ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১১ আগস্ট ২০১৯

ঈদ অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

রমজানের ঈদের দুই মাস যেতে না যেতেই ঘরে ঘরে কোরবানির ঈদের আমেজ শুরু হয়ে যায়। পশু কোরবানির মাধ্যমে লোভ, লালসা আর মনের পশুকে দূর করে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। তাই কোরবানিকে ঘিরে চাঙ্গা হয়ে ওঠে এ দেশের অর্থনীতি। প্রতিবছরই আসন্ন কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বছরের শুরুতেই গরুর খামারিরা গবাদী পশু মোটাতাজাকরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কোরবানির ঈদকে ঘিরে এ সময় গরু খামারগুলো ব্যস্ত সময় পার করে। গরু বিক্রির জন্য খামারিরা কোরবানি ঈদের ২০ দিন আগে থেকেই ছোট, বড় ও মাঝারি সাইজের গরুগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্থানে রাখতে শুরু করে। কেননা, গরুর হাটের ঝক্কিঝামেলা এড়াতে আর ভাল মানের গরু পেতে অনেকেই খামারে এসে পছন্দমতো গরু বায়না করে রেখে যান। এক্ষেত্রে, অবিক্রীত গরুগুলো খামারিরা গরুর হাটে তোলেন। গত বছর কোরবানির ঈদে কোরবানিযোগ্য পশুর চাহিদার চেয়ে যোগান বেশি ছিল। সারাদেশে কোরবানিতে সাধারণত ১ কোটি ১০ লাখ পশুর চাহিদা থাকলেও ২০১৭ সালের কোরবানিতে জবাই হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ ২২ হাজার পশু। মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে পবিত্র কোরবানির ঈদে কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার পশু। পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমার থেকেও কোরবানির পশু আমদানি হওয়ায় পশুর দাম তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তাছাড়া বৃষ্টির কারণে দাম পড়ে যাওয়ায় খামারিরা চাঁদরাতের জন্য অপেক্ষা করেও কাঙ্খিত দামে গরু বিক্রি করতে না পারায় অনেক খামারিরই গরু অবিক্রীত ছিল। কোরবানির চামড়া : প্রতি বছর ঈদুল আজহায় পশুর চামড়া কেনাবেচায় প্রচুর অর্থ লেনদেন হয়। বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের বড় তিনটি সংগঠন হলোÑ ‘বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন’ (বিএফএলএফইএ), ‘বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (বিটিএ) এবং ‘বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশন’ (বিএইচএসএমএ)। এরাই মূলত চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করে আসছে। পাশাপাশি লাখ লাখ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এ সময় জড়িয়ে পড়েন চামড়া কেনায়। এছাড়া ট্যানারি শিল্পের মালিক, মাদ্রাসা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই ঈদে পশুর চামড়া ক্রয় করেন। ফলে অভ্যন্তরীণ এই বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে সংগৃহীত ৩১ কোটি ৫০ লাখ বর্গফুট পশুর চামড়ার মধ্যে ১৯ কোটি বর্গফুট চামড়াই পাওয়া গেছে কোরবানির মৌসুমে। গত বছর কোরবানির মৌসুমে প্রায় ২০ কোটি বর্গফুট চামড়া সংগ্রহ করা হয় যার ৩০ শতাংশ চামড়াই সংগ্রহ করে রাজধানীর লালবাগ পোস্তার চামড়া আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। ২০১৮ সালে ট্যানারি মালিকরা অর্থ সঙ্কটে থাকলেও পাচাররোধে বেঁধে দেয়া মূল্যেই চামড়া বেচাকেনা করেন। তবে কোথাও কোথাও নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। চামড়ার এ ধরনের দরপতনকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেন ট্যানারি মালিকরা। এবারের কোরবানির ঈদকে ঘিরেও প্রচুর গরু বেচাকেনা হবে। তাই চামড়াও অনেক সংগ্রহ করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তবে কোরবানির সময় অসতর্কতা ও না জানার কারণে প্রায় ৩৩০ কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হয়। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন করা গেলে ২০২১ সাল নাগাদ চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রফতানি ৫ বিলিয়ন ডলার উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করেন চামড়া রফতানিকারক ও ট্যানারি মালিকরা। ব্যাংক ঋণ : কোরবানির ঈদ কাঁচা চামড়া সরবরাহের বড় উৎস। তাই চামড়া ব্যবসায়ীদের বিশেষ ঋণ দেয়ার উদ্যোগ থাকে সরকারী ব্যাংকগুলোর। তবে চামড়া খাতে দেয়া ঋণ সহজে আদায় হয় না বলে বেসরকারী ব্যাংকগুলো এই ঋণ প্রদানে তেমন আগ্রহী হয় না। সর্বশেষ ২০১৮ সালে চামড়াখাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তাই গত বছর নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেছে এমন প্রতিষ্ঠানকেই ঋণ প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো তাই গত ঈদে ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৬৯১ কোটি টাকা। মৌসুমী কর্মসংস্থান ও অপরাধপ্রবণতা : ঈদকে ঘিরে শহর ও গ্রামে প্রচুর মৌসুমি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটে। রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে পণ্য উৎপাদনের ধুম পড়ে। রাস্তার আনাচে-কানাচে অথবা ফুটপাথ দখল করে বসে ঈদের টুপি, পোশাক, জুতা, কসমেটিকসহ নানা ধরনের অস্থায়ী দোকান। আর কোরবানির ঈদে দা, বঁটি, ছুরি, মসলার অস্থায়ী দোকানগুলো বেশি নজরে পড়ে। দুই ঈদেই পার্লারগুলো এ সময় ব্যস্ত সময় পার করে। পরিবহন ব্যবস্থা, ঝুঁকি ও দুর্ঘটনা : প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ঘরমুখো মানুষ বাস, লঞ্চ ট্রেনের টিকিট পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। ঈদে ঘরমুখো মানুষ যাতে নির্বিঘেœ বাড়ি যেতে পারেন, কোন যাত্রী যেন হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার না হয় সেজন্য সরকার পর্যাপ্ত পুলিশের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা করেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় পরিবহন যান কম হওয়ায় ঈদযাত্রায় বাড়তি ভাড়ার কারণে যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। অন্যদিকে টিকিট না পেলে নাড়ির টানে ঘরে ফিরতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ বাস, ট্রেন বা লঞ্চের ছাদে করে আপন নীড়ে ফিরতে চেষ্টা করে। ধারণক্ষমতার ৩-৪ গুণ বেশি যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে রওনা দেয়া ট্রেন দুর্ঘটনা এড়াতে ধীরগতিতে চলে। ঈদের দিন ও ঈদের পরের দিন ফাঁকা রাস্তায় দুর্ঘটনার হার অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। কেননা, এ সময় রাস্তা ফাঁকা পেয়ে অনেকেই ফুলস্পিডে গাড়ি চালানোর সময় প্রয়োজনে গাড়ির ব্রেক টানতে না পারলে প্রাণহানি ঘটে। গত বছরে দুই ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। আমাদের দেশে ট্রেন, বাস, লঞ্চ সর্বোপরি যাত্রাপথে দুর্ঘটনার হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। মানুষের জীবন ও চলাচল নিরাপদ করতে তাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নীতিমালার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশে ‘জনসম্পদই’ দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে যাত্রীবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে এদেশের ঈদ অর্থনীতির আকার আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি এদেশকে মধ্যম আয়ের একটি দেশে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
×