ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গরু নিয়ে নানা কথা- ইতিহাস কথা কয়...

গোয়ালঘর ছেড়ে এখন ডেইরি ফার্মে, বিদেশী বীর্যে দেশী গরু

প্রকাশিত: ০৮:১৮, ১১ আগস্ট ২০১৯

গোয়ালঘর ছেড়ে এখন ডেইরি ফার্মে, বিদেশী বীর্যে দেশী গরু

সমুদ্র হক, বগুড়া ॥ মানব বন্দনায় লালন সাঁইয়ের কথা ও সুর ‘নানা বরণ গাভী রে ভাই একই বরণ দুধ। জগৎ ভ্রমিয়া দেখলাম সবই একই মায়ের পুত...।’ পুরাণ থেকে আজ পর্যন্ত গরু নিয়ে বহু ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। কোরবানির আগে গরু সবসময়ই ‘হটকেক’। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বহুকাল ধরে মানুষ আর গরু মিলেমিশে আছে। মানুষ থাকে বাসগৃহে, গরু থাকে সংলগ্ন গোয়াল ঘরে। কৃষির বিবর্তনে গোয়াল ঘর দখল করেছে পাওয়ার টিলার। গরুর আবাস হয়েছে ডেইরি ফার্ম। বাংলা ভাষায় গরু এসেছে নানা ভাবে। গো অর্থ গাড়ি, গো-রুত অর্থ গরুর ধ্বনি (হাম্বা হাম্বা)। গরুর নাম অনেক। স্ত্রী বাচক- গাভী, গাই, ধেনু। পুরুষবাচক- ষ‍াড় , ষাঁড়, দামড়া, বৃষ, বলদ, বলীর্বাদ, রোমন্থক ইত্যাদি। গরুর সম্পৃক্ততা মানব কুলেও এসেছে। কন্যাকে যেমন কখনও বলা হয় দুহিতা। দুহিতা এসেছে গাভী দোহন থেকে। একটা সময় নারী গাভী দোহন করত। সেই... মেয়েদের বলা হতো দুহিতা। গো নিয়ে আছে অনেক শব্দ। যেমন গোয়ালা, গোবেচারা (নিরীহ মানুষ), গোপ, গবাক্ষ, গোগ্রাস, গোধূলী, গোধন ইত্যাদি। দুধ, দই, ঘি, গোময় (গোবর) ও গোমূত্র এই পাঁচ পদে পঞ্চগব্য। দেশজুড়ে এখন বন্দী গরুর ছোটাছুটি। ট্রাকে, পিকআপে, শ্যালো চালিত যান ও নৌকায় রাজধানীসহ প্রতিটি হাটে জড়ো করা হচ্ছে। গরুকে সাজানোও হয়েছে। লাল কাপড়ের টিকলি, শিঙে রঙের প্রলেপ, গলায় জরির ও রঙিন কাগজের মালা। সবার মুখে এখন গরু। টিভির পর্দায়, সংবাদপত্রের পাতায় গরুর ছবি। বলাবলি হয় ‘ভাই আপনি গরু না ছাগল!’ অন্য সময় পিটুনির অভাব হতো না। ঈদের আগে বুঝে নিতে হয়- কী কোরবানি দেবেন, গরু না ছাগল? গরুর খাঁটুনি এখন অনেক কমেছে। খায়দায়, বসে থাকে, ঘুরে বেড়ায়, চরে বেড়ায়। লাঙলের হালে জোঁয়াল টানতে হয় না। সর্ষে ভাঙ্গার ঘানি টানতে হয় না। আঁটি থেকে ধান বের করতে কয়েক পাক ঘুরতে হয় না। এবড়োথেবড়ো রাস্তা দিয়ে গাড়ি (গরুর গাড়ি) টানতে হয় না। এসেছে কলের লাঙল, যন্ত্রচালিত যান, পাকা সড়ক। গরুর এখন মহানন্দ। শুধু কোরবানির ঈদের সময়ই নিরানন্দ! গরুর আবার প্রকার ভেদে আছে: ফ্রিজিয়ানা, সিন্ধি, লাল সিন্ধি, সাহিওয়াল, হলস্টোন, হরিয়ানা, লোলা, অমৃতমহল, সুলতানি, মন্টগোমারী, আয়ারশায়ার, থরপর্কার, জার্সি, গীর, কাথিয়াবাড়ি, কাংবেজ... কত যে নাম। বিদেশী গরুর বীর্যে কৃত্রিম প্রজননে ডেইরি ফার্মগুলোতে পালিত হচ্ছে গরু। মানুষের মুখে মুখে গরু যেমন- গরুর মতো খাটতে খাটতে জীবনটাই বরবাদ। কলুর বলদের মতো খাটতে হচ্ছে। কোন কিছু খোঁজার সময় বলা হয় গরুখোঁজা। গবেষণার আরেক অর্থ গরুখোঁজা। বাগি¦বিধিতে আছে- কাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই, দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল, গরু মেরে জুতোদান, ধর্মের ষাঁড়, দানের গরু বাড়ি পর্যন্ত গেলেই হলো, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, গরু জরু ধান রাজ্য বিদ্যমান, কানা গরু বামুনকে দান, গোধন, শকুনের শাপে গরু মরে না...’ গরু নিয়ে কত যে কথা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেষের’ প্রতি গফুরের ভালোবাসার কাহিনী কালজয়ী হয়ে আছে। কবিতায় আছে ‘রাখাল গরুর পাল নিয়ে যায় মাঠে’। চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় আজও রাখাল গরুর পাল মাঠে ও পদ্মার চরে নিয়ে চরায়। গরু নিয়ে নানা কাহিনী বর্ণিত আছে পুরাণে। সুমের সভ্যতা থেকে গরু তার শ্রম অস্থিমজ্জা, মাংস, চর্ম, মল, মূত্র যাবতীয় কিছু মানব কল্যাণে দান করেছে। প্রাচীন ভারতে গরু সম্পদ। নামকরণ হয় গোধন। অতীতে রাজা মহারাজারা গরু পুষতেন। মহাভারতে আছে- দুর্যোধন দ্রোনাচার্য ও ভীষ্মকে সঙ্গে নিয়ে বিরাট রাজার গোধনে হানা দিয়েছিল। সীতার পিতা জানক রাজা শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মর্ষি খুঁজতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এক ঋষির সঙ্গে কেউই টিকতে পারেনি। সেই ঋষি প্রবর খেতাব পেলেন শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মর্ষির। তাকে সোনা দিয়ে শিং বাঁধানো এক হাজার গরু পুরস্কার দেয়া হয়। কালিদাসের মেঘদূতে গরু এসেছে চর্মস্বতী নদীর কথায়। অবশ্য গরুকে দেবতার আসনে প্রথম বসিয়েছে মিসরীয়রা। রানী ক্লিওপেট্রা গরু পুষতেন। পরম যতনে পালন করতেন। পদ্মফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতেন গরু রাখার স্থান। আর্যদের কাছে গরু ছিল পূজিত। বিষ্ণুর প্রতীক গরু। মহাদেবের পছন্দের বাহন বৃষ (গরু)। সেই গরু আর এই গরু কোরবানির ঈদে আলোচিত। এই সময় দেশজুড়ে মানুষের সঙ্গে গরু। হাটে মানুষ আর গরু একসঙ্গে। মানুষ হাট থেকে গরু কিনে নিয়ে যায় শহর নগর ও গ্রামের বাড়িতে। সেখানে গরুর কয়েক ঘণ্টার শেষ আশ্রয়। যতটা পারা যায় ভাল খাবার দিয়ে শেষ আপ্যায়ন। তারপর মনের সকল ধরনের পশুত্ব ঘুঁচিয়ে দিতে গরুকে দেয়া হয় কোরবানি।
×