ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাশ্মীর কোন পথে

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ১৫ আগস্ট ২০১৯

 কাশ্মীর কোন পথে

॥ তিন ॥ মৌলভী ইফতেখার হোসেন আনসারী (১৯৪২-২০১৪) আমৃত্যু কাশ্মীরের শিয়াদের ধর্মীয় সংগঠন ‘অল জম্মু-কাশ্মীর শিয়া এ্যাসোসিয়েশনে’র সভাপতি হলেও তার ভেতর কোন ধর্মীয় গোঁড়ানি দেখিনি। তিনি ‘জম্মু এ্যান্ড কাশ্মীর পিপলস কংগ্রেসে’র নির্বাচিত সাংসদ হিসেবে ১৯৯৬ সালে ফারুখ আবদুল্লাহকে সরকার গঠনে সাহায্যও করেছিলেন। শ্রীনগরে তার সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। প্রতিবারই বিদায় নেয়ার সময় বলেছেন, আগামীবার কাশ্মীর এলে এই গরিবখানায় পায়ের ধুলো দেবেন, এক কাপ কাশ্মীরী চা খেয়ে যাবেন। কাশ্মীরী চা-কে স্থানীয়রা বলেন ‘কাহ্বা’। চায়ের পাতা ঠিক আমাদের দেশী পাতার মতো নয়। জ্বাল দেয়ার সময় বাদাম, আখরোট, এলাচি আর জাফরান মেশানো হয়- অপূর্ব গন্ধ ও স্বাদ। ২০০৪ সালে শেষবার সাক্ষাতের সময় ইফতেখার আনসারীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এতদিন কাশ্মীর ঘুরে মনে হচ্ছে কাশ্মীরীদের সামনে এখন তিনটি পথ খোলা আছে। এক. ভারতের সঙ্গে থাকা, দুই. পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা এবং তিন. স্বাধীন হওয়া। আপনি কোন অপশনের পক্ষে? তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন- শাহরিয়ার সাহেব, এই তিন অপশন আমাদের কে দিয়েছে, আপনি? আমি অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিলাম, জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই তিন অপশনের কথা আমার মনে হয়েছে। ইফতেখার আনসারী তিক্তকণ্ঠে বললেন, ভারত আর পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে ষাট বছর ধরে যুদ্ধ করছে, ছায়াযুদ্ধ করছে। পাকিস্তান বলছে, কাশ্মীর আমার। ভারত বলছে কাশ্মীর আমার। কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করছে না- তোমরা কী চাও? আমি তাকে জানালাম, কয়েক বছর ধরে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষকে আমি বার বার একটি প্রশ্নই করেছি- আপনারা কী চান, ‘আমন ইয়া আজাদী’, শান্তি না স্বাধীনতা? অধিকাংশ সাধারণ মানুষ বলেছেন, তারা শান্তি চান। তারা জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা চান। তারা চান ভূস্বর্গ কাশ্মীর আবার বিশ্ব পর্যটনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হোক। কাশ্মীরের স্বাধীনতার সম্ভাবনা সে ক্ষেত্রে কতটুকু? ইফতেখার আনসারী বললেন, কাশ্মীরের স্বাধীনতা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। এ কথা কেন বলছেন? ধরুন, কোন এক শুভ সকালে যদি দেখি কাশ্মীরের উভয় অংশ থেকে ভারত ও পাকিস্তান সৈন্য প্রত্যাহার করে আমাদের স্বাধীনতা প্রদান করেছে, এর পরদিন দেখব চীন কিংবা আমেরিকা সামরিক অভিযান চালিয়ে কাশ্মীর দখল করেছে। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও সামরিক গুরুত্বের কারণে কাশ্মীর কখনও স্বাধীন থাকতে পারবে না। তাহলে আপনার সামনে থাকছে দুটো অপশন, ভারতের সঙ্গে থাকা অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেয়া। আমি কখনও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষে নই। পাকিস্তান শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি- সবদিক থেকে ভারতের চেয়ে অনেক পেছনে পড়ে আছে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই, সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয় সেনাবাহিনীর দ্বারা। পক্ষান্তরে ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সব দিক থেকে পাকিস্তানের চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে। আমি ভারতের সঙ্গে থাকার পক্ষে। তবে আমি আরও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। মনে রাখতে হবে ভারত বিভিন্ন রাজ্যের সমন্বয়ে একটি ইউনিয়ন। কাশ্মীরের স্বাধীনতা নিয়ে আমি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে জেকেএলএফ (জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট) প্রধান আমানউল্লাহ খানের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। জেকেএলএফ-এর শাখা ভারতেও আছে, যার প্রধান ইয়াসিন মালিক। আগে দুই শাখা যৌথভাবে কাজ করলেও ১৯৯৫-এর পর ইয়াসিন মালিক জঙ্গী তৎপরতা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর জোর দিয়েছেন, যদিও স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করেননি। অন্যদিকে আমানউল্লাহ খান অবিভক্ত কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র জিহাদসহ যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। ২০১২ সালে তিনি আমাকে বলেছেন, কাশ্মীর সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে- পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি লাইন অব কন্ট্রোল মানেন না। বহুবার তিনি ভারতের কাশ্মীরে মুজাহেদীন পাঠিয়েছেন। পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে তথাকথিত আজাদ কাশ্মীরে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত চারবারের প্রেসিডেন্ট সর্দার আবদুল কাইয়ুম খান আমাকে বলেছেন, তিনি কাশ্মীরের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নন। তার মতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চৌধুরী রহমত আলী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রথম পাকিস্তান প্রস্তাবে বাংলাদেশের উল্লেখ ছিল না, পাঞ্জাবের পরই ছিল কাশ্মীরের নাম। তিনি গোটা কাশ্মীরের পাকিস্তান ভুক্তির পক্ষে। তিনি মনে করেন মহারাজা হরি সিং-কে ভারত ব্ল্যাকমেইল করে ভারত ভুক্তির চুক্তি করিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অন্তর্বর্তীকালীন কংগ্রেস সরকারের নেতৃবৃন্দ মহারাজা হরি সিংকে বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তান অথবা ভারত যে কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তবে যেহেতু তার রাজ্যের ৭৭% মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত, এটা উচিত হবে যে, সংযুক্তির পূর্বে মহারাজা যেন জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করা। কংগ্রেস নেতৃত্ব জানতেন কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবিসংবাদী নেতা হচ্ছেন শেখ আবদুল্লাহ। যিনি দীর্ঘকাল বৃটিশ শাসনের অবসানের পাশাপাশি কাশ্মীরে রাজন্যপ্রথা বিলোপের জন্যও সংগ্রাম করছিলেন। ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত শেখ আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্স ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মতো মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ- সকল ধর্মের মানুষের সমন্বয় ঘটিয়েছিল, যে সংগঠনের মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। শেখ আবদুল্লাহ নীতিগতভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিলেন এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য উদারপন্থী মুসলিম নেতাদের মতো বিশ্বাস করতেন, মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সামগ্রিকভাবে ভারতের মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহারাজা হরি সিং কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য পাকিস্তান ও ভারতের কাছে স্থিতি-অবস্থা বজায় রাখার চুক্তি করতে চাইলেন। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই মহারাজার সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি করেছিল। কিন্তু এর কিছুদিন পর পাকিস্তান কাশ্মীরে সব রকম জরুরী সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, যার ভেতর ছিল পেট্রোল, কেরোসিন, ভোজ্য তেল, ধাতব মুদ্রা, ব্যাংকনোট, লবণ ও খাদ্যসামগ্রী; যা এর আগে পাকিস্তান থেকে কাশ্মীরে যেতো। উদ্দেশ্য ছিল চাপ দিয়ে মহারাজাকে পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে আনা। মহারাজা হরি সিং এতে অসন্তুষ্ট হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে জানালেন, তাঁর সঙ্গে এ ধরনের বৈরী আচরণ করলে তিনি অন্যত্র সহযোগিতা চাইতে বাধ্য হবেন। কাশ্মীর দখল করার জন্য পাকিস্তান তখন বিপুলসংখ্যক পাঠান ও সীমান্তের অন্যান্য উপজাতিদের কাশ্মীরে পাঠায়। এদের মদদ দেয়ার জন্য কাশ্মীরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে ’৪৭-এর ২১ অক্টোবর রাতে। এর পর থেকে পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকারীরা ধীরে ধীরে কাশ্মীর গ্রাস করতে থাকে। পাকিস্তানী অনুপ্রবেশ এবং কাশ্মীরীদের ওপর পাঠানদের হামলা প্রতিহত করার জন্য মহারাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য কামনা করেন। কিন্তু ভারত তাঁকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, মহারাজা যতক্ষণ পর্যন্ত কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। ২৬ অক্টোবর মহারাজা হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২৭ অক্টোবর ভারতীয় সৈন্য কাশ্মীরের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৫১ সালে আইন সভায় কাশ্মীরের ভারতভুক্তি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা অনুমোদিত হয়। কাশ্মীর সমস্যা জাতিসংঘে প্রথম উত্থাপন করেছিল ভারত, পাকিস্তান নয়। ’৪৮-এর ১ জানুয়ারি ভারত তাদের অভিযোগ নিরাপত্তা পরিষদকে জানায়। ভারতের বক্তব্য ছিল কাশ্মীরে পাকিস্তানী সৈন্য ও পাকিস্তানী নাগরিকদের বিপুলসংখ্যক অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যে কাশ্মীর চুক্তিবলে ভারতের অন্তর্ভুক্ত। কাশ্মীর সীমান্তে ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারতই প্রথম জাতিসংঘে অভিযোগ জানায়। ভারতের এই অভিযোগের ভিত্তিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ‘ইউনাইটেড নেশনস কমিশন ফর ইণ্ডিয়া এ্যান্ড পাকিস্তান’ গঠন করে। এই কমিশনে পাকিস্তান প্রথমে পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকারীদের লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করলেও এ পর্যায়ে জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি স্যার জাফরউল্লাহ খান স্বীকার করেন যে, পাকিস্তানের তিন ব্রিগেড সৈন্য ’৪৮-এর মে মাস থেকে কাশ্মীরের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পাকিস্তানের মতে কাশ্মীরের মুসলমানদের ওপর হিন্দু রাজার অত্যাচার বন্ধ করার জন্য তারা সেখানে গেছে। জাতিসংঘ কমিশন কাশ্মীরের সার্বিক অবস্থা তদন্ত করে ’৪৮-এর ১৩ আগস্ট তিন পর্বের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবের প্রথম পর্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়। দ্বিতীয় পর্বে সকল পাকিস্তানী নাগরিক ও সেখানকার উপজাতিদের কাশ্মীরের ভূ-খন্ড থেকে পাকিস্তানে ফেরত নেয়ার কথা বলা হয়। এই দুটি পর্ব সম্পন্ন হলে তৃতীয় পর্যায়ে ভারতকেও তাদের সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ কাশ্মীর থেকে সরিয়ে নিয়ে কাশ্মীরের আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষার জন্য যে পরিমাণ সৈন্য রাখা দরকার তার অনুমোদন দেয়া হয়। এই প্রস্তাবের দ্বিতীয় পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল, কাশ্মীর থেকে পাকিস্তানী নাগরিক ও সৈন্য প্রত্যাহারের পর গণভোটে কাশ্মীরের জনসাধারণ তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। যেহেতু পাকিস্তান এই চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীরের একটি অংশ তাদের দখলমুক্ত করেনি, সেখানে এ বিষয়ে গণভোটও হয়নি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তাসখন্দ চুক্তি এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর সিমলা চুক্তিতে কাশ্মীরের গণভোটের বিষয় বাদ দিয়ে লাইন অব কন্ট্রোলকে মেনে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। ৬ আগস্ট (২০১৯) ভারতের পার্লামেন্টে ৩৭০ ধারা বাতিলের পক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে সরকারী দলের নেতারা জওহরলাল নেহরু এবং পরবর্তী কংগ্রেস সরকারের নমনীয় কাশ্মীর নীতির সমালোচনা করে বলেছেন, তারা গোটা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে। পাকিস্তান ও চীনের দখল থেকেও কাশ্মীরকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ অগ্রাহ্য করে ভারত যদি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর বা চীনের অধিকৃত আকসাই চীন দখল করতে যায় তাহলে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা নাকচ করে দেয়া যাবে না। ৩৭০ ধারা বাতিল তখন বুমেরাং হতে পারে। (ক্রমশ.)
×