ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

কাশ্মীর কোন্ পথে

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৬ আগস্ট ২০১৯

কাশ্মীর কোন্ পথে

॥ চার ॥ কারগিল যুদ্ধের পর কাশ্মীর যাওয়ার আগেই ঠিক করেছিলাম সেখানকার রাজনীতি, বিশেষ কাশ্মীরের ভারত অন্তর্ভুক্তির ঘটনাবলী বুঝতে হলে দু’জনের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলতে হবে। একজন হচ্ছেন কাশ্মীরী জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ আবদুল্লাহর পুত্র জম্মু কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ ফারুখ আবদুল্লাহ এবং অপরজন কাশ্মীরের শেষ নৃপতি মহারাজা হরি সিং-এর পুত্র ড. করণ সিং, যিনি গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কাশ্মীরের রিজেন্ট, সদরে রিয়াসত ও গবর্নর ছিলেন। আমার সৌভাগ্য, দু’জনের সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। ড. করণ সিং-এর সঙ্গে পাঁচ বছর আগেও কথা বলেছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে জানার জন্য। ’৭১-এর ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার যে দু’জন সদস্য এখনও বেঁচে আছেন ড. করণ সিং তাঁদের একজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। প্রথম সাক্ষাতেই করণ সিং আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। তাঁর কথা আমার বইয়ে আছে, ‘দুঃসময়ের বন্ধু’ প্রামাণ্যচিত্রেও আছে। তাঁর জীবনে ১৮ সংখ্যাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। কাকতালীয় হলেও ১৯৪৭ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহারাজা হরি সিং তাঁকে কাশ্মীরের রিজেন্ট অর্থাৎ মহারাজার প্রতিনিধি নিয়োগ করেন সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে। ১৯৫২ সালে কাশ্মীরের আইনসভা তাঁকে সদরে রিয়াসত হিসেবে নির্বাচিত করে। ’৬৫ সালে এই পদের নাম পরিবর্তন করে গবর্নর করা হয়। ড. করণ সিং ১৮ বছর জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপ্রধান ছিলেন। ’৬৭ সালে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় যোগ দেন ৩৬ বছর বয়সে ভারতের কনিষ্ঠতম মন্ত্রী হিসেবে। পরবর্তী ১৮ বছর তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি সমাজ, পরিবেশ ও দর্শন বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশগ্রহণ এবং লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন। বর্তমানে তিনি ভারতের রাজ্যসভার সদস্য। দিল্লী গিয়ে তাঁকে টেলিফোন করে সাক্ষাতকারের বিষয়ের কথা জানাতেই তিনি বললেন, আমার আত্মজীবনীতে সবই তো লিখেছি। বললাম, আত্মজীবনী পড়া হয়নি। তবে আত্মজীবনীর বাইরেও অন্য সব বিষয়ে আপনার অভিমত জানা প্রয়োজন। এরপর তিনি সময় দিয়েছেন। জম্মু থেকে দিল্লী ফিরেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। এরপর যতবার দিল্লী গিয়েছি সময় পেলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষের দেশীয় রাজ্যগুলোর ভেতর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ছিল কাশ্মীর, তখন আয়তন ছিল বাংলাদেশের প্রায় দেড়গুণ। ডোগরা রাজবংশের প্রতিনিধি হিসেবে মহারাজা হরি সিং-এর পর যুবরাজ করণ সিং-এর বসার কথা ছিল জম্মু কাশ্মীরের সিংহাসনে। সেভাবেই তাঁকে গড়ে তোলা হচ্ছিল। কিন্তু ’৪৭-এ ভারত বিভক্ত হয়, পাকিস্তানের জন্ম হয়, কাশ্মীরের ইতিহাসও অন্যরকম হয়ে যায়। কাশ্মীরের ইতিহাস যারা লিখেছেন কিংবা যে সব রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাতকার আমি নিয়েছি তারা প্রত্যেকে, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী ফারুখ আবদুল্লাহ বা ঐতিহাসিক অধ্যাপক রিয়াজ পাঞ্জাবিও বলেছেন, ’৮৯-তে জঙ্গীদের তৎপরতা শুরু হওয়ার আগে কাশ্মীরে কখনও সাম্প্রদায়িকতার আঁচ লাগেনি। ড. করণ সিং এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, ’৩২ সালে কাশ্মীরের মীর ওয়াইয মৌলভী ইউসুফ শাহর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহ যখন মুসলিম কনফারেন্স গঠন করেন তারপর থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাঁর আত্মজীবনীতে বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখও আছে। ড. করণ সিং-এর মতে, শেখ আবদুল্লাহর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছে কাশ্মীরে ডোগরা রাজত্ব অবসানের লক্ষ্য নিয়ে। ’৩৯ সালে তিনি মুসলিম কনফারেন্স থেকে বেরিয়ে এসে ন্যাশনাল কনফারেন্স গঠন করেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আদলে। তখন থেকে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নেহরু নিজেও সমাজতন্ত্রী ছিলেন, সামন্তপ্রথা তাঁর পছন্দ ছিল না। চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হলে শেখ আবদুল্লাহ এর বিরোধিতা করেন। জিন্নাহ্ নিজেকে মনে করতেন ভারতবর্ষের মুসলমানদের ত্রাণকর্তা। শেখ আবদুল্লাহ জিন্নাহকে পছন্দ করতেন না তাঁর ত্রাতাসুলভ আচরণের জন্য। তাছাড়া তাঁর আগ্রহ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। ১৯৪২-এ কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। এর চার বছর পর শেখ আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্স ‘কাশ্মীর ছাড়’ আন্দোলনের ডাক দেয় সরাসরি মহারাজা হরি সিং-এর বিরুদ্ধে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দেখে শেখ আবদুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের গ্রেফতার করা হয়। শেখকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে মহারাজা হরি সিং-এর প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত রামচন্দ্র কাক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেখ আবদুল্লাহর গ্রেফতারের খবর পেয়ে জওহরলাল নেহরু খুবই অসন্তুষ্ট হন। তিনি ঘোষণা করেন কাশ্মীর যাবেন। প্রধানমন্ত্রী কাক কাশ্মীরে নেহরুর আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নেহরু কাশ্মীর এলে তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী যখন চাপা উত্তেজিত ও গর্বিত কণ্ঠে মহারাজা হরি সিংকে গুলাব ভবনে এসে নেহরুর গ্রেফতারের সংবাদ দেন তখন তরুণ যুবরাজ করণ সিং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নেহরুর গ্রেফতারের সংবাদে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। কারণ, শুধু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়, ‘ডিসকভারি অব ইণ্ডিয়া’র লেখক হিসেবেও নেহরুকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে তাদের প্রধানমন্ত্রী গ্রেফতার করেছেনÑ এতে কংগ্রেসের ভেতর কতখানি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে তিনি খুবই বিচলিত হন। তখনই তাঁর মনে হয়েছিল নেহরুর গ্রেফতার কাশ্মীরের ভাগ্যে বড় রকমের বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে। মহারাজা হরি সিংকে শেখ আবদুল্লাহ অত্যাচারী, কুশাসক, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বললেও করণ সিং বলেছেন, তাঁর পিতা হরি সিং ছিলেন তার সমসাময়িক রাজন্যবর্গের ভেতর সবচেয়ে সৎ, প্রজাবৎসল ও প্রগতিশীল শাসক। কিন্তু শেখ আবদুল্লাহ তাঁকে কাশ্মীর ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক নাটকীয় অধ্যায় হচ্ছে শেখ আবদুল্লাহ ও মহারাজা হরি সিং-এর সম্পর্কের টানাপোড়েনÑ যা গড়িয়েছে করণ সিং-এর আমল পর্যন্ত। ভারত বিভক্তির সময় দেশীয় রাজ্যগুলোর ভাগ্যও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে আইন পাস হয়েছিল তাতে বলা হয়েছে দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারত অথবা পাকিস্তান যে কোন একটি ‘ডোমিনিয়ন’-এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। মহারাজা হরি সিং চেয়েছেন স্বাধীনতা, যখন শেখ আবদুল্লাহ ছিলেন কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে। করণ সিং বলেছেন, সেই সময় ভারতের রাজনীতির চারটি প্রধান ধারা ছিল। আমার পিতার সঙ্গে প্রতিটি ধারার সম্পর্ক ছিল বৈরী। ব্রিটিশরা তখন তাদের সাম্রাজ্যের সবচেয়ে মূল্যবান রতœটি হারাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার পিতা চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসন আরও কিছুকাল অব্যাহত থাকুক, কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। ভারতে ছিল জওহরলাল নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল ও মওলানা আজাদের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস, যাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল পিতার চিরশত্রু শেখ আবদুল্লাহর। ভারতের পক্ষে যাওয়া এ কারণে সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ। জিন্নাহরই প্রস্তাব ছিল দেশীয় রাজ্যের রাজন্যরাই তাঁদের রাজ্যের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবেন, যা কাশ্মীরে শেখ আবদুল্লাহ বরাবর বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু তারপরও আমার পিতা ছিলেন হিন্দু, মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তাঁর পক্ষে হজম করা সম্ভব ছিল না। এ কারণে তিনি পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষেও ছিলেন না। সব শেষে তাঁর নিজের রাজ্যে রয়েছে ন্যাশনাল কনফারেন্স, যারা তার শত্রুতে পরিণত হয়েছে গত দেড় দশকে, যাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ডোগরা শাসনের অবসান। তারপরও আমার পিতা স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও। কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর শেখ আবদুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং নেহরুর সঙ্গে পরামর্শ করে হরি সিংকে কাশ্মীর ছাড়া করেছেন। অপরদিকে মহারাজার অনুগত প্রজা ও আমত্যরা যাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে না পারেÑ শেখ আবদুল্লাহ যুবরাজ করণ সিংকে চাইলেন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের প্রধান হিসেবে। নেহরু ও প্যাটেলের পরামর্শে মহারাজা হরি সিং তাঁর একমাত্র পুত্র যুবরাজ করণ সিংকে কাশ্মীরের রিজেন্ট নিয়োগ করেন। করণ সিং কখনও ভুলতে পারেননি শেখ আবদুল্লাহ কিভাবে তাঁর পিতার হেনস্তা করেছেন। ’৫৩ সালে তিনি এর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ আবদুল্লাহকে বরখাস্ত করে। শুধু বরখাস্ত নয়, একই সঙ্গে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করেছেন। করণ সিং দিল্লীকে, বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে বোঝাতে পেরেছিলেন শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের স্বাধীনতা চান। প্রকৃতপক্ষে শ্রীনগরে লালচকের জনসভায় ’৫৩ সালের মার্চে শেখ আবদুল্লাহ বলেছিলেন, তিনি প্রয়োজন হলে কাশ্মীরের ভারত অন্তর্ভুক্তির চুক্তি বাতিল করে দেবেন। জম্মু-কাশ্মীরের সদরে রিয়াসত যুবরাজ করণ সিং কংগ্রেসের প্রতি বিশ্বস্ত বখশী গুলাম মোহাম্মদকে জম্মু কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। বখশীর প্রচেষ্টায় নতুন সংবিধানের মাধ্যমে কাশ্মীর ক্রমশ ভারতের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়। (ক্রমশ.)
×