ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৩২ নং বাড়িটিতে বঙ্গবন্ধু ও স্বজনের লাশ

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ১৬ আগস্ট ২০১৯

৩২ নং বাড়িটিতে বঙ্গবন্ধু ও স্বজনের লাশ

১৪ আগস্টের সূর্য অস্ত গিয়েছে প্রায় তিন ঘণ্টা পূর্বে। এই তিন ঘণ্টায় ধানম-িতে রাষ্ট্রপতি ও শেখ মনির বাস ভবন এবং মিন্টো রোডে মন্ত্রী আঃ রব সেরনিয়াবাতের বাড়ির আশপাশে কোন প্রকার অস্বাভাবিক তৎপরতা আছে কি-না দূর থেকে বেসামরিক পোশাকে অবজার্ভ করে ফিরে এসেছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দল। তাদের রিপোর্টের পর ইতোমধ্যে অফিসার সকল সৈনিকদের রাতের খাবার সাড়া হয়েছে। নাইট ট্রেনিং প্রোগ্রামে ফায়ারিং না থাকলে গোলাবারুদ বের করার সুযোগ না থাকলেও ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানরত মেজর রশিদের ২ ফিল্ড আর্টিলারির অফিসাররা মর্টার, মেশিনগান ও এর গোলাবারুদ আগেই এ্যাডজুটেন্টের অফিসে তালাবদ্ধ করে রেখে দিয়েছে। অপর দিকে মেজর ফারুখের ১ বেঙ্গল ল্যান্সারের বিপুল পরিমাণ ক্ষুদ্রাস্ত্রের গুলি তাদের অস্ত্রাগারে মওজুদ করা আছে। রাত ১টার পর ২ ফিল্ডের সৈনিকদের ১ বেঙ্গল ল্যান্সারের মাঠে যৌথ ট্রেনিংয়ের নামে জড়ো করা হলে সেখানে উভয় ইউনিটের অফিসারসহ চাকরিচ্যুত কিন্তু ইউনিফর্ম পরিহিত মেজর ডালিম, নুর ও আরও ক’জন বহিরাগত অফিসার হাজির হয়। প্রথমে মেজর ফারুক, এরপর মেজর রশিদ, মেজর ডালিম ও মেজর নুর সৈনিকদের উদ্দেশ্যে নিচু স্বরে অথচ বঙ্গবন্ধু ও সরকারবিরোধী কঠিন ভাষায় বক্তৃতা করেন। দেশের স্বার্থে সামরিক আইন জারি করতে হবে বললেও মূল লক্ষ্য যে হত্যাকা- তা তখন চেপে গিয়ে এরপরই সৈনিকদের মধ্যে গোলাবারুদ বিতরণ ও তাদের গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দেয়া হয়। মোট ১২ জন অফিসারকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন টার্গেটের দায়িত্ব দেয়া হলেও মেজর ফারুখ ধানমণ্ডি এলাকা ও রক্ষীবাহিনীর শের’এ বাংলা নগর ক্যাম্প, মেজর ডালিম মিন্টো রোড বাংলাদেশ বেতার এবং মেজর রশিদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দায়িত্ব থাকে। সৈন্যভর্তি ছয়টি বিশাল লড়ি, কয়েকটি কামানবাহী আর্টিলারি গাড়ি এবং জিপ সেনানিবাস ত্যাগের পরই ট্যাঙ্কসমূহ ও যাত্রা শুরু করে। এটি সত্যিই বিস্ময়কর যে সকল গোয়েন্দা ও মিলিটারি পুলিশের নাকের ডগার ওপর দিয়ে বিনা বাধায় বেরিয়ে গেল এই যুদ্ধের কনভয়। প্রথম দলটি মেজর আজিজ পাশা- মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে ধানম-িতে শেখ মনির নিরস্ত্র দারোয়ানকে দাঁড় করিয়ে রেখে দ্রুত দোতলায় উঠে যায়। দরজা ভেঙে কিছু বোঝার আগেই শেখ মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা করে ভাবলেশহীনভাবে ৩২নং রোডের দিকে ছুটতে থাকে। দ্বিতীয় গ্রুপে একটি জিপে মেজর ডালিম মহাখালী-মগবাজার হয়ে মিন্টো রোডে মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে পৌঁছে দু’জন দুর্বল পুলিশ প্রহরীকে নিরস্ত্র করে অপেক্ষায় থাকে। এই গ্রুপের মূল অংশ মেজর রাশেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল হয়ে মিন্টো রোডের টার্গেটের বাইরে উপস্থিত হয়। পূর্বে অপেক্ষারত মেজর ডালিমের কাছ থেকে নিচু স্বরে কিছু ব্রিফ নিয়ে এরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে মন্ত্রীর বাড়ির দরজায় উপস্থিত। গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত দ্রুত রাষ্ট্রপতিকে ফোন করেন। রিসিভার রাখা মাত্র হামলাকারীরা দরজা ভেঙে আজরাইল রূপে দোতলায় মন্ত্রীর রুমের ভেতর দ-ায়মান। তারা মন্ত্রীসহ বিভিন্ন রুম থেকে পরিবারের সকলকে টেনে হেঁচরে নিচের ড্রইংরুমে জড়ো করে। দ্রুততম সময়ে একাধিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ট্রিগার চেপে ধরলে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিতে সবাই লুটিয়ে পড়ে যায়। রেহাই পায়নি মাত্র চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবুও। এরা তড়িঘড়ি করে চলে যায় রেডিও সেন্টারের দিকে। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী গ্রুপটি ৩২নং ধানম-ির চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করে। সম্ভবত এর মিনিট ২/৩ আগে মন্ত্রী ও ভগ্নিপতি সেরনিয়াবাতের ফোন পেয়ে বঙ্গবন্ধু পি এ’কে কন্ট্রোলরুমে লাইন লাগাতে বলেন। মুহিতুল লাইন না পাওয়ায় লুঙ্গি, গেঞ্জি পরিহিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিজে নিচে নেমে আসেন। এই সময়েই বাড়ির আঙিনায় রাষ্ট্রপতির হাউজ গার্ড বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু তখন মুহিতুলের হাত থেকে ফোন নিয়ে পুলিশ কন্টোল রুম পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। হাউজ গার্ডের বিউগল শেষ হওয়া মাত্র দক্ষিণ দিকের লেকের অপর পাশ থেকে ৬৭৭নং বাড়ি লক্ষ্য করে মেজর মহিউদ্দিনের দল মর্টার ও মেশিন গানের গুলি ছুড়তে শুরু করে। একটি গুলি বঙ্গবন্ধুর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মাত্র মুহিতুলকে নিয়ে তিনি বসে পরেন। মিনিটখানেক গুলি চলার পরই শান্ত হলে বেগম মুজিব গৃহকর্মীকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি নিচে পাঠান। পাঞ্জাবি গায়ে পরতে পরতে শেখ সাহেব সামনের দরজার কাছে সেন্ট্রি-পুলিশদের কাছে গোলাগুলির কারণ জানতে চান। তিনি দোতলায় উঠে গেলে শেখ কামাল তিন তলা থেকে দৌড়ে নিচে নেমে আসেন। বঙ্গবন্ধু বেডরুমে লাল টেলিফোনে কর্নেল জামিলকে গোলাগুলির খবর দিতে সক্ষম ও বেশ ক’বার চেষ্টার পর সেনা প্রধানকেও পেয়ে যান। গড়িয়ে যাওয়া এই সামান্য সময়ের মধ্যেই ৩২নং রোডের পূর্ব পাশ থেকে মেজর নুর-হুদা গ্রুপ এবং পশ্চিম থেকে ল্যান্সার মহিউদ্দিন গ্রুপ সদর দরজায় পৌঁছে যায়। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা শেখ কামালকে সামনে পাওয়া মাত্রই হত্যা করে। জেনারেল শফিউল্লাহ্র বক্তব্য অনুযায়ী সেনাপ্রধানকে বঙ্গবন্ধু এই হামলার কথা জানালে তিনি বাড়ি থেকে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। যে শেখ মুজিবের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও পালানোর রেকর্ড নেই, সেই রাষ্ট্রপতি মুজিবকে তার সেনাপ্রধান তাকে রক্ষা নয় পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে! মেজর মহিউদ্দিন ও তার দল পশ্চিম দিকের সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলে বঙ্গবন্ধু রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। ওরা তাকে ঘিরে ধরে নিচে নামানোর সময় হয়তবা গায়ে ধাক্কা লাগে। ‘বেয়াদবি করিস না’ এমন গর্জনে নিচ থেকে কয়েক ধাপ দৌড়ে ওপরে উঠে বঙ্গবন্ধুকে সামনে দেখা মাত্র মেজর নুর চিৎকার দিয়ে সবাইকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েই খুব কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর সমুদ্রসম বিশাল বুক লক্ষ্য করে ট্রিগার চেপে ধরে। অন্তত আঠারটি গুলিতে সিড়িতেই লুটিয়ে পরেন শেখ মুজিব তো নয়, এ যেন বাংলাদেশ, স্বাধীনতা। এরপর খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে ডিঙিয়ে নিচে নেমে যায়। বঙ্গবন্ধুর শরীর থেকে অজস্র ধারায় রক্ত বয়ে যাচ্ছে নিচে। এমন সময় মেজর পাশা- মোসলেহ উদ্দিন গ্রুপ যেন খুনের নেশায় উন্মাদ হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এরই কিছুক্ষণ আগে শেখ মনি দম্পতিকে হত্যা করে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ ডিঙিয়ে বেগম মুজিবের রুমের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে তখন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজি ও শেখ নাসের। বেগম মুজিবকে বাইরে আসতে বললে তিনি ওদের অনুসরণ করছিলেন। কিন্তু বাইরে আসা মাত্র প্রিয় স্বামীর মৃতদেহ দেখে তিনি চিৎকার করে তাকেও হত্যার আহ্বান জানালে গর্জে ওঠে অস্ত্র, ঢলে পরেন মৃত্যুর কোলে বেগম মুজিব। শেখ নাসের ও রাসেলকে নিচে নামিয়ে দিয়ে রুমে ঢুকে আবার গুলি। এখানে তাৎক্ষণিক তিনজন মারা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনানুযায়ী দেশের সেরা নারী ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামালের মাথা চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গিয়েছিল। শেখ নাসেরকে নিচে বাথরুমে এবং পরে দশ বছরের রাসেলকে ওপরে রক্তাক্ত ভাই ও ভাবিদের মৃত দেহের ওপর ধাক্কা মেরে গুলি চালালে মাথার মগজ ছিটকে দেয়াল ও ছাদে আটকে যায়। এদিকে যখন হত্যাকা- চলছিল, তখন সেনানিবাসে কার কি প্রতিক্রিয়া, ভূমিকা ছিল? সেনাপ্রধানের বক্তব্যমতে ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিল এবং সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এই দুঃসংবাদ জানা মাত্র ঘরের পোশাক অবস্থায়ই সেনাভবনে উপস্থিত হলেও তার নির্দেশ মোতাবেক পদাতিক বাহিনী দ্বারা বিদ্রোহ দমনে ব্যবস্থা নেয়নি। অপরদিকে জেনারেল জিয়া কর্নেল শাফায়াতের কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ জেনে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ‘সো হোয়াট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। আপহেল্ড দ্য কনসটিটিউশন’ ঠা-া মাথায় এমন শক্ত মন্তব্য উচ্চারণ করেন। সেইভ ও ইউনিফর্ম পরিহিত টিপটপ জেনারেল জিয়া সেনা ভবনে খালেদ মোশাররফকে এ্যাকশনে যাওয়া থেকে বিরত রাখেন কথাটি সত্য হলে জেনারেল শফিউল্লাহর অবস্থা ভেবে আমাদের করুণা হয়। এরপর তার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে সেনাসদরে অফিস করতে চলে যান। অথচ তখনও ভাসছে রক্তের সাগরে তার নিয়োগ কর্তা শেখ মুজিব ও তার স্বজনের লাশ। এই হত্যাকা-ে তিনি বিন্দুমাত্র জড়িত এমনটি বিশ^াস করি না ঠিকই কিন্তু সেনাপ্রধান হিসেবে তার ব্যর্থতার দায় তিনি এড়াতে পারেন না। তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অভ্যন্তরে যে বিদ্রোহের আগুন জ¦লছিল, চক্রান্তকারীরা তার কোলে বসে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছিল তা তিনি জানলেন না? বঙ্গবন্ধু সবাইকে বিশ^াস করলেও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না এমনটি দেখা ও জানা সত্ত্বেও তিনি কেন তাকে বুঝিয়ে বা চাপ দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি। ‘হি ইজ গোয়িং টু স্পয়েল এভরি থিং’ জেনারেল জিয়ার এমন বক্তব্যের পর সেনাপ্রধান কেন নিজে উদ্যোগী হয়ে বিদ্রোহী ও খুনীদের দমন করেননি। হয়তবা বঙ্গবন্ধুকে আর বাঁচানো যেত না, কিন্তু ইতিহাস তো ভিন্ন হতো। কিন্তু তিনি সেনাপ্রধান নয়, নিছক কলের পুতুলের মতো কেবল তাঁকিয়ে দেখেছেন। অবশেষে খন্দকার মোশতাককে সমর্থন দিয়ে সেনাপ্রধানের পদ হারিয়েও দীর্ঘদিন তারই উপ-প্রধানের অধীনে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। ধীক এ পদ ও পদবির। লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
×