ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

প্রকাশিত: ১১:০৯, ১০ আগস্ট ২০১৯

 লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ হজ কোরবানি পর্ব অনুষ্ঠানগুলোতে জড়িয়ে আছে এক মহান পয়গম্বরের পরিবারের স্মৃতিগাথা। তা থেকে শিক্ষা গ্রহণই ঈদ-উল-আজহা উদযাপনের সার্থকতা। আজ আমরা এখানে মহান ইবরাহীম পরিবারের (আ.) দুজন সদস্যের কথা তুলে ধরব। তারা হলেন মা হাজেরা ও পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)। মানুষের মন সর্বদা পরিবর্তনশীল। চিরদিন কারো মনের ভাব একরূপ থাকে না। মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মনের অবস্থায়ও পরিবর্তিত হয়ে যায়। দেখুন অনেক অভাবী লোক অভাবের তাড়নায় ঠিকমতো আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে মনোনিবেশ করতে পারছে না বলে নিজেরা মনে করে। তারা বলে আমার যদি যথেষ্ট টাকা পয়সা থাকত, যদি পেটের চিন্তায়, সন্তান-সন্তুতির ভরণ পোষণের চিন্তায় আমাকে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে না হতো, তা হলে এক মনে এক ধ্যানে সর্বদা আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি করে কাটাতাম। কিন্তু পরক্ষণে যখন সে আল্লাহ প্রদত্ত প্রচুর ধন দৌলতের অধিকারী হয়, তখন কি আর অতীতের কথা মনে থাকে? তখন আকাক্সক্ষা বেড়ে যায় বহুগুণে। কোন্ কোন্ উপায়ে আরও অধিক সম্পদ হাসিল করা যায় সে চিন্তায় সে বিভোর থাকে। ইব্রাহীমের (আ.) বিবি সারার মনের ভাবও আর পূর্বের মতো থাকেনি। সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এক সময় বিবি সারা নিঃসন্তান হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে একরূপ জোর করে মিসরের রাজকন্যা হাজেরার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করায়। কিন্তু আজ তিনি অন্য ভাব প্রদর্শন করছেন। বিবি সারা প্রকাশ্যে বলছেন, স্বামী! আমার জন্য যদি আপনার প্রকৃত দরদ থাকে, তবে পুত্র ইসমাঈলসহ হাজেরাকে (বিজন তরুলতা ও পানিহীন মরু প্রান্তরে) নির্বাসিত করুন। সারার মুখে এরূপ অপ্রত্যাশিত কথা শুনে হযরত ইব্রাহীম মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। হযরতকে এভাবে চিন্তিত দেখে তার প্রতি আল্লাহ আদেশ পাঠালেন: হে আমার খলীল! চিন্তার কোন কারণ নেই, সারার কথানুযায়ী আপনি আপনার স্ত্রী হাজেরা ও শিশু পুত্র ইসমাঈলকে নির্বাসিত করুন। সুবহানাল্লাহ! এ আর এক চরম পরীক্ষা। হ্যাঁ, এ পরীক্ষাও শেষ নয়, আরও অনেক পরীক্ষা ও ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিহাস সম্মুখে রয়েছে। যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি আল্লাহর খলীল উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ইবরাহীমও বুঝতে পারেননি আল্লাহর মহান উদ্দেশ্য; আর বিবি হাজেরাই বা তা কি করে বুঝবেন? তথাপি তারা উভয়েই প্রস্তুত হলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) প্রস্তুত আল্লাহ পাকের আদেশ পালন করতে। বিবি সারা এবার মনে মনে খুব আনন্দিত হলেন। কিন্তু তিনি জানেন না যে, এ অভিশাপই হাজেরার জন্য একদিন নেমে আসবে আল্লাহর অশেষ রহমত হয়ে। বিবি হাজেরাও জানেন না যে, তিনি আল্লাহর অসীম রহমত লুটে লওয়ার জন্য রওনা হয়েছেন অজানার পথে। তাফসিরে খাজেন ও তাফসিরে ইবনে কাসিরে উল্লেখ আছে, ধু ধু বালুকাময় মরু প্রান্তরে ফারান নামক স্থানে (যা আজ ইতিহাসে মক্কাতুল হারাম নামে পরিচিত) এসে তিনি উপনীত হলেন। একটু বিশ্রামের পর তাদের রেখে তিনি বিদায় নেয়ার মনস্থ করলেন। তাই যৎসামান্য খেজুর ও এক মশক পানি ছিল তা তাদের দিয়ে তিনি চলে যেতে লাগলেন। তখন বিবি হাজেরা এ বলে চিৎকার করে উঠলেন, হে আল্লাহর খলীল! আমাদের কার আশ্রয়ে ফেলে যাচ্ছেন? এ বিজন মরুতে আমাদের কে দেখাশোনা করবে? এবার ইব্রাহীম (আ.) উত্তর দিলেন, আল্লাহকে সোপর্দ করে যাচ্ছি, তিনিই তোমাদের সব কিছু দেখবেন এবং তোমাদের রক্ষা করবেন। অতঃপর হাজেরা জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের এখানে রেখে যাচ্ছেন কি আল্লাহর হুকুমে? ইব্রাহীম (আ.) উত্তর দিলেন: হ্যাঁ আল্লাহর হুকুমে। তৎপর নবী পত্মী মহা গুণবতী ধৈর্যশীলা হাজেরা আপন মনকে সান্ত¦না দিয়ে স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তা হলে আপনি চলে যান। মেহেরবান আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না। হাজেরা এমন বলেননি যে, আল্লাহ আপনাকে এরূপ হুকুম কেন দিলেন? বরং আল্লাহর হুকুম- এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা শিরোধার্য করে নিলেন। এতে বুঝা যায়, শরীয়তের কোন হুকুম পালনে কেন বা কি কারণে বলে কোন প্রশ্ন করা মোটেই ঠিক নয়। এভাবে হাজেরার গর্ভজাত সন্তান ইসমাঈলও তাঁর পিতা তাকে জবাই করার স্বপ্ন বলার পর তিনি কেন বা কি কারণে জবাই করার হুকুম দিলেন, এ প্রশ্ন তোলেননি। বরং আল্লাহর হুকুম- এ শোনামাত্র শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন। আর এটাই খাঁটি ইমানদারের পরিচয়। হযরত ইসমাঈল (আ.) এ পবিত্র জিলহজ মাসে হজ ও কোরবানির মৌসুমে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র ও ভক্তির সঙ্গে স্মরণীয় আদর্শ পুরুষ। তিনিই আল্লাহর হুকুম পালনে এবং মহান পিতার নির্দেশ পালনে শানিত তলোয়ারের নিচে নিজের মস্তক পেতে দিয়ে দুনিয়ার বুকে ধৈর্য ও আনুগত্যের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
×