ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পবিত্র ঈদ-উল-আজহার তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১১ আগস্ট ২০১৯

 পবিত্র ঈদ-উল-আজহার তাৎপর্য

ঈদ-উল-আজহাকে কোরবানির ঈদ বলা হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে কোরবানি একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। ঈদ-উল-আজহার সঙ্গে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তার পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের স্মৃতি জডিয়ে আছে। হয়রত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে বলা হয় মুসলিম জাতির জনক। তিনি আল্লাহর নির্দেশে হজ প্রবর্তন করেন। তার বয়স যখন ৮০ বছর তখন তার প্রথম পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন। ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বয়স যখন ১০-১১ বছর তখন একদিন রাতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বপ্নে আদিষ্ট হন। তার প্রিয় পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য। তিনি পুত্রকে এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত শোনালে পুত্র জবাবে বলেন : আব্বা আপনি স্বপ্নে যা আদিষ্ট হয়েছেন আপনি তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। পিতা-পুত্র উভয়েই আল্লাহর আনুগত্য প্রদর্শন করেন। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা মুকাররমা থেকে ৩ মাইল পূর্বে অবস্থিত মিনা নামক স্থানে গমন করেন। পথিমধ্যে মক্কার সীমানা পাড়ি দিয়ে মিনা সীমানায় পৌঁছলে শয়তান এই কোরবানি না দেয়ার জন্য প্ররোচিত করে। তখন পিতা-পুত্র উভয়ই পাথর মেরে শয়তানকে তাড়িয়ে দেয়। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্রকে কাত করে শায়িত করে তার গলায় ছুরি চালাতে গিয়ে আল্লাহর তরফ থেকে বাধাগ্রস্ত হন। আল্লাহ বলেন : হে ইবরাহীম ক্ষান্ত হও। তুমি তো সত্যি সত্যিই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করলে। (সূরা সাফ্ফাত : ১০৪-০৫) আসলে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্য এটা একটা পরীক্ষা ছিল। আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের বদলে একটি জান্নাতী দুম্বা কোরবানি দেন। সেই থেকে পশু কোরবানি দেয়া চালু হয়। কোরবানি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে কুরব শব্দ মূল থেকে। কুরব শব্দের অর্থ নৈকট্য। আল্লাহ নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি দেয়া হয়। ইন্না সলাতি ওনুসুকি ওমাহইযা ইয়া ওমামাতি লিল্লাহি রব্বিল আলামীন- নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য। এই চেতনার স্ফুরণ ঘটে কোরবানির মাধ্যমে। মুসলিম জীবনে দুটি ঈদ রয়েছে। যার একটি ঈদ-উল-ফিতর অন্যটি ঈদ-উল-আজহা। ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হয় মাহে রমাদানুল মুবারকে এক মাস সিয়াম পালনের পরে ১লা শাওয়াল তারিখে। আর ঈদ-উল-আজহা উদযাপিত হয় ৯ জিলহজ হজ পালনের পর ১০ জিলহজ তারিখে। এই দুটো ঈদই প্রবর্তন করেছেন প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা)। আরেক ঈদ তার উম্মতেরা প্রবর্তন করেছেন তার জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্যে যাকে বলা হয় ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী। মুসলিম দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে নানা নামে এই উৎসব উদযাপিত হয়। মিসরে এই ঈদকে বলা হয় ঈদ-উল-বাকারা, সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশে এই ঈদকে ঈদ-ই-কোরবানি বলা হয়। তুরস্কে বলা হয় কুরবান বৈরাম, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশে এই ঈদকে সাধারণত কোরবানির ঈদ বলা হয়। কোরবানির পশুর মধ্যে রয়েছে গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট প্রভৃতি। উট এবং গরু সাতভাগে দেয়া যায়। ছাগল, ভেড়া একজনকেই দিতে হয়। কোরবানির পশু সম্পূর্ণ সুস্থ ও নিরোগ হতে হয়। ১০ জিলহজ ঈদের দিন ২ রাকাত ইদের সালাত আদায় করার পর পশু জবাই করে গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বন্টন করতে হয়। কোরবানির পশুর চামড়া গরিবদের মধ্যে সাদাকা হিসেবে দিয়ে দিতে হয়। যে সব মাদ্রাসায় কিংবা এতিমখানায় লিল্লাহ বোর্ডিং আছে সে সব মাদ্রাসা বা এতিমখানায় দেয়া যায়। কোরবানি দেয়া ওয়াজিব। এই ওয়াজিব সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য। হজের সময় ১০ জিলহজ আরাফাত ময়দান থেকে মিনায় এসে প্রথম কাজ ছোট শয়তানকে পাথর মারা। তারপর পশু কোরবানি দিয়ে মাথা মু-ন করা। এই পশু কোরবানি প্রযোজ্য শুধুমাত্র হজে কিরান ও হজে তামান্ডু নিয়তকারীদের জন্য। তাদের জন্য এই কোরবানি ওয়াজিব। কিন্তু হজে ইফরাদকারীদের জন্য এটা ওয়াজিব নয়। দশ জিলহজ তারিখে কোরবানি দিতে হয়। অবশ্য ১১-১২ তারিখ পর্যন্ত কোরবানি দেয়া যায়। ঈদ-উল-আজহার সালাত আদায় করতে যাওয়ার সময় সশব্দে আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিম হামদ। এর অর্থ আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান এবং তারই জন্য যাবতীয় প্রশংসা। ঈদ-উল-আজহা মুসলিম দুনিয়ার বড় আনন্দ উৎসব এর মধ্যে ঐক্য ও সংহতির আবেদন রয়েছে প্রকটভাবে। ঈদ-উল-আজহা বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষের প্রাণস্পন্দনকে প্রবল শক্তির জোয়ারে দৃঢ় প্রত্যয়ী করে তোলে এবং অনুপ্রাণিত করে সাংস্কৃতিক নিজস্বতা ও ঐতিহ্যগত আদর্শ সংরক্ষণে ঐকবদ্ধ হওয়ার। ঈদ-উল-আজহা শুধু বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয় বিশ্ব মুসলিম সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফ
×