ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহ্যের সঙ্গে শখ আর সামর্থ্যরে সম্মিলন

পুরান ঢাকাবাসীর প্রিয় মিরকাদিমের ধবল গরু

প্রকাশিত: ১০:০০, ১০ আগস্ট ২০১৯

পুরান ঢাকাবাসীর প্রিয় মিরকাদিমের ধবল গরু

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভা। এক সময় বলা হতো ‘দ্বিতীয় কলকাতা’। ইছামতি আর ধলেশ্বরীর তীরে তার বাস। গয়নার নৌকায় দেশ-বিদেশে তার বাণিজ্য ছিল। ওপারেই তো নারায়ণগঞ্জ, বাংলার ‘ড্যান্ডি’। মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম দ্বিতীয় কলকাতার মর্যাদা হারাল। তবে আবার ধবল গরু দিয়ে নাম ছড়াল মিরকাদিমের। পুরান ঢাকাবাসীর কাছে প্রিয় এ ধবল গরুর সুনাম দেশ জুড়েই। কিন্তু মিরকাদিমের সেই ধবল গরুর দিন ফুরাচ্ছে। কেন হারিয়ে যাচ্ছে মিরকাদিমের গরুর দিন-এমন প্রশ্ন অনেকের। সরেজমিনে ঘুরে এসে ধবল গরুর দিন ফুরিয়ে আসার চিত্র তুলে ধরা হলো। একশ বছর ধরে শহরের প্রায় বাড়িতেই ছিল মিরকাদিমের গরু। এমনও দিন গেছে, প্রতিটি গোয়ালেই ৩০ থেকে ৫০টি গরু পর্যন্ত পালা হয়েছে। এখন কেবল নগর কসবা, টেঙ্গর, নৈদীঘির পাথর, কমলাঘাট, রিকাবীবাজার এলাকার পেশাদার গরুর ব্যাপারিরা ধবল গরু পালছেন। তারা এই গরুগুলো কিনছেন আসলে ফরিদপুরের টেপাখোলা, পাড়া গ্রাম ও মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থেকে। রোজার ঈদের পর সেগুলো কেনেন, প্রতিটি গরুর বয়স থাকে আড়াই থেকে তিন বছর। টানা আট মাস থেকে এক বছর ধরে সন্তানের মতো যত্নে সেগুলোকে লালন-পালন করেন। পরে পুরান ঢাকার বিখ্যাত রহমতগঞ্জ স্পোটিং ক্লাবের মাঠ রহমতগঞ্জ মাঠে বিক্রি করেন ভাল দামে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শহরের প্রায় সব এলাকাতেই অনেকগুলো পরিবার এই ধবল গরু লালন-পালন ও কোরবানির জন্য সেগুলো বিক্রির ব্যবসা করছেন। একদিকে তাদের লাভ হচ্ছে, অন্যদিকে সওয়াবও পাচ্ছেন। তবে আগের মতো মিরকাদিমের গাভী, ষাঁড়ের আগের দিন নেই। ‘সাদা গরু’ হারিয়ে যাচ্ছে। কেন? সেই খোঁজেই গেলাম শহরের অলি-গলির বাসা বাড়িতে। এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে জানা গেল, এখন মাত্র ১২ পরিবার ধরে রেখেছেন পূর্বপুরুষের পেশাটি। কেন তারা নেই? সে অনেক গল্প। মিরকাদিমের গরুর সবচেয়ে বড় সুনাম এর মাংস খুব সুস্বাদু। পুরো গরুটিই দেখতে অসাধারণ। এক ফোঁটা দাগও থাকে না তার সাদা শরীরে। খুব মোটাতাজা, শক্তিশালীও বটে। সেই গরুর ব্যবসা ধরে রেখেছেন নগর কসবার ফকির চান পরিবার। ৪০ বছর মিরকাদিমের গরুর ব্যাপারি ছিলেন তিনি। তবে মাস তিনেক আগে তার মৃত্যু ঘটেছে। এবার বাবার হয়ে তার দুই ছেলে আক্তার ও মঞ্জুর হোসেন গরুগুলো লালন-পালন করছেন। সঙ্গে তাদের মা সালেহা বেগম আছেন সব কাজে। তিনি জানেন, কীভাবে তার স্বামী গরুগুলো পালতেন। চারটি গরুকেই তাই তারা সন্তানের মমতায় লালন-পালন করছেন। এত আদর ও ভালবাসায় থেকে সেগুলো তাদের দেয়া নামে ডাকলেই সাড়া দিচ্ছে। যখনই বলছেন, ‘সুন্দরী’-মাথা উঁচু করছে, লেজ নাড়িয়ে ডাক ছাড়ছে ওরা। গরুগুলোর পেছনে তাদের অনেক কষ্ট জমা হচ্ছে। প্রতিদিন একবার পাইপ দিয়ে পুরো গরুকে গোসল করাতে হচ্ছে। সেটি খুব ঝক্কির কাজ। আবার সেগুলোর গা মুছে দিতে হচ্ছে লাল গামছা দিয়ে। কারও নজর যেন না লাগে, সেজন্য আলাদা জায়গাতে ঘের দেয়া অবস্থায় গরুগুলোকে রাখা হচ্ছে। নজর লাগলেও মিরকাদিমের বিখ্যাত গাভী বা ষাঁড়ের ওজন কমে যেতে পারে, রোগে ধরতে পারে, খেতে রাজি না হতে পারে-শত শত বছর ধরে বিশ্বাস করছেন তারা এগুলো। গোয়ালঘরে গরুর গোবরও পড়ে থাকতে দিচ্ছেন না, রোগ হতে পারে, তাতে তার শরীরে দাগ লেগে যেতে পারে। তবে সালেহা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল-আসলে কেন গত পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে এই বিখ্যাত গাভী, ষাঁড়ের বাজার মন্দা! গরুগুলোর দাম চড়েছে অনেক। ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও এক একটি ধবল গরুর বাছুর কিনতে খরচ হতো ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এখন সেগুলোর এক একটির দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। যাতায়াতের খরচ আছে। বাড়িতে এনে এক একটি ষাঁড় কী গাভীকে খৈল, ভুসি, চালের খুদসহ গম, ভুট্টা, খেসারির ভুসির মতো ভাল গো-খাদ্য খাওয়াতে হয়। এক কি দুই ঘণ্টা পর পর প্রয়োজন মতো সেগুলো খায় তারা। প্রতিদিন গরু প্রতি চার থেকে ছয়শ’ টাকা খরচ হয়। কিনে আনার পর এক বছরে ছয়শ টাকা দরে খাবারের পেছনে মোট ২ লাখ ১৯ হাজার টাকা খরচ হয় গরু প্রতি। এত টাকার খাবার, যত্ন ও অমানুষিক পরিশ্রমের পর বিক্রি করে তেমন কোন লাভ থাকে না। আগে যেখানে মাঠ ছিল, বিল ছিল আশপাশে; শহর গড়ে ওঠায় সেই খাবারগুলোও আর তেমন পাওয়া যায় না। বাজারে সেই খাবারগুলোর দামও অনেক। গো-খাদ্যের সঙ্গে এসব বিশেষ খাবার মিশিয়ে খাওয়াতে হয় মিরকাদিমের বিখ্যাত গরুগুলোকে। ফলে এখন বাজারের খৈল, ভুসি ইত্যাদিই ভরসা তাদের। প্রতিদিন গরুগুলোকে পশু চিকিৎসক দেখাতে হয়। সেই খরচও আছে। এসব দিয়ে, খাবারের দাম বাড়ায় ও ক্রেতার অভাবে আগের মতো লাভ নেই বলে পুরান, বনেদী ও পূর্বপুরুষের এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন একে একে প্রায় পুরো মিরকাদিমবাসীই। তাদেরও দোষ দেয়া যায় না। রহমতগঞ্জের হাটে যখন কোরবানির দুই দিন আগে তারা গরু নিয়ে যান, অনেক ক্রেতাই থাকেন। তবে তারা আড়াই, তিন লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনতে রাজি হন না। যদিও জানেন, এই গরুগুলোর মাংসের তুলনা নেই। তখন দামে না পেরে তারা ফিরে যান ভারতীয় কি ভুটানি গরুর কাছে। সেগুলো একই আয়তনের, দাম অনেক কম থাকে। আর বাড়িতে এসে এবার চালিয়ে নাও-দাম বেশি বলার পর তো আর পূর্বপুরুষের মতো এই গরুগুলো কেনা কেন হয়নি জানতে চান না স্বজনেরা। ফলে দাম ও বাজার এমনকি ঐতিহ্য হারাচ্ছেন পুরো বাংলাদেশের মানুষ। তারপরও তারা আছেন। জানেন, মিরকাদিমের গরু ফেরে না। বিক্রি হয়ই। সালেহা বেগমের সন্তান মঞ্জুর হোসেন বললেন, ‘হাটে গিয়ে গরু পাবেন কি না, ছেলেমেয়ে ও বাড়ির ছোট সন্তানেরা এখনই গরুর জন্য বায়না ধরেছে বলে আমাদের বাড়িতে গরু দেখা ও কেনার জন্য পুরান ঢাকার ক্রেতারা এসে পড়তে শুরু করেছেন। তবে সবচেয়ে বড়, বেশ ভাল গরুর জন্য আমরা বলছি, আড়াই লাখ; বাকি তিনটির দাম ওজন ও আকার দেখে বলছি-এক লাখ ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা, কিন্তু সেই টাকায় এখনও রাজি নন ক্রেতারা। ফলে তারা ফিরে গেছেন।’ তারা পড়েছেন চিন্তায়। এসব কারণেই আসলে মিরকাদিমের গরুর খামারিদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তেমনই একজন আবদুল খালেক। টেঙ্গর পাড়াতে থাকেন। তার জীবনই ছিল রহমতগঞ্জের কোরবানির হাট ও মিরকাদিমের গরু নিয়ে। একসময় রমরমা জীবনে ৩০-৩৫টি গরুও পেলেছেন নামকরা এই মানুষটি। সন্তান স্নেহে যাদের বড় করেছেন, তারা তাকে সচ্ছলতা দিয়েছে; সন্তানদের মানুষ করার সুযোগ করে দিয়েছে। তবে তিনি আর নেই। বয়সের ভারে মৃত্যুবরণ করেছেন। বসতবাড়ির পুরোটাই আলাদা গোয়াল ঘর বানিয়ে একসময় তারা এক কোণে থাকতেন; সেই দিনও হারিয়েছে। তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে একমাত্র চাঁদ সওদাগরই বাবার ব্যবসা ধরে রেখেছিলেন। তিনিও মারা গেছেন ১০ বছর হলো। তার সাত সন্তানের পাঁচজনই ছেলে। তারা মানুষের মতো মানুষ হয়েছেন। ফলে বাবার ব্যবসায় একমাত্র কামাল উদ্দিন ছাড়া কেউ আসেননি। এবার তিনি আর পারছেন না। মাত্র তিনটি গরু নিয়ে ব্যবসা করছেন। গেল বছরও পাঁচটি গরু পেলেছেন। লাভ কম, খাটুনি অনেক বলে তারও চিন্তার শেষ নেই। গরু কেনার পেছনেই এবার তার খরচ হয়েছে ৯০ হাজার, এক লাখ ১০ ও এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। ‘ভাল মানের গরুর বাছুরের দামও অনেক বেড়েছে’- লাল গামছাতে গরুকে মুছিয়ে বললেন কামাল। এখন এগুলো বিক্রি করে কেমন লাভ হবে তিনি আর জানেন না। ‘দিনে তো এক দেড় হাজার টাকা গরুর পেছনেই চলে যাচ্ছে। দাম উঠবে আর কত’-প্রশ্নটি করতে ভুললেন না। ‘পরিশ্রমের কথা বাদই দিলাম’ মনের কষ্টে বলে ফেললেন। তবে আশা এখনো ছাড়েননি, ‘পুরান ঢাকার কয়েকজন বনেদী ব্যবসায়ী আমার গরু এসে দেখে গেছেন। তারা গরুগুলো পছন্দ করেছেন, কিন্তু দামে আরেকটু বনার অপেক্ষায় আছি। তাহলে ৯০ হাজারেরটি সব খরচ ও আমার শ্রম মিলিয়ে দেড় লাখে, এক লাখ দশেরটি এক লাখ ৭০ ও এক লাখ ৩০ হাজারের গরু দুই লাখ ১০-এ বিক্রি করতে পারব। আমার জীবন বাঁচবে, পেশাও থাকবে।’ গরুগুলোর জন্য আগের মতো জায়গা দিতে পারেন না তারা। গোয়াল ঘর নেই, কবেই গেছে; বসত বাড়ি হয়ে ছেয়ে গেছে অন্যরকম। বাড়ির পাশের ছোট একটি জায়গা-এক কি দুই বা বড়জোড় তিন কাঠা জমিতে তারা গরু পালছেন। ফলে পেলেও শান্তি নেই। এক বা দুটি গরুতে কি আর খুব বেশি লাভ হয়। দরকার হয় অনেকগুলো। তাতে শ্রম দিয়ে গরু বিক্রিতে লাভ বেশি, বাজারও ভাল থাকে। সেসব আফসোস এখন ঘুরে মরছে এই বিখ্যাত ব্যাপারিদের বাড়িতে। ফলে শত বছরের ঐতিহ্যটি টিকে আছে ফকির চান, কামাল উদ্দিন, মনির, মোস্তফা ও আনোয়ারদের মতো হাতেগোনা ক’টি পরিবারের বাড়িতে।
×