ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

অনুভূতিসম্পন্ন রোবট

প্রকাশিত: ০৯:১২, ১৬ আগস্ট ২০১৯

অনুভূতিসম্পন্ন রোবট

এবার আসছে নতুন ইলেক্ট্রনিক স্কিন বা ই-স্কিন যার বদৌলতে রোবট ও প্রসথেটিকগুলো সাধারণ স্পর্র্শানুভূতি লাভ করবে। এদের স্পর্শানুভূতি হবে মানুষের স্পর্শানুভূতির সমান কি তার চেয়ে বেশি, এমনকি হাজার গুণ বেশি দ্রুত। ই-স্কিনের এত দ্রুত স্পর্শানুভূতি এর আগে আর অর্জিত হয়নি। সিঙ্গাপুরের একদল গবেষকের উদ্ভাবিত এই নতুন ই-স্কিনের নাম এসিনক্রোনাস কোডেড ইলেকট্রনিক স্কিন বা সংক্ষেপে এসিইএস। এটি আসলে এক কৃত্রিম নার্ভাস সিস্টেম বা স্থায়ুতন্ত্র। এটি যে শুধু অত্যধিক মাত্রায় ও দ্রুতগতিতে সাড়া দিতে সক্ষম তা-ই নয়, উপরন্তু তা এমন শক্তপোক্ত যে সহজে ক্ষতিগ্রস্ত বা নষ্ট হয় না। ইলেক্ট্রনিক স্কিন বা ত্বক হিসেবে সার্থকভাবে কাজ করার জন্য এগুলো যে কোন ধরনের সেন্সর স্কিন লেয়ারের সঙ্গে জুড়ে দেয়া যেতে পারে। সহকারী অধ্যাপক বেঞ্জামিন টির নেতৃত্বাধীন দলের উদ্ভাবিত এই ই-স্কিনের তথ্য সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স রোবটিক্সে ছাপা হয়েছে। আমরা প্রায় প্রতিটি দৈনন্দিন কাজ সম্পাদনের জন্য স্পর্শানুভূতিকে কাজে লাগাই। এই অনুভূতি না থাকলে হাঁটা-চলার সময় আমরা আমাদের ভারসাম্যবোধ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলব। একইভাবে মানুষের সঙ্গে আরও ভালভাবে মিথস্ক্রিয়া করার জন্য রোবটেরও স্পর্শানুভূতি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আজকের রোবটগুলো বিভিন্ন বস্তুকে স্পর্শের দ্বারা খুব ভালভাবে অনুভব এখনও পর্যন্ত করতে পারে না। মানুষের ইন্দ্রিগত স্থায়ুতন্ত্র থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে অধ্যাপক টির দলটি দেড় বছর ধরে শ্রমসাধনার পর এমন এক সেন্সর ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন যা আরও ভালভাবে কাজ করতে পারে। এসিইএস নামক সেই সেন্সর ব্যবস্থাটি আসলে এক ইলেক্ট্রনিক স্থায়ুতন্ত্র যা মানুষের সংবেদনশীল স্থায়ুতন্ত্রের মতো সিগন্যাল বা সঙ্কেত নির্ণয় করে থাকে। এটি একটিমাত্র ইলেক্ট্রনিক কন্ডাক্টরের দ্বারা যুক্ত সেন্সরসমূহের একটি নেটওয়ার্ক দিয়ে গঠিতÑ যা মানুষের ত্বকে নার্ভ বা স্থায়ুর গুচ্ছের মতো নয়। প্রচলিত ইলেক্ট্রনিক স্কিন থেকেও তা আলাদা। প্রচলিত ই-স্কিনগুলোতে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ওয়্যারিং ব্যবস্থা থাকে যেগুলোর কারণে সেগুলো সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং সেই ক্ষতির মাত্রা নির্ণয় করতে পারাও কঠিন। মানুষের সংবেদনশীল স্থায়ুতন্ত্র থেকে প্রেরণা লাভের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক টি বলেন, মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্থায়ুতন্ত্র অতিমাত্রায় দক্ষ এবং এটি সংরক্ষণ এমন পরিসরে কাজ করে চলে যে আমরা অনেক সময় একে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারি না। তাছাড়া এই স্থায়ুতন্ত্র এত বেশি যে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যেমন, আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে আমাদের স্পর্শানুভূতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। টি বলেন, আমাদের জৈবিক ব্যবস্থা যেভাবে কাজ করে সেটাকে অনুকরণ করে যদি আমরা সেই প্রক্রিয়াটিকে আরও উন্নত করে তুলতে পারি তাহলে ইলেক্ট্রনিক স্কিন সেখানে প্রধানত প্রয়োগ করা হয় সেই রোবটিক্সের ক্ষেত্রে দারুণ উন্নতি ঘটাতে পারব। এসিইএস মানুষের সংবেদী স্থায়ুতন্ত্রের চেয়ে এক হাজার গুণেরও বেশি দ্রুতগতিতে স্পর্শ নির্ণয় করতে সক্ষম। যেমন এটি ৬০ ন্যানোসেকেন্ডেরও কম সময়ে বিভিন্ন সেন্সরের মধ্যকার শারীরিক যোগাযোগের মধ্যে পার্থক্য টানতে সক্ষম। এমনকি অনেক বেশি সংখ্যক সেন্সর দিয়েও ইলেক্ট্রনিক স্কিন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে স্পর্শানুভব করার ক্ষমতা এর আগ পর্যন্ত অর্জন করা যায়নি। এসিইএসএর সক্ষমতাপ্রাপ্ত ত্বক যে কোন বস্তুর আকার-আকৃতি, গঠনবিন্যাস ও কাঠিন্য ১০ মিলি সেকেন্ডের মধ্যে সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে। যা চোখের পলক ফেলার চেয়ে ১০ গুণ বেশি দ্রুত। এসিইএস ব্যবস্থার অধিক বিশ্বস্ততা ও উচ্চগতিতে ধারণ ক্ষমতার জন্যই এটা সম্ভব হয়ে উঠেছে। এসিইএস প্লাটফর্ম এমন বলিষ্ঠতা অর্জনের উপযোগী করে তৈরি করা যেতে পারে যাতে এর শারীরিক ক্ষতি না হয়। ইলেক্ট্রনিক স্কিনের জন্য এটা এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কারণ পরিবেশ-পরিপার্শ্বের সঙ্গে এগুলোর ঘন ঘন শরীরী যোগাযোগ ঘটে থাকে। প্রচলিত ই-স্কিনে সেন্সরগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য বর্তমান ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো হয়। কিন্তু এসিইএসএর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম। সেখানকার সমস্ত সেন্সরকে এমন একটি অভিন্ন ইলেক্ট্রনিক কন্ডাক্টরের সঙ্গে যুক্ত করা যায় যেখানে প্রতিটি সেন্সর স্বাধীনভাবে কাজ করে। এর ফলে সেন্সর ও কন্ডাক্টরের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত একটি সংযোগ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এসিইএস যুক্ত ইলেক্ট্রনিক স্কিন কাজ করে চলবে এবং এতে করে এটি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। এসিইএসএর সহজ ওয়্যারিং ব্যবস্থা ও অসাধারণ সংবেদনশীলতাই হচ্ছে প্রধান বৈশিষ্ট্য যা রোবট, প্রোসথেটিক ডিভাইস বা কৃত্রিম অঙ্গ এবং অন্যান্য মানব মেশিন ইন্টারফেসের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ইলেক্ট্রনিক স্কিন আনুপাতিকহারে বাড়িয়ে তোলার পথ সুগম করবে। আনুপাতিক হারে বাড়িয়ে তোলার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রোবট ও কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপরিভাগের অপেক্ষাকৃত বড় বড় জায়গা ঢেকে রাখার জন্য উচ্চ কর্মক্ষমতাসম্পন্ন ইলেকট্রনিক স্কিনের বড় বড় টুকরো প্রয়োজন। এসিইএস যে কোন ধরনের সেন্সর স্কিন লেয়ারের সঙ্গে সহজে জুড়ে দেয়া যায়। অধ্যাপক টির দল সম্প্রতি স্বচ্ছ, পানি প্রতিরোধক, ক্ষয়ক্ষতি আপনা থেকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম সেন্সর স্কিন লেয়ার উদ্ভাবন করেছে। এর সঙ্গে এসিইএস জুড়িয়ে দেয়া হলে এমন ইলেক্ট্রনিক স্কিন তৈরি হতে পারে যা মানুষের শরীরের ত্বকের মতো আপনা থেকেই কাটাছেঁড়া বা আঘাত সারিয়ে তুলতে সক্ষম। এ ধরনের ইলেক্ট্রনিক স্কিন আরও বাস্তবানুগ কৃত্রিম অঙ্গ উদ্ভাবনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে যা পঙ্গু ব্যক্তিদের স্পর্শানুভূত ফিরিয়ে আনার কাজে সহায়ক হবে। অন্যান্য সম্ভাবনাময় প্রয়োগের মধ্যে আছে আরও বুদ্ধিমান রোবট তৈরি যা দুর্যোগ বিপর্যয় দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজ করতে পারবে কিংবা পণ্যাগারে পণ্যসামগ্রী প্যাকিংয়ের মতো সাধারণ কাজকর্মের দায়িত্ব নিতে পারবে। সূত্র : সায়েন্স ডেইলি
×