ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মারিয়া ইসলাম সেতু

ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানি আরামকো!

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ১১ আগস্ট ২০১৯

 ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানি আরামকো!

১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। শিল্প বিপ্লবের বদৌলতে স্টিম প্রযুক্তির দিন শেষ। তার জায়গাটি দখল করে নিয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি। থেমে নেই বিকল্প সম্পদের উৎস খোঁজার কাজ। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে আগামীতে তেলই হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই তেলই হবে ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের মাঝে যুদ্ধ, রক্তারক্তির কারণ। আর তারই প্রেক্ষিতে ১৯ শতকের শুরুর দিকে দুনিয়াজুড়ে শুরু হয় তেল খোঁজার কাজ। ঠিক যেমন এক সময় স্বর্ণ খুঁজতে দিগি¦দিক ছুটেছিল মানুষ। সৌদি আরবে তেল খোঁজার কাজ শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর শুরুতে। প্রথম দুই যুগ বিচ্ছিন্নভাবে ছোটখাট বেশকিছু অনুসন্ধান চলে। অটোমানদের হাতছাড়া হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে সৌদি স্থিতিশীল হওয়ার পর শুরু হয় ব্যাপক অনুসন্ধান। সৌদিতে তেলের সন্ধান সর্বপ্রথম পায় মার্কিনরা। ১৯৩৩ সালে আমেরিকান কোম্পানি ‘স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া (Casoc)’ আরবে তেল অনুসন্ধানের জন্য তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আবদুল আজীজের কাছে অনুমতি চায়। ঘাওয়ার তেল ক্ষেত্র আবিষ্কারের পর আমির তাদের সেই অনুমতি দেন। মার্কিন কোম্পানিটির সঙ্গে সৌদি সরকারের এই চুক্তির ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় এরাবিয়ান আমেরিকান অয়েল কোম্পানি (এরামকো)। চুক্তি অনুযায়ী সৌদি সরকারকে প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ডসহ আয় অনুযায়ী অর্থ দেয়ার অঙ্গীকার করে আরামকো। বিনিময়ে সৌদি সরকার তাদের কিছু এলাকায় একচেটিয়া তেল অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়। স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানি আমিরের কাছে গাইড হিসেবে একজন মরুবিশেষজ্ঞকে চায় তাদের কাজের সহায়তার জন্য। আমির ‘খামিস বিন রিমছান’ নামের এক বেদুঈনকে গাইড হিসেবে নিয়োগ করেন। উল্লেখ্য, ভূ-তত্ত্ববিদ না হলেও ছেলেবেলা থেকে মরুর বুকে বেড়ে ওঠায় এই বেদুঈনের ছিল এক আশ্চর্য ক্ষমতা। মরুভূমির বালুর ধরন দেখেই কোথায় তেলের পরিমাণ কেমন তা তিনি বুঝতে পারতেন। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে রিমছানই ‘দাম্মাম ৭ নম্বর’ চিহ্নিত তেলের খনিটি আবিষ্কার করেন। পরের বছরই তেল রফতানি শুরু করে কোম্পানিটি। ১৯৪৪ সালে ঈধংড়প-এর নাম বদলে হয়ে যায় আরামকো (Arabian American Oil Compa)। ১৯৫০ সালে সৌদি বাদশাহ আবদুল আজীজ এরামকোকে জাতীয়করণের হুমকি দেন। তাই এরামকো তাদের লভ্যাংশ সৌদি সরকারের সঙ্গে আধা-আধিভাবে ভাগ করতে রাজি হয়। ১৯৫১ সালে সমুদ্রে তেলের খনি খুঁজে পায় আরামকো। সাফানিয়া তেলক্ষেত্র বিশ্বের অন্যতম সামুদ্রিক তেলক্ষেত্র। ১৯৬২ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন ব্যারেলে পৌঁছায় তাদের তেল উৎপাদন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে আরব ইসরাইলের যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষ নিলে সৌদি সরকার এরামকোর ২৫ শতাংশ শেয়ার নিয়ে নেয়। ১৯৭৪ সাল নাগাদ সৌদি সরকারের শেয়ার বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ শতাংশে। অর্থাৎ সৌদি সরকারই তখন আরামকোর সর্বেসর্বা। এভাবে আস্তে আস্তে আশির দশক নাগাদ পুরো কোম্পানিকেই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসে সৌদি সরকার। ১৯৮৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরামকো নামে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে এই ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানিটি। এই মুহূর্তে সৌদি আরামকোর তেলের রিজার্ভ ২৬১ বিলিয়ন ব্যারেল। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এক্সনের তেলের রিজার্ভ হচ্ছে ১৩ বিলিয়ন ব্যারেল। তাদের হাতে কি পরিমাণ তেল আছে সেটা বোঝাতে ছোট্ট একটা উদাহারণ দেয়া যেতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশের সারা বছরে তেল খরচ হয় ৪৯ লাখ ব্যারেল। বিশ্বের তেলের বাজারের ১২ শতাংশ আরামকো একাই নিয়ন্ত্রণ করে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র দিনে ১ মিলিয়ন ব্যারেলের বেশি তেল কিনে থাকে এই কোম্পানির কাছ থেকে। তাদের গ্যাসের রিজার্ভ আছে ৩১৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। সব মিলে এই কোম্পানির বাজারমূল্য দুই ট্রিলিয়ন হতে তিন ট্রিলিয়ন ডলার যেটা প্রযুক্তি জায়ান্ট এ্যাপলের অন্তত দিগুণ বা তার বেশি। ধারণা করা হয় সৌদি সরকারের কর থেকে আয়ের ৯৩ শতাংশই আরামকোর। তবে একদিন ভূগর্ভের সম্পদ শেষ হবে। সেদিন হয়ত আজকের পৃথিবী শাসন করা আরামকো বিলুপ্ত হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি শেষ হলে কি হবে এই প্রশ্ন এরই মধ্যে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে সৌদির শাসকদের মধ্যে। উত্তর জানা যাবে কয়েক শতক পর!
×