিলেন চরিত্রবান। তারা নিজেদের শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা সমতুল্য মনে করতেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ তেমন শোনাই যেত না। কিন্তু এখন শিক্ষকদের নৈতিকতাবোধের অবক্ষয় ও চারিত্রিক স্খলনের কারণে এ অপরাধের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ২. নির্যাতিত মেয়েদের প্রতিবাদ না করা : আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যে কোন যৌন অপরাধ ঘটার পর নির্যাতিত/নির্যাতিতা ও তার অভিভাবকরা অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার চেষ্টা করার পরিবর্তে নির্যাতনের বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে। তা ছাড়া বেশিরভাগ সময় অপরাধীরা শাস্তি পায় না দেখে নির্যাতিতরা অভিযোগ করতে চায় না। কখনও কখনও ছাত্রীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের আক্রোশের ভয়ে অভিযোগ করতে ভয় পায়। কেননা অভিযোগ করলে অভিযুক্ত শিক্ষক তাদের ফেল করিয়ে দেয়াসহ নানাভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে অভিভাবক, প্রশাসন, সহপাঠী বা বন্ধুদের সমর্থন ও সহযোগিতা না পাওয়ার কারণেও অপরাধীদের শাস্তি হয় না। ফলে অপরাধ ঘটতেই থাকে। বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা, বিচারের আর্থিক ব্যয় নির্বাহের অক্ষমতা, পুলিশী হয়রানির ভয়েও মেয়েরা অপরাধীদের শাস্তি দিতে আগ্রহী হয় না। অনেককে বলতে শুনি, মেয়েরাই নাকি ভাল ফলাফলের লোভে শিক্ষকদের নানাভাবে প্ররোচিত করে এবং শিক্ষকদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। তবে আমার মনে হয় না, কোন মেয়ে স্বেচ্ছায় কোন শিক্ষককে গিয়ে বলে, “আপনি আমাকে পাস করিয়ে দিন, বেশি নম্বর দিন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানিয়ে দিন। তার বিনিময়ে আমি আপনার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করব।’ তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, কিছু মেয়ে এমন বলবে। তা হলে প্রশ্ন দাঁড়ায়-’ শিক্ষক তা শুনবেন কেন?” আসলে প্রস্তাবটা আসে শিক্ষকের কাছ থেকেই। কোন ছাত্রীকে যখন কোন শিক্ষক কুপ্রস্তাব দেন, তখন মেয়েটির হাতে তার কোন প্রমাণ থাকে না। কারণ কোন অপরাধী প্রমাণ রেখে অপরাধ করে না। ফলে দুর্বল শিক্ষার্থীদের পক্ষে এসব ক্ষমতাবান শিক্ষকদের অপকর্ম প্রমাণ ও প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে যায়। ৩. অপরাধীদের শাস্তি না হওয়া বা হওয়ার সম্ভাবনা কম হওয়া : এসব শিক্ষক প্রভাবশালী হয় এবং প্রশাসনের খুব কাছের লোক হয়। ফলে অপরাধ করেও শাস্তি পায় না বলে তারা আরও অপরাধ করার স্পর্ধা ও সুযোগ পেয়ে যায় এবং বীরদর্পে সারাজীবন একের পর এক অপরাধ করে চলে। এসব অপরাধীদের অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে দেখে অন্যরাও অপরাধ করতে উৎসাহিত বোধ করে। আরও মানুষ অপরাধ করে। এভাবে সমাজ, দেশ কলুষিত হয়। ৪. মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব : মেয়েদের প্রতি হীনমানসিকতা ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাবের কারণে এসব শিক্ষক মেয়েদের সঙ্গে নোংরামি করে। ৫. সম্মিলিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ না করা : আমাদের দেশে অপরাধের লাগামহীন বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হলো- প্রতিবাদ ও সম্মিলিত প্রতিরোধ না করা। এসব অপরাধের প্রতিবাদ করার পর মেয়েটার পাশে আর কাউকে পাওয়া যায় না। দু’চার দিন সমবেদনা জানানোর জন্য কেউ কেউ আসে। তারপর ভোগান্তি একা মেয়ের ও মেয়ের পরিবারের। আমরা এখনও এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি, যেখানে নির্ভয়ে প্রতিবাদ করা যায় এবং ন্যায় বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সম্মিলিত প্রতিরোধ চলতে থাকে। ৬. আইনের শাসনের অভাব : সত্যিকারের আইনের শাসনের কঠোর প্রয়োগের অভাব ও বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা এসব অপরাধের বিস্তৃৃতির জন্য দায়ী। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। ১. যৌন নির্যাতনের প্রতি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবেঃ আমাদের এ উপমহাদেশে পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক - ইত্যাদি সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি নানা রকম নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিকভাবে হেয় হবার ভয় নারীকে মানসিকভাবে ছোট ও দূর্বল ভাবতে শেখায়। এমনিতেই আমাদের দেশের মেয়েদের ভাল বিয়ে হওয়া সহজ নয়। তার উপর মেয়েরা ধর্ষিত বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তো আরোই সমস্যা। কারণ মেয়েটিকেই সবাই অস্পৃশ্য মনে করবে, তার ভাল বিয়ে হবে না, তার পরিবারের বদনাম হবে। এ জন্যই যৌন অপরাধ ঘটলে তা গোপন করা হয়। অথচ পুরুষ ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি করলে, পতিতালয়ে গেলে, পরকীয়া করলে, প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করলেও তার বদনাম হয় না। তাকে কেউ খারাপ বলে না। দিব্বি আবার বিয়ে করতে পারে, তার মান এতটুকু কমে না। কিন্তু মেয়েরা সমাজের চোখে একবার ভ্রষ্টা খেতাব পেলে তার বেঁচে থাকা দায় হয়ে যায়। একটি মেয়ের সম্ভ্রম চলে যাওয়া মানে সমাজে সে অপাঙ্ক্তেয়। পচে যাওয়া খাবারের মতো, যা কেউ খেতে চায় না। তাই নিজেদের সম্মান, পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার ভয়ে, তথা সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যৌন অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার চেষ্টা করে না। অনেক উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত পরিবারের মানুষও মামলা করে না লোক জানাজানি হওয়ার ভয়ে, বিচারের নানা হয়রানি সহ্য না করার ইচ্ছায় এবং মেয়েটির ভবিষ্যত চিন্তা করে। এই রায়ে বলা আছে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে ‘অভিযোগ কমিটি’ গঠন করতে হবে (যে কমিটি হবে ন্যূনতম ৫ সদস্য বিশিষ্ট যার অধিকাংশ সদস্য হবেন নারী) যে কমিটি রায়ের নীতিমালা অনুযায়ী তাদের কাছে আসা যৌন নির্যাতনের অভিযোগের ভিত্তিতে এসব অপরাধের তদন্ত করে শাস্তির সুপারিশ করবে। কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকরাই সেইসব অপরাধীর পক্ষ নিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেন বা বাধাগ্রস্ত করেন, অভিযুক্তকে হুমকি দেন, ভয় দেখান। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির সুপারিশ দিনের পর দিন (এমন কি এক বছর পর্যন্ত) পড়ে থাকে, সিন্ডিকেটে তা উত্থাপন করা হয় না। কখনও তড়িঘড়ি করে অভিযুক্তকে অবসরে পাঠানো হয় যাতে তার শাস্তি হতে না পারে। কখনও কখনও প্রশাসন সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে অভিযুক্তর অপরাধ প্রমাণিত ও তার সাজার সুপারিশ হওয়ার পরেও অভিযুক্ত ব্যক্তি শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়। আবার কখনও অভিযুক্ত ক্ষমতাসীন দলের কেউ হলে তার বিচার বিলম্বিত করা হয়। কিন্তু অভিযুক্ত বিরোধী দলের কেউ হলে তার বেলায় ঘটে ঠিক উল্টোটা।
×