ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

লাখ লাখ হাজীর চোখের জলে সিক্ত আরাফাত ময়দান

জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যের ডাক

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ১১ আগস্ট ২০১৯

 জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যের ডাক

আজাদ সুলায়মান ॥ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর জুলুম ও নির্যাতনকারীদের আল্লাহর হেদায়েত কামনা করে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান বিন আব্দুর রহমান আল-শাইখ। তিনি বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোরান হাদিসের আলোকে করণীয় দিক নির্দেশনা দেন। খুতবায় তিনি সারাজাহানের মুসলিমদের তাকওয়া ও রাসুলের আদর্শে বলীয়ান হয়ে দু’জাহানের কল্যাণে নিয়োজিত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইসলাম শিক্ষা দেয়, মানুষের প্রতি মানুষের দয়ামায়া, উদারতা প্রদর্শন, ধৈর্য ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা সহানুভূতির মাধ্যমেই আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়। এ রহমতেই মুক্তি মিলে ইহকাল ও পরকালের। মসজিদে নামিরা থেকে খুতবা গোটা আরাফাতে শোনা না গেলেও মুসল্লিরা রেডিও এবং টিভির মাধ্যমে শুনেছেন গুরুত্বপূর্ণ এ খুতবা। তিনি খুতবায় সারাজাহানের মুসলিম উম্মাহর শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। এ সময় পাপমুক্তি ও আল্লাহর খাস রহমতের আশায় লাখ লাখ মুসল্লির চোখের জলে সিক্ত হয়েছে আরাফাতের ময়দান। দু’হাত তুলে এক সঙ্গে প্রায় ২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। শনিবার দিনভর আরাফাতে অবস্থানের মাধ্যমেই সম্পন্ন হলো পবিত্র হজ। বুখারী মুসলিম শরীফে রয়েছে-মকবুল হজের প্রতিদান একমাত্র জান্নাত। এদিন আরাফাতের ময়দানে লাখ লাখ হাজীর উদ্দেশে শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান আল-শাইখ বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা আজ নিষ্পেষিত ও নিগৃহীত। এদের রক্ষা করতে হলে মুসলমানদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাস, হিংসা, বিদ্বেষ নয়-কেবল আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর নির্দেশিত পথেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ সময় লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক ধ্বনিতে পাপমুক্তি ও আল্লাহর খাস রহমতের আশায় লাখ লাখ মুসল্লির চোখের জলে সিক্ত হয়েছে আরাফাতের ময়দান। দুই হাত তুলে এক সঙ্গে প্রায় ২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। মোনাজাতে বার বার উঠে এসেছে, সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিময় পৃথিবী গড়ার। সৌদি আরবের প্রেস এজেন্সি এএসপি সূত্রে জানা যায়, হারামাইন আশ-শরিফাইনের খাদেম বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সৌদ এক রাজকীয় ফরমান জারির মাধ্যমে এ বছর আরাফাতের ময়দানে খতিব হিসেবে শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান আল-শাইখকে নিয়োগ দেন। শাইখ ড. মুহাম্মদ বিন হাসান আল-শাইখ সর্বোচ্চ উলামা বোর্ডের সদস্য এবং খাদেমুল হারামাইন শরিফাইন হাদিস কমপ্লেক্সের প্রধান শাইখ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮১ সাল থেকে আরাফার ময়দানের খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন দৃষ্টিহীন ইমাম শাইখ আবদুল আজিজ। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে অবসরে গিয়েছেন। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো হজের খুতবা প্রদান করেন শাইখ আবদুর রহমান আস-সুদাইস। ২০১৮ সালে আরাফার ময়দানে হজের খুতবা প্রদান করেন বিচারপতি শাইখ হুসাইন ইবনে আবদুল আজিজ ইবনে হাসান। স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ খুতবা শুরু হয়। বিশ্বের ১৮০টি দেশ থেকে আগত প্রায় ২৫ লাখ মুসলমান আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়ে এ খুতবা শোনেন। হজ ব্যবস্থাপনায় সৌদি আরবের গৃহীত যাবতীয় পদক্ষেপের প্রশংসা করেন এবং মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে রাজ পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান মুফতি। সন্ধ্যায় (সূর্যাস্তের পর) হাজীরা মুজদালিফার উদ্দেশে আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করেন। মুজদালিফায় পৌঁছে আবারও এক আজানে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন। সেখান থেকে জামারায় (প্রতীকী শয়তান)-কে নিক্ষেপের জন্য কঙ্কর (ছোট পাথর) সংগ্রহ করেন। আজ রবিবার মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজীদের কেউ ট্রেনে, কেউ গাড়িতে, কেউ হেঁটে মিনায় যাবেন এবং নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানের উদ্দেশে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (মাথা ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরো কাপড় বদল করবেন। এর পর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। কাবা শরীফের সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ (সাতবার দৌড়াবেন) করবেন। সেখান থেকে তারা আবার মিনায় যাবেন। মিনায় আরও এক বা দুই দিন অবস্থান করে হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করবেন। এর পর আবার মক্কায় ফিরে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। আগে যারা মদিনায় যাননি, তারা বিদায়ী তাওয়াফের পর মদিনায় যাবেন। যারা আগে মদিনায় গেছেন, তারা নিজ নিজ দেশে ফিরবেন। এবারও কয়েকটি স্যাটেলাইট চ্যানেল সৌদিয়া টেলিভিশনের কল্যাণে আরাফাতের ময়দান থেকে খুতবা ও দোয়া সরাসরি সম্প্রচার করে। এতে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মানুষ আরাফাতের হজের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। জানা যায়, এবার আরাফাতের ময়দানে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় হজের সামগ্রিক কর্মকা--তদারকি করা হয়েছে। বাংলাদেশের হাজীদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট চিহ্নিত স্থানের খিমায় রাখার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে অনেকেই আখেরি মোনাজাত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজ নিজ স্বজনদের কাছে সরাসরি সম্প্রচার করেছেন। এতে বাংলাদেশে অবস্থান করেও অনেকে মোনাজাতে অংশ নেন বলে জানা যায়। সৌদি হজ মন্ত্রণালয় ও মোয়াচ্ছাসা কার্যালয় সূত্র জানায়, মক্কা, মিনা ও আরাফাতের ময়দানে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সব হাজীকে বিনামূল্যে খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হাজীদের নানা উপহার দিচ্ছে। জানা যায়, পবিত্র হজ পালন করতে এসে এ পর্যত ৪৫ বাংলাদেশীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সব হাজী সুস্থ আছেন। হজ মিশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে হজযাত্রীদের সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করা হয়। ফোন করা হলে আরাফাতের ময়দান থেকে শনিবার সন্ধ্যায় আলহাজ মাওলানা আখতারুজ্জমান জনকণ্ঠকে বলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালভাবেই সম্পন্ন হলো বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৮০টি দেশের মুসলমানদের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত এবাদত হজ। এর মধ্যে বাংলাদেশের ১ লাখ ২৭ হাজার মুসলিম হজ পালনের সৌভাগ্য অর্জন করেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে এত বিপুলসংখ্যক হজযাত্রীর কণ্ঠে ছিল দোয়া-মোনাজাত-জিকির। মসজিদে নামিরার খতিব খুতবা পাঠের সময় সমস্ত হাজীই ছিলেন আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন। তারা নিজ নিজ খিমায় বসে দিনভর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন দুনিয়াদারির ক্ষণস্থায়ী জীবনের মায়া। এদিকে মক্কা অঞ্চলের গবর্নর প্রিন্স খালিদ আল ফয়সাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, হাজীদের সেবা দিতে শত কোটি ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন তারা। মিনায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, অতিথিদের স্বস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে তারা কুণ্ঠিত নন। ফয়সাল আরও জানান, হাজীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে সাড়ে তিন লাখেরও বেশি সামরিক-বেসামরিক সদস্য এবং ৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবী মোতায়েন করা হয়েছে। রীতি অনুযায়ী, প্রতি বছর ৯ জিলহজ তারিখে মসজিদ আল হারাম-এ পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। সে রীতি মেনে এরইমধ্যে গিলাফ পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন গিলাফটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৭০ লাখ রিয়াল। বরাবরের মতোই ৬৭০ কেজি রেশমি কাপড়, ১২০ কেজি স্বর্ণ ও ১০০ কেজি রূপা দিয়ে তৈরি হয়েছে এটি।
×