ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

টুং টাং শব্দে মুখরিত কাওরান বাজারের কামার পল্লী

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ১১ আগস্ট ২০১৯

 টুং টাং শব্দে মুখরিত কাওরান বাজারের কামার পল্লী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ঈদ সামনে রেখে কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। টুং টাং শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে রাজধানীর কাওরান বাজারের কামার পল্লী। কোরবানির পশু জবাই ও গোশত প্রস্তুতে ব্যবহৃত দা, বঁটি, ছুরিসহ প্রয়োজনীয় অন্যসব উপকরণ তৈরিতে এখন দিনরাত কাজ করছেন শ্রমিকরা। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে জ্বলছে কামার দোকানের চুলার আগুন। কাওরান বাজার কামার পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে টুং টাং শব্দ। কেউ ভারি হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছেন দগদগে লাল লোহার খ-, আবার কেউ শান দিচ্ছেন ছুরি কিংবা বঁটি, কেউবা আবার কয়লার আগুনে বাতাস দিচ্ছেন। কোরবানির সময় তাদের আয় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তাই সারাবছর এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকেন তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোরবানির এক মাস আগে থেকেই পশু জবাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। এছাড়া বছরের অন্য সময় বিল্ডিং তৈরির হ্যান্ডেল, হাতুড়িসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরিতে তারা ব্যস্ত থাকেন। কাওরান বাজার এলাকায় ৪০টির মতো কামারের দোকান আছে। প্রতি দোকানে কারিগরসহ গড়ে চারজন কাজ করেন। তবে ঈদের সময় প্রতি দোকানে ছয় থেকে সাতজন লোক লাগে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদের সময় তাদের বেচা-বিক্রি ভাল হয়। তারা সাধারণত পাঁচ ধরনের বঁটি, ছয় রকমের দা, ১৬ ধরনের ছুরি, সাত ধরনের কাবাব ছুরি, ২০ ধরনের চাপাতি, ১২ ধরনের জবাই ছুরি তৈরি করেন তারা। এছাড়া কুঠার ও ধার দেয়ার জন্য এক ধরনের স্টিকও বিক্রি করেন। প্রকারভেদে বঁটির দাম চার শ’ থেকে সাড়ে চার হাজার, গরু জবাইয়ের ছুরি পাঁচ শ’ থেকে ১৮শ’, চাপাতি ছয় শ’ থেকে দুই হাজার, কাবাব ছুরি পাঁচ শ’ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া অন্যান্য ছুরি দুই শ’ থেকে পাঁচ শ’ টাকায় বিক্রি করা হয়। কুঠার সাধারণত কেজিদরে বিক্রি হয়। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় ঈদ সিজনে প্রতিটি পণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। দোকানিরা জানান, কোরবানির ১০ দিন আগে বঁটি, দা, ছুরির বিক্রি বেড়ে যায়। এ সময় গড়ে এক লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়। আর চাঁদ রাতে এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ভাল লোহার বঁটি সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা দাম পড়ে। আর সবচেয়ে ভাল ছুরি দুই হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। কিছু জিনিস আছে কেজিদরে বিক্রি হয়। তিনি আরও জানান, ঈদের ১০ দিন আগে থেকে বিক্রি ভাল হয়। এ সময় দোকানভেদে এক লাখ টাকার চেয়েও বেশি বিক্রি করতে পারে। আর চাঁদ রাতে কেউ কেউ দুই-তিন লাখ টাকাও বিক্রি করেন। তবে এ শিল্পের কাঁচামাল সঙ্কট ও উচ্চমূল্য এবং পণ্যের ভাল দাম না পাওয়ায় অনেকেই পেশা ছাড়ছেন। এছাড়া এ পেশার প্রতি সাধারণ মানুষের সম্মান না থাকায় অনেকে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে এ কাজ থেকে দূরে রেখেছেন। কামার মানিক (৬২) বলেন, পৈত্রিক পেশা হিসেবে লোহা পেটানোর কাজ করে আসছি। বৃদ্ধ বয়সেও কাজ করে যাচ্ছি। তবে আমার সন্তানদের কেউ এ পেশায় আসেনি এবং তাদের আসতেও বলিনি। কারণ লোহা-কয়লার দাম যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে আমাদের তৈরি পণ্যের দাম বাড়েনি। এছাড়া কামারদের মানুষ এখন আর সম্মান দেয় না। তিনি আরও বলেন, কয়লা খনির কয়লা আমরা এখন পাই না। গাছের কয়লা দিয়ে কাজ করতে হয়। আগে ১২শ’ টাকা দিয়ে এক বস্তা কয়লা কিনতে পারতাম, এখন লাগে ২ হাজার টাকা। খনির কয়লা দিয়ে সহজে কাজ করা যেত, কিন্তু গাছের কয়লায় কাজ করতে কষ্ট হয়, লোহার দামও বেড়ে গেছে। এসব কারণে অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। কামার মোঃ নাসিম বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে এই পেশায় আছি। আমি বাবার কাছ থেকে কাজ শিখেছি। তবে আমরা ছেলে-মেয়েদের এই পেশায় আনছি না। কারণ এখানে পরিশ্রমের তুলনায় আয় অনেক কম। তিনি বলেন, ঈদের সিজনে ভাল ইনকাম হয়। ঈদের ১০-১২ দিন আগে থেকে দৈনিক তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় করা যায়। অন্যসময়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকি। কাওরান বাজার কামার পল্লী ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, লোহা, কয়লাসহ এই শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম এখন বেড়ে গেছে। বেশি দাম দিয়েও আবার মানসম্পন্ন কাঁচামাল পাওয়া যায় না। যে কারণে পরিশ্রম এবং খরচের তুলনায় আয় কম হয়। এসব কারণে কাজের সঙ্গে জড়িতরা পেশা ছেড়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। তবে কোরবানির হাতিয়ার এখনও তেমনভাবে বিক্রি শুরু না হওয়ায় জমে ওঠেনি কামার বাজার। সবাই পশু কিনতে ব্যস্ত থাকায় এখনও দা-ছুরি ক্রয় শুরু করেননি ঢাকাবাসীরা। কাওরান বাজারের এক দোকানদার জানান, এখনও বিক্রির ধুম পড়েনি, ক্রেতার সমাগমও কম। শনিবার বিকেল থেকে বিক্রি বাড়বে বলে আশা করি। কাওরান বাজারের জেরিন হার্ডওয়ারের দোকানদার জুয়েল বলেন, আমাদের এখানে তৈরি করা চাপাতি ৫০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে কাঁচা লোহার চাপাতির দাম একটু কম। পাকা লোহার বা ইস্পাতের তৈরি জিনিসের দাম বেশি। পাকা লোহার তৈরি জিনিসের চাহিদাও বেশি। এখানে আবার বিভিন্ন দামের চায়না, কুড়িয়ান এবং থাইল্যান্ডের চাপাতিও রয়েছে। তিনি আরও বলেন, পশু জবাইয়ের জন্য মাঝারি থেকে বড় ছুরির দাম সাড়ে ৪শ’ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চামড়া ছাড়ানোর ছুরি ১৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। এছাড়া সাধারণ ছুরির দাম ৯০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে। দা-বঁটির দাম নির্ভর করে ওজনের ওপর। কামারপট্টিতে বানানো ছাড়াও রাজধানীর সুপারশপগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানির ছুরি, কাঁচি, কুড়াল পাওয়া যাচ্ছে। নিউমার্কেটে ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে নানা রকমের ছুরি। চাপাতি পাওয়া যাচ্ছে ৫০০ থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে। জাপানী ছুরি ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, চাইনিজ কুড়াল আকার অনুযায়ী ৩০০ টাকা থেকে ১২৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কাওরান বাজারের মা জননী কর্মশালের দোকানদার সুমন হাওলাদার বলেন, আমাদের এখানে পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ১০০ থেকে ২০০ টাকা, দা ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা, বঁটি ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা, পশু জবাইয়ের ছুরি ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চাপাতি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া আকার ও লোহার ওজনের ওপর দাম কম-বেশি রয়েছে। প্রকাশ ম-ল নামে একজন বলেন, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে আমাদের বিক্রি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ঈদের দুইদিন আগে থেকে ২৪ ঘণ্টা বেচাকেনা চলে। তখন আমাদের খাওয়া-দাওয়ারও সময় থাকে না। একই দোকানের আরও একজন বলেন, লোহা ও শ্রমিকের মূল্য বেড়ে গেছে, সে কারণে চাপাতি, ছুরি ও দায়ের দাম একটু বেশি। বেশি দামে বিক্রি না হলে আমাদের লাভ হয় না। মগবাজার থেকে কাওরান বাজারে আসা শফিকুল ইসলাম বলেন, ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কামাররা তাদের মজুরিসহ ছুরি, দা, চাপাতির দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি চাপাতি কিনেছি ৭০০ টাকায় এবং ছুরি আড়াই শ’ টাকায় কিনলাম। যেসব জিনিস দেড়-দুই মাস আগে অনেক কম দাম ছিল।
×