ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এক মহীয়সী নারীর কথা

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ১৬ আগস্ট ২০১৯

এক মহীয়সী নারীর কথা

বাঙালী নারীদের মধ্যে যে ক’জন স্বমহিমায় উজ্জ্বল তার মধ্যে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবস্থানটি উপরের দিকেই। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস ইতিহাস তাকে সেই সুমহান মর্যাদার আসনটি দিতে পারেনি। ইতিহাসের সোজা পথ বার বার বিকৃত হয়ে বাঁকা পথে চলেছে। এজন্য একজন মহীয়সীর অসামান্য অবদান আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের নিকট আড়ালেই থেকে গেছে। রাজনীতির সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদের এই মহীয়সীকে আড়াল করে রাখবার পেছনে অনেকাংশে দায়ী। এই মহীয়সীর অবদান সর্বমহলে খুব বেশি আলোচিত হতে দেখা যায় না। বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং শেখ হাসিনার লেখনী ও বক্তব্যতেই খানিকটা পাওয়া যায়। এছাড়া জন্ম ও মৃত্যু দিনকে সামনে রেখে কিছু কিছু লেখা ও আলোচনায় তাঁর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের প্রজন্মের নিকট বেগম মুজিবের জীবিত অস্তিত্ব অনুভব করার সৌভাগ্য হয়নি। এজন্য ইতিহাসের অধ্যায়ন থেকেই তাঁকে দেখা ছাড়া আমাদের উপায়ও নেই। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্ম। তাঁর ডাক নাম রেণু। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মাত্র ৩ বছর বয়সে পিতা ও ৫ বছর বয়সে মাতাকে হারান। তারপর চাচত ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার কাছেই ওই পরিবারের অন্যান্য সন্তানের মতোই বেড়ে ওঠেন তিনি। প্রথমে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল ও পরবর্তীতে সামাজিক কারণে গৃহশিক্ষকের কছে পড়াশোনা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ৭ম ও ৮ম পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার বা তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সঙ্গে আমার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সঙ্গে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা-মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সঙ্গেই রেণু বড় হয়।’ ১৯৩৯ সালে বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিবের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। যখন তাদের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৯ ও ৯ বছর। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ২১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৯৪২ সালে আমাদেরফুলশয্যা হয়।’ ওইটুকু বয়সে বিয়ে হওয়া এই দম্পতির সাংসারিক জীবনে বোঝাপড়া ছিল অসাধারণ। যা এখনকার ঠুনকো দাম্পত্য জীবনের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। টুঙ্গিপাড়া গ্রামের এক খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠবার পেছনে প্রতিটি পদক্ষেপেই বেগম মুজিবের অবদান ছিল অসামান্য। পেছন থেকে অনুপ্রেরণা এবং সাহস না দিলে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা অনেকাংশেই কঠিন হতে পারত। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিক্ষè বুদ্ধিমত্তা, শান্ত, অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে জীবনে যে কোন কঠিন পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতেন। বৈষয়িক বিষয়াদি নিয়ে তার কোন চাহিদা ও মোহ ছিল না। তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলেই স্বাধীন বাংলাদেশে ৩২ নম্বর বাড়ি ছেড়ে গণভবনে থাকতে রাজি হননি। বাড়িতে কার্পেট, দামী আসবাব, এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করেননি। নিজের হাতে স্বামীর খাবার রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে দিতেন অথবা কখনও কখনও নিজে নিয়ে যেতেন। আপাদমস্তক একজন আদর্শ বাঙালী নারী ছিলেন তিনি। মনমানসিকতায় ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। অন্যের দুঃখে-দুঃখিত হওয়া ছিল তার স্বভাবজাত ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে রাজনৈতিক কারণে প্রায় ১৩ বছর জেল খেটেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এই ১৩ বছরের অনুপস্থিতিতে বেগম মুজিবের কারণে কোন প্রকার শূন্যতা তৈরি হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবরাদি নেয়া ও তাদের পরিবার পরিজনের যে কোন সঙ্কটে পাশে দাঁড়ানো ছিল তাঁর নিয়মিত কাজের অংশ। ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন স্বামী বঙ্গবন্ধুর আদর্র্শকে। জীবনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাঁকে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁর মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করতে সহায়তা করা, আন্দোলন পরিচালনায় পরামর্শ দেয়াসহ প্রতিটি কাজে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দলের ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ জেলখানায় সাক্ষাতকারের সময় বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্র্শ ও নির্র্দেশ নিয়ে আসতেন। বঙ্গবন্ধুর সেই নির্র্দেশনা আবার দলীয় ফোরামে পৌঁছে দিতেন। জেলে থাকা বঙ্গবন্ধুকে তিনি অনুুপ্রেরণা, শক্তি, সাাহস ও মনোবল জুগিয়েছেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু পরিবার পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক গৃহবন্দী ছিল। ওই সময় বেগম মুজিব অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য নিয়ে পুরো পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। তার পূর্বে বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রধান প্রেরণাদায়ী ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় বেগম মুজিবকে। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায় বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবনের প্রধান পরামর্শক ছিলেন বেগম মুজিব। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরেরদিন ১৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পরিবারের বন্দিত্বের অবসান ঘটে। আর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান। সেখান থেকে বেগম মুজিবের সঙ্গে তাঁর প্রথম কথা হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এরপর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। অসংখ্য বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদা দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর পুরো পরিবারটিকেও আগলে রেখেছিলেন এই মহীয়সী নারী। শ্বশুর-শাশুড়ির যতœ আত্মি, পাঁচ সন্তানের পড়ালেখা থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয়ে দেখভাল করা, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা সবকিছু অত্যন্ত সুচারুরূপে করে গেছেন তিনি। সন্তানদের যেমন ভাল বেসেছেন তেমনি শাসন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন ব্যস্ততার কারণে সন্তানদের নিকট একাধারে পিতা ও মাতা উভয়েরই দায়িত্ব পালন করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তিনি ছিলেন কোমলে কঠোরে মিশ্রিত এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাহসী নারী। স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সন্তানদের গড়ে তোলেন। এই সময়ে এসেও এদেশের মানুষ যার সুফল পাচ্ছে তাঁদের সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনার মতো একজন দৃঢ় বিশ্বখ্যাত নেতৃত্বের মাধ্যমে। তাঁর অপত্য ¯েœহ, মমতা, দরদ ও আপ্যায়ানের কথা আজও ওই সময়ের রাজনীতিবিদরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। বাঙালী জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ইতহাসে তাই বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণীই নন কিংবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মাতাই নন। তিনি বাঙালীর স্বাধিকার ও মুক্তির এক অন্যতম স্মরণীয় অনুপ্রেরণা দায়ী। ইতিহাস যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন তাঁর নামটি কখনওই মুছে ফেলা যাবে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে জাতির জনকের পুরো পরিবারের সঙ্গে এই মহীয়সীও শহীদ হন। ৪৫তম শাহাদাতবর্ষিকীর এই সময়ে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। গতকাল ৮ আগস্ট বেগম মুজিবের ৯০তম জন্মদিন গেল। জন্ম এবং মৃত্যু দিনের এই কাছাকাছি সময়ে আমাদের প্রত্যাশা একজন বেগম মুজিবের জীবন দর্শন এদেশের লাখো কোটি নারীর জীবন দর্শন হয়ে উঠুক। তাহলেই সমাজে শান্তি বিরাজ করবে।
×