ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যস্ত কামারশালা

লোহা পেটানোর শব্দ আগুনের স্ফুলিঙ্গ হাপরের আওয়াজ

প্রকাশিত: ১০:১৫, ১১ আগস্ট ২০১৯

লোহা পেটানোর শব্দ  আগুনের স্ফুলিঙ্গ হাপরের আওয়াজ

মোরসালিন মিজান ॥ ঈদ মানেই বড় উপলক্ষ। ব্যস্ততার শেষ নেই। একইরকম ব্যস্ততা এখন কামারশালায়। কোরবানির ঈদ বলেই দিন রাত কাজ। ছুরি চাকু দা এখন জরুরী উপকরণ। চাহিদা বেড়েছে। বাড়াতে হয়েছে কাজের গতিও। লোহা পেটানোর শব্দ। কয়লার আগুন। স্ফুলিঙ্গ। হাপরের আওয়াজ। সব মিলিয়ে দারুণ সরব হয়ে উঠেছে কামারশালাগুলো। রাজধানীর কাওরান বাজারের ছবিটি বিশেষ দৃশ্যমান। এখানে কামারদের বহু পুরনো সমাবেশ। গত চল্লিশ বছর ধরে দা বঁটি ছুরি চাকু তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। ৩০টির মতো দোকান। সকলেই এখন যারপরনাই ব্যস্ত। একসময় গ্রাম গঞ্জের কামাররা গৃহস্থালি সামগ্রী, কৃষি ও সেচ যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন। তাদের কাছে দা বঁটি কোদাল কুড়াল শাবল হাতুড়ির মতো প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সামগ্রী পাওয়া যেত। তেমনি পাওয়া যেত লাঙ্গলের ফলা কাস্তে নিড়ানি খুন্তি। তবে নতুন নতুন যন্ত্রের কাছে ক্রমশ হার মানছে ক্ষুদ্র শিল্প। রাজধানী শহর ঢাকার কাওরান বাজারে গৃহস্থালী সামগ্রীই বেশি তৈরি হয়। তবে বর্তমানে কামারদের সব মনোযোগ কোরবানির ঈদে। পশু জবাই ও মাংস তৈরিতে যত রকমের ছুরি চাকু দা ইত্যাদির প্রয়োজন হয়, সব তৈরি করছেন তারা। শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সবগুলো দোকান পাশাপাশি। সামনের দিকে ছুটি চাকু চাপাতির মতো ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেখে পিলে চমকে যায়। আর পেছনে কামারশালা। সেখানে কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। ছোট কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর আগুন। একটু নিভু নিভু মনে হলেই হাপরের সাহায্যে তা বাড়ানো হচ্ছে। দীর্ঘ সময় আগুনে পুড়ে লোহা নরম হতেই পেটাতে শুরু করছেন কামাররা। এভাবে পুড়ে পিটিয়ে বাঁকা করে সোজা করে লৌহজাত সামগ্রী তৈরি করছেন। জলে চুবিয়ে নিয়ে সেগুলো রাখা হচ্ছে দোকানের সামনের অংশে। প্রতিটি দোকানের সামনে এখন ভয়ঙ্কর সব ছুরি চাকু। বড় ও ভারি ভারি ছুরি বিশেষ কায়দায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বাকিগুলো নিচে। যথেষ্ট সাজানো। দোকানিরা জানালেন, সবচেয়ে বড় ছুরিটির নাম ‘জবাই ছুরি’। পশু জবাই করার জন্য বিশেষ উপযোগী করে বানানো। তাই জবাই ছুরি নাম। ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চির মতো লম্বা। সামনের অংশ হাতির সুরের মতো বাঁকানো। কিছুটা ওপরের দিকে উঠে গেছে। শক্ত হাতে ধরতে হয়। তাই কাঠের হাতল। এই ছুরির দাম ৪০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। মান অনুযায়ী এ দাম ওঠানামা করে। পশু জবাইয়ের পরের কাজটি চামড়া ছাড়নো। একটু সতর্কতার সঙ্গে করা চাই। এ জন্য ছোট এক ধরনের ছুরি পাওয়া যাচ্ছে। রোস্তম আলী নামের এক দোকানি জানালেন, এই ছুরির নাম ‘ছিলা ছুরি’। সংখ্যায় বেশি বলেই মনে হলো। কেন? জানতে চাইলে তিনি জানান, চামড়া ছাড়ানোর কাজটি একসঙ্গে চারজন বা ততোধিক ব্যক্তি করতে পারেন। এ জন্য ‘ছিলা ছুরি’ কয়েকটা কিনতে হয়। দাম প্রতিটি ৫০ থেকে ৮০ টাকা। কোনটির কাঠের হাতল। সে ক্ষেত্রে দাম ২২০ টাকা। মাঝারি সাইজের ছুরিটির নাম আবার ‘সাইজ ছুরি।’ দোকানিদের ভাষায়- এ ছুরি দিয়ে মাংস ‘সাইজ’ করা হয়। কুপিয়ে ‘সাইজ’ করার ব্যাপার আছে। একে তাই কোপ ছুরিও বলা হয়। কোন কোন দোকানি আবার বললেন, কামেলা ছুরি। এই ছুরির দাম ১০০ থেকে ৪০০ টাকা। গরুর হাড় কেটে ছোট করার কাজে চাপাতি ব্যবহার করা হয়। তাই বিভিন্ন আকারের চাপাতি তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছেন দোকানিরা। রেললাইনের রেল কেটে চাপাতি তৈরি করা হয়েছে। খুব ধারালো। দেড় কেজির মতো ওজন। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দাম। আছে গাড়ির স্প্রিংয়ে তৈরি চাপাতি। প্রায় একই কাজে ব্যবহৃত হয় চায়নিজ কোড়াল। চকচকে খুব। হাতলও কাঠের ফার্নিচারের মতো। দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। কোরবানির মাংস ঘরে আনার পর দরকার হয় দা বঁটির। কাওরান বাজারের প্রতিটি দোকানের সামনের অংশে তাই দা বঁটি খুব দেখা গেল। দায়ে ব্যবহৃত লোহার ওজন যত বেশি, দামও। ইউসুফ নামের এক দোকানি বললেন, ‘আমরা সারাবছরই কাজ করি। যেইসব জিনিস ভাল যায়, সেগুলো বানাই। এখন ধরেন যে, কোরবানির ঈদ। কাস্টমাররা গরু ছাগল কাটব, ছুরি দা’র দরকার আছে। তাই বেশি ব্যস্ততার মধ্যে যাইতেছি।’ ব্যস্ততা আছে ক্রেতাদেরও। এমন দেশীয় অস্ত্রের ধারে কাছে কোন ভদ্রলোকের যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু কোরবানির ঈদে যেতে হয়। যাচ্ছেন। লম্বা ছুরিতে আঙ্গুল ঘষে ধার কেমন, দেখছেন! সন্তুষ্ট হলে পরেই কিনছেন ছোট ছুরি, বড় ছুরি। হাতিরপুল থেকে আসা ক্রেতা হাবিুর রহমান বলছিলেন, এখানে এসে বিচিত্র ছুরি দেখে প্রথমে ভয় ধরে গিয়েছিল। কিন্তু কামাররা এত সহজে সব কিছু করছে দেখে একটি স্বস্তি বোধ করছি। সাধারণত দা বঁটিও হাতে নেয়া হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, কোরবানির ঈদ বলেই তিন জাতের ছুরি কিনে নিয়ে যাচ্ছি। আরেক ক্রেতা হিমেল এসেছিলেন মগবাজার থেকে। বয়সে তরুণ। বলছিলেন, আমাদের বাসার মুরব্বিরা গরু কিনতে গাবতলী হাটে গিয়েছে। আমি এসেছি মাংস কাটার দা কিনতে। তবে কেনার চেয়ে কামারদের দা তৈরি করার প্রক্রিয়া দেখে বেশি অভিভূত হয়েছেন বলে জানান তিনি। শেষ করা যাক নজরুলের কথা দিয়ে, কথা তো নয়, কবিতা। কবি সেখানে লিখেছেন : ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন। অন্য জায়গায় কবির উচ্চারণ- মনের পশুরে করো জবাই,/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই। হ্যাঁ, মনের ভেতরে যে পশুত্ব, সেটিকে আগে বদ করতে হবে। কোরবানি দিতে হবে। সেই অস্ত্র কি আছে আমাদের?
×