ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘অপারেশন জ্যাকপট’

প্রকাশিত: ২৩:৫৬, ১৫ আগস্ট ২০১৯

‘অপারেশন জ্যাকপট’

১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট দিনটি ছিল রবিবার। ১৫ আগস্ট, ১৯৭১ গত ২৫ মার্চ থেকে ইয়াহিয়ার বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশে যা করেছে সারা বিশ্ব তাতে হতবাক হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ.থান্ট বর্ণিত মানব ইতিহাসের সেই সর্বাধিক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনার পর এবং মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বর্ণিত মানব ইতিহাসের বৃহত্তম বিপর্যয় সৃষ্টির করে সামরিক আদালতে বিচার প্রহসন শুরু করেছে। এই বিচার প্রহসনের পেছনে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের যে ঘৃণ্য উদ্দেশ্য ও দুরভিসন্ধি রয়েছে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলাদেশে পাক সামরিক চক্রের বর্বরতা ও বীভৎসতার দৃষ্টান্তে এটাই মনে হয় যে, ইয়াহিয়াও তার নয়া নাৎসী বাহিনী করতে পারে না এহেন কিছু নেই। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মি. ট্রুডো পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে এক তারবার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এর পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের পত্র-পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনেও পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারে দারুণ হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। লন্ডনের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলোতে মন্তব্য করা হয়েছে যে, যেভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু হয়েছে তাতে পাক সামরিক চক্রের ওপর আদৌ ভরসা করা যায় না। লন্ডনের টাইমস’ ইয়র্কশায়ার পোস্ট ও অন্যান্য সংবাদপত্রে এই তথাকথিত বিচারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীগণ এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক আইনজীবী সংস্থাও শেখ মুজিবুরের বিচার প্রহসনের জন্য ইয়াহিয়ার বর্বর সামরিক চক্রের কঠোর সমালোচনা করেছেন। টাইমস’ পত্রিকায় প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী মি. ডব্লিউ টি উইলিয়ামের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। এই চিঠিতে মি. উইলিয়াম বলেছেনÑ যেভাবে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গোপন বিচার প্রহসন শুরু হয়েছে তাতে তিনি ও বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন সকল মানুষ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, যেভাবে এই তথাকথিত বিচার চলছে তাতে কোনক্রমেই শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যায় বিচার আশা করা যেতে পারে না। তিনি বলেন, একমাত্র প্রাণের ঝুঁকি ও বহু ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি ছাড়া কোন বাঙালী কৌশলী শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থনে যাবেন না। মি. উইলিয়াম বলেন, আইয়ুবের আমলে সুপ্রিমকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে সামরিক সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করেছিল। ভয়ঙ্কর ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র সেই একই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিচারে প্রহসন শুরু করেছে। তিনি বলেন, পাক সামরিক চক্রের মূর্খতার বশে মিথ্যা অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি কোনরকম দ- দেয় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। গত শুক্রবারে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, মিথ্যা অভিযোগ তুলে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা এক মারাত্মক ভুল করেছে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যদি এই তথাকথিত বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদ- দেয় তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে মারাত্মক ভুল আর সেই ভুলের কোন সংশোধনের পথ থাকবে না। ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকসেনাদের রসদ বোঝাই দুটি নৌকাকে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে নয়নপুর যাবার পথে অতর্কিত আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর রসদ বোঝাই নৌকা দুটি বিধ্বস্ত হয়ে পানিতে ডুবে যায় এবং ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। রাজশাহী-নবাবগঞ্জ রোডের সফল অপারেশনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং মেজর গিয়াসের তত্ত্বাবধানে কাছাকাছি এলাকায় আরেকটি অপারেশন করার জন্য তারা বেশ উত্তেজিত ছিল। রাতে ‘হরিপুর ব্রিজ’ নামক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্রিজ দখল করে এবং ১২ জন পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকার আটক করা হয়। এর ফলে রাজশাহী এবং নবাবগঞ্জের মধ্যকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল নবাবগঞ্জ শহরে ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে প্রায় কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাবর্ষণ করে; তাতে পাকিস্তানী আর্মির স্থানীয়ভাবে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপন প- হয়ে যায়। কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর একটি সম্মিলিত দল হোমনা থানার ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। থানার ভেতরে অবস্থিত পাক পুলিশ ও সেনারা আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু দুই ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১০ জন সৈন্য নিহত হয় ও ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়। সন্ধ্যায় মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ময়মনসিংহে পাকহানাদার বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটির ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। দুই ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৫-১৬ জন সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর ১৫ জন যোদ্ধা আহত হয়। মুক্তি সংগ্রামের পূর্ব সেক্টর প্রেস এ্যান্ড লিয়াজো অফিসার সুলতান মাহমুদের ঢাকা থেকে পাঠানো বিশেষ কমান্ডো এ্যাকশন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, খামারগাঁও গ্রামের হাফেজ সরকারের কাছ থেকে ১টি একনলা বন্দুক উদ্ধার করা হয়। চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে অভিযান ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডোদের প্রথম অপারেশন। মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন, তাদের এই অভিযান সফল হলে বাঙালী জাতিকে তা এগিয়ে নেবে বিজয়ের বন্দরে। আর ব্যর্থতার ফল হবে মৃত্যু। এ কারণে লিম্পেট মাইন নিয়ে মরণপণ সেই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। অপারেশন জ্যাকপটের প্রস্তুতির শুরুতে প্রত্যেক নৌ-কমান্ডোকে একটি করে লিমপেট মাইন, ছুরি, এক জোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার দেয়া হয়। প্রতি তিনজনের জন্য একটি করে স্টেনগান ও কমান্ডারদের দেয়া হয় একটি করে ট্রানজিস্টর। অপারেশনের দিন ধার্য করা হয় ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নৌ-কমান্ডারদের জন্য এক জীবনমরণ ক্ষণ সেই মধ্যরাত। তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল পলাশির হরিনা ক্যাম্প থেকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়, তারা একযোগে পৌঁছে যাবেন স্ব স্ব এলাকা চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ। সে এক লোমহর্ষক যুদ্ধাভিযান। স্বাধীনতা যুদ্ধের এক কঠিনতম মুহূর্ত এই অপারেশন জ্যাকপট, যা মূলত নৌ-কমান্ডো পরিচালিত গেরিলা অপারেশন। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরেরা ছিলেন আমাদের দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরীণ সব নৌচলাচল, বন্দর ও উপকূলীয় এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ১০ নম্বর সেক্টর যা ছিল মূল নৌবাহিনী নিয়ে গঠিত। এ সেক্টরের কোন নির্দিষ্ট সেক্টর কমান্ডার ছিল না। অপারেশন চলাকালে সেক্টরের কমান্ডারদের সহযোগিতায় নৌ-গেরিলাদের কাজ করতে হতো। তবে এসব গেরিলারা সরাসরি মুজিবনগর সদর দফতরের অধীনে কাজ করতেন। প্রথমত মার্চের শুরুর দিকে পাকিস্তানী সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যায় পাকিস্তানী সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য। সেই ৪১ জন সাবমেরিনারদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালী এবং এরা আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ২৫ মার্চ কাল রাতের গণহত্যার খবর শুনে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে আটজন ৩০ মার্চ বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন এবং ৯ এপ্রিল ১৯৭১ তারা ভারতের দিল্লীতে এসে পৌঁছান। তাঁরা হলেনÑ মোঃ রহমতউল্লাহ, সৈয়দ মোশাররফ হোসেন, মোঃ শেখ আমানউল্লাহ, মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, মোঃ আহসানউল্লাহ, মোঃ আবদুর রকিব মিয়া, মোঃ আবদুর রহমান আবেদ, মোঃ বদিউল আলম। পরে এই আটজনের সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যুক্ত করে মোট ২০ জনের গেরিলা দল গঠন করে তাদের ভারতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের দেশে পাঠানো হলে কর্র্নেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে বাছাই করা তিনশ’ জনকে নিয়ে ২১ মে গঠন করা হয় নৌ-কমান্ডো বাহিনী। এমএজি ওসমানীর সিদ্ধান্তে নৌ-কমান্ডো সেক্টর খোলার পর বাছাই করা গেরিলাদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে ২৩ মে একটি গোপন প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এই প্রশিক্ষণ শিবিরের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় সি২পি। প্রশিক্ষণ শিবিরে এদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, সে বিষয়টি এতই গোপনীয় ছিল যে, সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যেও শুধু যার এলাকায় অপারেশন চালানো হবে তিনি ছাড়া আর কেউ এই সম্পর্কে জানতেন না। প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই বাছাই করা যোদ্ধাদের বলে দেয়া হয়, এটি একটি সুইসাইডাল অপারেশন বা আত্মঘাতী অভিযান হবে। তাই অপারেশনের সময় যে কোন মূল্যে অভিযান সফল করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তাদের প্রাণ দিতে হতে পারে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীদের ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক ফরমে স্বাক্ষর নেয়া হয়। ফরমে লেখা থাকত, ‘আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।’ নৌ-কমান্ডোদের ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার এম এন সামানত ও প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন লে. কমান্ডার জিএম মার্টিসসহ আরও ২০ জন ভারতীয় প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষকদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা আটজন সাব-মেরিনারও ছিলেন। প্রশিক্ষণের দুটো অংশ ছিল। সবাইকে প্রয়োজনীয় স্থলযুদ্ধ যেমন গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিস্ফোরকের ব্যবহার, স্টেনগান রিভলবার চালানো, আন-আর্মড কমব্যাট ইত্যাদি শিখতে হতো। আর জলযুদ্ধের প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের সাঁতার যেমন বুকে ৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেঁধে সাঁতার, চিৎ সাঁতার, কোনমতে পানির ওপরে নাক ভাসিয়ে টানা দীর্ঘ সময় সাঁতার, পানিতে সাঁতরে ও ডুব সাঁতার দিয়ে লিমপেট মাইন ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার, জাহাজের কেবল ভাঙা ইত্যাদি কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেয়া হতো তীব্র খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে। শীত-বর্ষায় টানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করতে হয় সব যোদ্ধাকে। টানা প্রায় তিন মাস প্রশিক্ষণের পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তা শেষ হয়। প্রশিক্ষণের শেষদিকে এসে আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানো হতে থাকে। একই সঙ্গে একই সময়ে দুই সমুদ্র বন্দর ও দুই নদী বন্দরে আক্রমণ চালানোর জন্য চার সেক্টরের পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটানো হয়। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রথম ব্যাচকে চার স্থানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে মোট চারটি দলে ভাগ করা হয়েছিল। ৬০ জনের দুটি দল এবং ২০ জনের আরও দুটি দল। চারটি দলের চারজন নেতা ঠিক করে দেয়া হয়েছিল। দলের নেতাদের অভিযান পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল বিশেষ গোপনীয় পদ্ধতি যা দলের অন্যান্য সদস্যের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। পরিকল্পনা গুছিয়ে আনার পর আগস্টের শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশনের জন্য মোঃ ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জন নৌ-কমান্ডোর একটি দলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তার সঙ্গে ডেপুটি লিডার হিসাবে ছিলেন নৌ-কমান্ডো শাহ আলম। কলকাতার দমদম বিমানবন্দর থেকে আকাশ পথে আগরতলায় পৌঁছায় নৌ-কমান্ডোদের দলটি। সেখান থেকে ১১ আগস্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। কখন হবে অপারেশন- তখনও তা জানানো হয়নি দলের কাউকে। টিমলিডারদের কেবল জানানো হয়েছে, অপারেশনের দিনক্ষণ জানাতে সঙ্কেত হবে দুটি গান। আকাশবাণী রেডিওতে ওই গান বাজলেই বুঝতে হবে- সময় এসে গেছে। বিমানে জেনারেল অরোরা ওয়াহেদ চৌধুরীকে বললেন, ‘ডু ইউ নো ইওর ডি ডে?’ তিনি বলেছিলেন, নো স্যার। তখন জেনারেল অরোরা আভাস দিলেনÑ হয়ত ১৫ তারিখ হতে পারে। ঠিক হয়েছিল, অপারেশন শুরুর সঙ্কেত হিসেবে ঠিক করা গান দুটি সম্প্রচার করা হবে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য কলকাতা আকাশবাণীর বিশেষ অনুষ্ঠানে, সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৬টা অথবা রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। প্রচারের ফ্রিকোয়েন্সি আর গান দুটির কথা শুধু টিম লিডার ও ডেপুটি লিডারকেই বলা হয়েছিল। এর মধ্যে পঙ্কজ মল্লিকের ‘আমি যে তোমাকে শুনিয়েছি কত গান’ বাজলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশনে যেতে হবে। আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি’ বাজার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হবে অপারেশন। কমান্ডারদের বলা হয়েছিল, এ দুটি বাংলা গানকে সঙ্কেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। গান দুটি অথবা তাদের সঙ্কেত হলো প্রথম সঙ্কেত ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান’ এর অর্থ হলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ করতে হবে বা আক্রমণের সময় কাছাকাছি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’ গানটি ছিল দ্বিতীয় সংকেত যার অর্থ আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর। অর্থাৎ সুস্পষ্ট নির্দেশ আক্রমণ করতেই হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে। হরিনা ক্যাম্প থেকে আসা ৬০ জনের দলকে ২০ জন করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ১ ও ২ নম্বর দল তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট বেজ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং ১৪ আগস্ট তারা প্রথম গানের সঙ্গেত পায়। এই সঙ্কেত পাওয়ার পর তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে চরলক্ষ্যায় তাদের বেজ ক্যাম্পে পৌঁছায়। তৃতীয় দলটির তখনও কোন খবর পাওয়া যায়নি। ১৫ আগস্ট তারা ট্রানজিস্টরে চূড়ান্ত সঙ্কেত পায় এবং অপারেশনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। রাতেই জাহাজে মাইন লাগাতে হবে। সময় ঠিক রাখতে না পারলে চাঁদপুর, মংলা ও নারায়ণগঞ্জের অপারেশনের সময়ের সঙ্গে গরিমল হয়ে যাবে। সেই গান শুনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযান শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে রাত ১১টার আগেই কর্ণফুলী নদীর ওপারে পৌঁছায় ওয়াহেদ চৌধুরীর দলের দুই ভাগের ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। ৩৩ জন ১১টা জাহাজে তিনজন করে এ্যাটাক করবে। প্রতিটিতে তিনটি করে মাইন ফিট করবে। পানির ছয় ফুট নিচের সামনে, পেছনে আর মাঝখানে। একেকটা টার্গেটে একেকটা জাহাজে তিনজন করে হিট করবে। আর সাতজন শেল্টারে দাঁড়াবে। রাত ১২টা বাজার ৫ মিনিট আগে পানিতে নামেন কমান্ডোরা। জাহাজে মাইন বসিয়ে সোয়া ১২টার মধ্যে আবার একসঙ্গে হয়ে যান। ফেলে দেন অন্যান্য সরঞ্জাম। সুইমিং কস্টিউম পরা ৪০ জনের ওই দল গিয়ে অবস্থান নেয় একটি বাড়ির গোয়াল ঘরে। এরপর বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনার অপেক্ষা। রাত ১টা ৪০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর একে একে সব মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সফল অপারেশনে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ ধ্বংস হয়। এই বড় জাহাজগুলো হলোÑ (১) এমভি হরমুজ এটি ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। ৯৯১০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদবাহী এই জাহাজটি ১৩ নম্বর জেটিতে নোঙর করা ছিল (২) এমভি আল-আব্বাস এটি ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ৯ আগস্ট ১২ নম্বর জেটিতে অবস্থান নিয়েছিল। (৩) ওরিয়েন্ট বার্জ নম্বর ৬ এটি ৬ হাজার ২৭৬ টন অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে ফিস হারবার জেটির সামনে অবস্থান করছিল। ১৬ আগস্ট সকালে ছড়িয়ে পড়ল খবর। বলা হল, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে নয়টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা’। মাইন বিস্ফোরণের সময় ভয়ঙ্কর আওয়াজ হয়েছিল। পাকিস্তানীরা সারা ওয়ার্ল্ডে সিগন্যাল দিল- চিটাগাং পোর্ট ইজ নন-অপারেশনাল, চিটাগাং পোর্ট ড্যামেজড বাই দি টেররিস্ট। সেই অভিযানে নয়টি জাহাজ ডুবিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দেয়ার পর পাকিস্তানীদের মনোবল ও মেরুদ- ও ভেঙে যায়। ধ্বংস হওয়া নয় জাহাজের মধ্যে এমভি হরমুজে নয় হাজার ৯১০ টন এবং এমভি আল-আব্বাসে ১০ হাজার ৪১৮ টন সমর সরঞ্জাম ছিল। পরে একের পর এক মাইন বিস্ফোরণে জাহাজ তিনটিসহ পার্শ্ববর্তী অনেক জাহাজ বিধ্বস্ত হয় এবং পানিতে ডুবে যায়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে বহির্বিশ্বে প্রচার চালিয়ে আসছিল পাকিস্তান সরকার। নৌ-কমান্ডোদের সফল ওই অভিযানের মাধ্যমে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম মুক্তিযোদ্ধাদের ওই অভিযানের খবর ফলাও করে প্রকাশ করে। ২৭ জুলাই ৬০ জন নৌ কমান্ডো ও ২০০ জন বাংলাদেশি সিএ্যান্ডসি বিশেষ কমান্ডো দল আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বে ভারতের কানিং মাতলার বন্দর থেকে মংলা অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সুন্দর বনের গভীর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে কমান্ডো দলটি ১৩ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় মংলাবন্দরে পৌঁছায়। ২৬০ জনের কমান্ডো দলটি মংলাবন্দর ও ডাংমারি বিলের পেছনে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিল। সেখান থেকে মংলার দূরত্ব ডাংমারি বিলের মাঝ দিয়ে ৬ মাইল, নৌকায় পৌঁছাতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা। ১৫ আগস্টে রেডিও মারফত এ্যাকশন গান বাজার পর তারা পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের ও যুদ্ধের সব অপারেশনের সাফল্যের জন্য বিশেষ দোয়া করেন। ঠিক রাত ১২টায় কমান্ডোরা ১৫টি নৌকায় মংলাবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। মংলায় পৌঁছানোর শেষ সময় নির্ধারিত ছিল রাত ২টা। কিন্তু পথ পরিদর্শকের ভুল পরিচালনায় কমান্ডোরা নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে মোংলা বন্দরে পৌঁছায়। ইতোমধ্যে অপারেশনের নক্সামাফিক বাংলাদেশের সব নদী ও সমুদ্রবন্দরে অপারেশন শেষ। এ অপারেশন শুধু জীবনের ঝুঁকিই ছিল না, বরং ১৬ আগস্টের ভোরের এই অপারেশন ছিল সরাসরি একটি সুইসাইড এ্যাকশান। সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ভোর সাড়ে চারটায় মংলায় অপারেশন শুরু হয়। অপারেশন চলাকালে ২০০ জন সিএ্যান্ডসি বিশেষ কমান্ডো দল, হেভি মেশিনগান, এনরগা সহকারে তিনজনের ছোট ছোট দল করে, ৬৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে নৌ-কমান্ডোদের কভার দিতে মংলা বাঁধের পেছনে অবস্থান নেন। অপারেশন চলাকালে সিএ্যান্ডসি কমান্ডো দলের উপকমান্ডার রাজা ও খিজির জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌ কমান্ডোদের সহযোগিতায় মেশিনগান নিয়ে পশুর নদীর হাঁটু পানিতে নেমে আসেন। সময়ের অভাবে শুধু ২৪ জন নৌ কমান্ডো এই অভিযানে অংশ নেন। ৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে ২৪ জন নৌ-কমান্ডো ৬টি বিদেশী জাহাজে মাইন লাগায়, ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে নৌ-কমান্ডোদের লাগানো মাইন বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হতে শুরু করে। ৩০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর চারটি বিমান মংলা বন্দরের ওপরে ঘুরতে দেখা যায়। আক্রান্ত জাহাজগুলোর মধ্য একটি সোমালীয়, একটি মার্কিন ও দুটি চীনা, একটি জাপানী ও একটি পাকিস্তানী জাহাজ। এ অপারেশনে ছয়টি বিদেশী জাহাজই ধ্বংস হয় এবং ৩০ হাজার টন গোলা-বারুদ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম পশুর নদীতে নিমজ্জিত হয়। মংলা অপারেশন কমান্ডার আমিনুর রহমান খসরুসহ আরও দুজন নৌ-কমান্ডো এ অপারেশনে মংলা বন্দরের অতিরিক্ত বাধা পার হয়ে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে সোমালীয় ৭ হাজার টন অস্ত্রবাহী জাহাজ এস এস লাইটিংয়ে মাইন লাগিয়ে বিস্ফোরণ এবং এসএস লাইটিংকে ধ্বংস করেন। এই অপারেশনে দুজন মুক্তিযোদ্ধা নিখোঁজ হন, ধারণা করা হয় তারা স্রোতের টানে ভেসে গেছেন অথবা মারা গেছেন। চাঁদপুর নদী বন্দর অপারেশনে ১৮ জন নৌ-কমান্ডো অংশ নেন। এ গ্রুপের ১৮ জনকে তিনজন করে মোট ৬টি ছোট দলে ভাগ করা হয়। এই অভিযানে মাইন বিস্ফোরণে ২টি স্টিমার, গমবাহী একটি জাহাজসহ ছোট বড় আরও অনেকগুলো নৌযান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর অপারেশনে মোট ৪টি জাহাজ ও বেশ কয়েকটি নৌযান নৌ কমান্ডোরা ধ্বংস করেন। শহরের মাঝে এ অপারেশনে কমান্ডোরা বিশেষ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এ অপারেশনে মোট ২০ জন কমান্ডো অংশ নিয়েছিলেন। অপারেশনগুলোতে প্রায় ২৬টি জাহাজ ধ্বংস হয় এবং আরও অনেক নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি নয়াদিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ও শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী লন্ডনে বলেন, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন তারা মীর জাফরের মতোই ভুল করছেন। মীর জাফর বাংলার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের মহাসচিব উ.থান্টের বিবৃতির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব দেশ ও জাতির শত্রু। তার বিচার সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। শেখ মুজিবের বিচারে নাক গলিয়ে জাতিসংঘ তার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত কথিকামালা বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ থেকে ইয়াহিয়ার বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশে যা করেছে সমস্ত বিশ্ব তাতেই হতবাক হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ.থান্ট বর্ণিত মানব ইতিহাসের সেই সর্বাধিক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনার পর এবং মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বর্ণিত মানব ইতিহাসের বৃহত্তম বিপর্যয় সৃষ্টির পর ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনীর বর্তমান বাংলার নয়নমণি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মিথ্যে অভিযোগ এনে সামরিক আদালতে বিচারের নামে প্রহসন শুরু করেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মি. ট্রুডো পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে এক তারবার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে প্রহসনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এর পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর হবে। ‘টাইমস’ পত্রিকায় প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী ডব্লিউ.টি. উইলিয়ামের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিতে উইলিয়াম বলেছেন, যেভাবে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গোপন বিচারের নামে প্রহসন শুরু হয়েছে তাতে তিনি ও বিশ্বের বিবেকবান সকল মানুষ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, পাক সামরিক চক্র মূর্খতার বশে মিথ্যা অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি কোন রকমের দ- দেয় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, মিথ্যা অভিযোগে তুলে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা এক মারাত্মক ভুল করেছে। পাকিস্তান সামরিক জান্তা যদি এই তথাকথিত বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদ- দেয় তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে মারাত্মক ভুল। আর সেই ভুল সংশোধনের কোন পথ থাকবে না। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাকিস্তানী নির্যাতন এবং বিদেশ থেকে অবাধ সাহায্য দানের পথে সীমান্ত বাহিনীর অবরোধ সৃষ্টির প্রতিবাদে ‘অপারেশন ওমেগা’ নামীয় ব্রিটিশ ও আমেরিকান সত্যাগ্রহীদের একটি দল আগামী মঙ্গলবার বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন। শুক্রবার কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা বলেন, পশ্চিম বাংলা থেকে তাঁরা ‘সীমান্তের বেড়া ভেঙে’ ভেতরে ঢুকবেন এবং পাক বাহিনীর মোকাবেলা করবেন। তাঁরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এবং নিরস্ত্রই থাকবেন। বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অবশ্যই তাঁরা ইয়াহিয়া সরকারের অনুমতি চাননি-কারণ তেমন অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত : কোন দেশের অভ্যন্তরে মানুষের উপর অত্যাচার, লাঞ্ছনা, গণহত্যা ঘটলে, অভাব-অনটন হলে, এই দুর্গত মানুষদের পাশে ছুটে যাবার সম্পূর্ণ মানবিক অধিকার অন্য দেশের মানুষদের আছে- এই অধিকারকে রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বেষ্টনী দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। অবশ্য, অহিংস সৈনিকের নীতি অনুসারে তাঁরা তাঁদের এই পরিচালনার কথা পাক সরকারকে জানিয়ে রেখেছেন- তাঁরা প্রকাশ্যেই সীমান্তের বেআইনী আইন লঙ্ঘন করবে এবং যে কোন ঝুঁকির সম্মুখীন হবেন। ৪ জন মহিলাসহ এই স্যুাগ্রহী দলে মোট আছেন ১১ জন। এদের মধ্যে ৮ জন দুটি ল্যান্ডরোভার গাড়িতে ত্রাণসামগ্রী বোঝাই করে বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন। ইন্দোনেশিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সফর শেষে ভারত ইন্দোনেশিয়ার যুক্ত ইশতেহার থেকে জানা যায় যে, ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিকের আমন্ত্রণে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ১২ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭১ ইন্দোনেশিয়া সফর করেন। তার সফর সঙ্গী ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মেনন, যুগ্ম-সচিব আর ডি সাথী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের যুগ্ম সচিব-ই গণসালভেস। সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ সুহার্তো সাদরে তাদের গ্রহণ করেন। আলোচনার সময় তার সঙ্গে মহামান্য জেনারেল উ এইচ নসুশন, প্রভিশনাল পিপলস কনসালটেটিভ পরিষদের চেয়ারম্যান আদম মালিক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ড. শরীফ তৈয়ব, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। এই আলোচনায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রতিনিধিদলের সদস্যদের এবং এনবি এর সহায়তা নেন। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জনাব আরবিআইএন ডিজাজডিনিগ্রাত, পররাষ্ট্র বিভাগের রাজনৈতিক বিষয়ক মহা-পরিচালক, জনাব ইসমাইল তাজিব, পররাষ্ট্র দফতরের এক্সটার্নাল অর্থনৈতিক বিষয়ক মহাপরিচালক, জনাব হার তাসিং, পররাষ্ট্র দফতরের নিরাপত্তা ও কমিউনিকেশন বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল, জনাব এবি লুবিস, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিচালক, এবং জনাব নুরমাথিয়াস, পররাষ্ট্র বিভাগের এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক পরিচালক মহোদয় গ্রহণ করেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আন্তরিকতা ও সমঝোতার পরিবেশে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং সাধারণ স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীসহ বিভিন্ন সাম্প্রতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয় তাদের আলোচনায় উঠে আসে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত মহাসাগর, নিরপেক্ষ জাতিদের মধ্যে সহযোগিতা, শান্তির সাম্প্রতিক চুক্তি, বন্ধুত্ব ও কো-অপারেশন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। নিজস্ব অঞ্চলের সমস্যা নিয়ে আলোচনা, উভয়পক্ষের জোটনিরপেক্ষ নীতি, তাদের বিশ্বাস, সর্বজনীন শান্তি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি অনেক বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আসে। বিশেষ করে এশিয়ায় বিরাজমান বর্তমান অবস্থা আলোচনা করে প্রতিটি দেশের মানুষ বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়ে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করা উচিত বলে একমত প্রকাশ করা হয়। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে এই অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব এবং সব প্রান্তিককৃত দেশগুলোর স্বাধীনতা সংহত করার প্রয়োজন স্বীকার করা হয়। তারা এশিয়ায় সাম্প্রতিক উন্নয়নের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। এবং এর ফলে তাদের বন্ধন শক্তিশালী হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। এছাড়া অন্য দেশগুলোও লুসাকা সম্মেলনে তাদের এইসব পলিসি নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তু প্রবেশ ও এর জন্য উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা এদের ফিরে যাবার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করার প্রয়োজনের উপর একমত হন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ঘটনায় তার উদ্বেগ জানান এবং বলেন যে ইন্দোনেশিয়া সরকারের কোন প্রচেষ্টা আবশ্যক হলে তারা সেটা করবেন যা হবে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে। তারা ইতোমধ্যে পূর্ববর্তী সভায় এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে ইন্দো-চীন সমস্যা একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উন্নত ও বিস্তৃত করার ব্যাপারে তারা চুক্তিবদ্ধ হন। দুই মন্ত্রীদের ১৯৫৫ সালের সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত চুক্তির কাঠামো অনুযায়ী তারা দুই বছর সময় সম্পর্কের অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তারা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা পর্যালোচনা করেন এবং পারস্পরিক লাভজনক পরিধি বিস্তৃত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে সম্মত হন-বিশেষ করে শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দুদেশের নেতাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর ও শক্তিশালী করার কথা ব্যক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে তারা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার কথা পর্যালোচনা করেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করণ, বাণিজ্য ও যৌথ শিল্প উদ্যোগ উন্নয়নের প্রচারের জন্য একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা পুনরায় আলোচনায় আনেন। এ প্রসঙ্গে তারা এশীয় মন্ত্রী কাউন্সিল ঊঈঅঋঊ-এর উদ্যোগের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞ্যাপন করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক ফোরামে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন এবং বাণিজ্য ও উন্নয়নের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনাইটেড ন্যাশনস কনফারেন্স এর আলজিয়ার্স সনদের বিধানাবলীর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয়ভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া সফরের সময় তাকে ও তার দলকে উষ্ণ স্বাগত ও আন্তরিক আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি ইন্দোনেশিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ করেন। সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ পত্রিকায় ‘মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা’ শিরোনামের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত ২৫ জুলাই রাতে ঢাকার উপকণ্ঠে ডায়না সিনেমার কাছে মুক্তিফৌজ দুইটি ট্রাক ভর্তিসেনা বহরে হাত বোমা নিক্ষেপ করলে ২৫-৩০ জনকে নিহত ও ট্রাক দুই ধ্বংস হয়। পরের দিন কয়েকশত সৈন্য এসে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্যেশ্যে প্রায় ৫০০ নিরীহ নাগরিক কে হত্যা করে। এবং দুই পাশের গ্রাম ভস্মীভূত করে। এইরকম অত্যাচার সত্ত্বেও জনগণ গেরিলা যোদ্ধাদের আশ্রয় ও সহযোগিতা করছেন। ২৯ জুলাই মুক্তিবাহিনী সন্ধ্যা ৭টা হইতে কার্ফ্যু জারির ঘোষণা সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করে। ফলে ৬টা বাজতে না বাজতেই রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ে ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ বহু চেষ্টা করে বন্ধ দোকান খুলতে পারেনি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মুক্তিবাহিনী একের পর এক শত্রুঘাঁটি দখল করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। গত কয়েকদিনে মুক্তি বাহিনী কাকিনা, হাতি বান্ধা, ভূরুঙ্গামারী, দহগ্রাম, বোরখাটা, বারা, পাটগ্রাম প্রভৃতি জায়গার পাক ঘাঁটিগুলো দখল করে নেয় এবং আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ওইসব অঞ্চলে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, মুক্তিফৌজ রাজশাহী জেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণস্থানসহ প্রায় ২০০০ বর্গ মাইল এলাকা সম্পূর্ণ নিজেদের কর্তৃত্বে এনেছেন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×