ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খোকন আহম্মেদ হীরা

সেরনিয়াবাত পরিবারকে আজও তাড়া করে স্বজন হারানো বেদনা

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ১৫ আগস্ট ২০১৯

 সেরনিয়াবাত পরিবারকে আজও তাড়া করে স্বজন হারানো বেদনা

ভয়াল ও আতঙ্কের কাল রাত্রির রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের পাশাপাশি হামলা চালিয়েছিল বরিশালের সেরনিয়াবাত পরিবারের ওপর। ওইদিন ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন মন্ত্রী (বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি) আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭ মিন্টো রোডের বাসভবনে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়। ঘাতকরা তাদের পরিকল্পনা সফল করতে হেভি মেশিনগান সংযোজিত দ্রুতগতির জিপ, প্রচুর পরিমাণে এমুনিশন ও গুলিসহ এক প্লাটুন ল্যান্সার সৈন্য নিয়ে ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজনসহ বরিশালের একটি ব্যান্ড গ্রুপের সদস্যরা। লোমহর্ষক সেইদিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা গেছে, হামলাকারী ঘাতকরা প্রথমেই বাসার সিকিউরিটিকে নিষ্ক্রিয় করতে খুব দ্রুতগতিতে পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। শুরু করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। গুলির শব্দে বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙ্গে আতঙ্কিত হয়ে পরেন। ব্যাপক আক্রমণের একপর্যায়ে ঘাতকরা বাড়ির সবকিছু তছনছ করে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়িতে আক্রমণের শুরুতেই আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তার বাড়ির রেড ফোন দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মেয়ে জামাতা শেখ ফজলুল হক মণিকে বিষয়টি অবহিত করে জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুর ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়ির চারদিকেও একই অবস্থা। এতে সে (রব সেরনিয়াবাত) তাৎক্ষণিকভাবে বিমূঢ় হয়ে বসে পরেন। সেসময় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত শুধু মুখে একটি কথাই বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ বংশে বাতি দেয়ার মতো তওফিক রেখ।’ ঠিক সেই মুহূর্তে ঘাতকরা দরজা ভেঙ্গে বাসার মধ্যে প্রবেশ করে সকলকে নিচতলায় নিয়ে আসে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন-আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার স্ত্রী (বঙ্গবন্ধুর বোন) আমিনা বেগম, মেয়ে বেবী, বিউটি ও হামিদা সেরনিয়াবাত, ছেলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী সাহান আরা বেগম এবং তার শিশু সন্তানসহ বরিশালের অনেকেই। ঘাতকরা দোতলা থেকে সবাইকে অস্ত্রের মুখে নিচতলায় নামিয়ে আনার সময় আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ৪ বছর ১ মাস ২৩ দিন বয়সের শিশু পুত্র সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত মায়ের কোলে উঠতে চাইলে শহীদ সেরনিয়াবাত তাকে কোলে তুলে নেন। পরিবারের সদস্যসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের ঘাতকরা একটি কক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এ সময় ঘাতকের হুঙ্কারে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বোন আমিনা বেগম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন-‘বাবা তোমরা কি আমাদের মাইরা ফেলবা’ এর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ঘাতকদের নির্মম ব্রাশফায়ার। ঘাতকের ক্রমাগত ব্রাশফায়ারে একে একে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার স্ত্রী আমিনা বেগম, পুত্রবধূ সাহান আরা বেগম, শহীদ সেরনিয়াবাত ও কোলে থাকা সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতসহ অন্যরা। কোমরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাহান আরা বেগমসহ অন্যরা কাতরাচ্ছিলেন। ঘাতকরা এ অবস্থায় চলে যায়। এ সময় আহত বিউটি সেরনিয়াবাত রক্তাক্ত রব সেরনিয়াবাতকে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলে ঘাতকরা ফিরে এসে দ্বিতীয় দফায় গুলি চালায়। ঘাতকের নির্মম ১৬টি বুলেট বিদ্ধ হয় বেবী সেরনিয়াবাতের শরীরে। এ সময় ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়ে যায় আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর একমাত্র মেয়ে কান্তা সেরনিয়াবাত ও দেড় বছরের ছেলে (বর্তমানে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র) সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। ঘাতকের গুলিতে সেদিন আরও নিহত হয়েছিলেন বরিশালের ক্রিডেন্স ব্যান্ড গ্রুপের সদস্য আব্দুর নাঈম খান রিন্টু ও আহত হন ক্রিডেন্স ব্যান্ডের সদস্য ডাঃ খ.ম জিল্লুর রহমানসহ অনেকে। সেই ভয়াল কাল রাতে বরিশালের সেরনিয়াবাত পরিবারের ছয়জন নারী-পুরুষ ও শিশু নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তারা হলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ ফজলুল হক মনির স্ত্রী বেগম আরজু মনি, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতী সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত ও ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত। সেরনিয়াবাত পরিবারের আহত হয়েছিলেন-আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বোন আমিনা বেগম, মেয়ে বিউটি সেরনিয়াবাত, হামিদা সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত ও আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী সাহান আরা বেগম। পরেরদিন সকালে তৎকালীন রমনা থানার ওসি এসে আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে দীর্ঘ চিকিৎসায় গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে যায় রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী আমিনা বেগম, মেয়ে বিউটি সেরনিয়াবাত, হামিদা সেরনিয়াবাত, ছেলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত, সাহান আরা বেগমসহ আরও কয়েকজন। সেদিন ভাগ্যক্রমে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ঘাতকের নির্মম বুলেট থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও আজও ভয়াল কাল রাতের দুঃসহ স্মৃতি ও স্বজন হারানোর তীব্র বেদনা বইয়ে বেড়াচ্ছেন তিনিসহ (হাসানাত) সেরনিয়াবাত পরিবারের সদস্যরা। লেখক : সাংবাদিক
×