ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাড়া জাগানো সাইবার হামলা

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১০ আগস্ট ২০১৯

সাড়া জাগানো সাইবার হামলা

২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উপর সাইবার হামলাকে এযাবতকালের সব থেকে বড় হামলা বলে মনে করা হয়। এই হামলার ফলে প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কে যে ভাইরাস ছড়িয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ দূর করতে ১৪ মাস লেগে গিয়েছিল। ঘটনার শুরু সামান্য এক পেনড্রাইভ থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের এক সামরিক ঘাঁটির পার্কিং লটে পড়ে ছিল একটা পেনড্রাইভ। সেটা এনে একজন ল্যাপটপে যুক্ত করতেই ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাস। ল্যাপটপটি প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কে যুক্ত ছিল ফলে ভাইরাস ছড়িয়ে যায় পেন্টাগন পর্যন্ত। অপারেশন বাকশট ইয়াঙ্কি নামের প্রতিরোধমূলক অপারেশন শুরু করে মার্কিন সরকার। এই ভাইরাসটি কম্পিউটারের তথ্য পাচার করতে পারত। ধারণা করা হয় এর পেছনে রাশিয়ানদের হাত আছে। ২০১০ সাল। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ঘোষণা করলেন তার দেশ আশি শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম পরিশোধন করতে সক্ষম। তবে তিনি এটাও বলেন তার দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না। কিন্তু এই কথায় ভরসা পায় না পশ্চিমারা। আন্তর্জাতিক চাপ, অবরোধ এবং কূটচাল যখন চলছিল তখন তেল আবিব এবং পেন্টাগন নতুন এক অস্ত্র প্রয়োগের কথা ভাবে। পরের বছর জানা গেল অজ্ঞাত এক ভাইরাস হানা দিয়েছে ইরানের নাতানস পরমাণু প্রকল্প কেন্দ্রে। ইন্টারনেট সংযোগ নেই এমন কম্পিউটারকে বোধহয় ভাইরাস আক্রান্ত করতে পারে না। সেবার এই ধারণাই বদলে দেয় স্টাক্সনেট নামের এই ভাইরাস। স্টাক্সনেট ভাইরাসের তান্ডবে ধ্বংস হয় ওই কেন্দ্র্রের কয়েক হাজার সেন্ট্রিফিউজ। পিছিয়ে যায় ইরানের অগ্রগতি। ইরান বা পশ্চিমা কোন পক্ষই এই নিয়ে বেশি কথা বলে না। ২০১১ সালে প্যারিসে জি২০ সম্মেলন লক্ষ্য করে চালানো হয় এক সাইবার হামলা। সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন সব ফাইল হাতিয়ে নিতে চলে এই হামলা। ১ লাখের বেশি কম্পিউটার আক্রান্ত হয়। ফ্রান্স সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে এই হামলার কথা স্বীকার করে নেয়। সরাসরি কাউকে দায়ী না করে ‘একটি এশিয়ান রাষ্ট্রের’ কথা জানায় ফ্রেঞ্চরা। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কিছু ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে অপারেশন নিউজ ক্যাস্টার শুরু করে ইরান। এই অপারেশনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে উচ্চপদে থাকা মার্কিনীদের টার্গেট করা হতো। মূল লক্ষ্য ছিল সামরিক অফিসাররা বিশেষত নৌ-অফিসাররা। ইরান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অন্তত ১৪টি নকল প্রোফাইল বানায় যেগুলো দেখে কারোই বোঝার উপায় ছিল না সেগুলো নকল। এই নকল প্রোফাইলগুলো নিজেদের মিডিয়া ব্যক্তি বলে দাবি করে এবং মার্কিনীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সামাজিক মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি থেকে তাদের রুটিন এবং সামরিক অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। অন্তত ২ হাজার মানুষকে এভাবে লক্ষ্য বানানো হয়েছিল। ১৪টি প্রোফাইলের কথা নিশ্চিত হলেও ধারণা করা হয় এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ২০১৪ সালে ইরানের আরেকটি সাইবার অপারেশনের কথা সামনে আসে। ১৫টি দেশের ৫০টির বেশি কৌশলগত কোম্পানির উপর হামলা এবং নজরদারি চালিয়েছে ইরান- এমনটি দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিল সাইবার ফার্ম সাইলেন্স। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ তেল গ্যাস জ্বালানি কোম্পানিগুলো এই অপারেশনের শিকার হয়েছিল। ২০০৯ সাল নাগাদ চীনের নির্বাসিত নেতা দালাই লামার ভারতের অফিস লক্ষ্য করে একটা বড় সাইবার হামলা শনাক্ত করা হয়। জানা যায় তার অফিসের আক্রান্ত কম্পিউটারগুলো থেকে গোপনে সব ফাইল চুরি করা হচ্ছিল। এছাড়াও কূটনৈতিক বেশ কিছু স্পর্শকাতর তথ্য চুরি হয় এই হামলায়। ধারণা হয় হয় চীন এই হামলার পেছনে জড়িত। ২০১৫ সালের জুনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিস পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট (যারা বেসামরিক সকল সরকারী কর্মীর দেখভাল করে) হামলার শিকার হয়। ৪ মিলিয়ন মানুষের তথ্য হাতিয়ে দেয় হ্যাকাররা। চুরি করা ফাইলের সংখ্যা সাড়ে একুশ মিলিয়ন। পদত্যাগ করেন সংস্থাটির পরিচালক। ২০৭ সাল নাগাদ এফবিআই একজন চাইনিজকে গ্রেফতার করে। ধারণা করা হয় চীনের গোয়েন্দাদের মদদে এই হামলা চালানো হয়েছিল। ২০১৮ সালের মার্চে ব্রিটেনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঠিকাদারি কাজ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানের উপর নজরদারির অভিযোগ ওঠে চীনের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে তারা হামলা চালিয়ে ইরানের মিসাইল ব্যবস্থা অচল করে দিয়েছে। যদিও ইরান জানায় এই হামলা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। ২০০৭ সালে এস্তোনিয়াতে একজন সোভিয়েত সেনার কবর সরানো নিয়ে চটে যায় রাশিয়া। কয়েক দিন ধরে চলে এস্তোনিয়ার উপর ভয়াবহ সাইবার হামলা। দেশটির জনপ্রশাসন একেবারে স্থবির হয়ে যায় এই হামলায়। পরের বছর একই ধাঁচে আক্রান্ত হয় জর্জিয়া। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ইরানের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জ্বালানি এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোতে সাইবার হামলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের সরকার সমর্থিত হ্যাকাররা এই কাজের সঙ্গে জড়িত। বিগত বছরগুলোতে রাশিয়ার সরকারের মদদপুষ্ট হ্যাকারদের আনাগোনা বেড়েছে। ইইউ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউরোপজুড়ে মে মাসে সাইবার হামলা, ইউক্রেনে প্রতিনিয়ত সাইবার হামলা এবং সৌদি পেট্রোকেমিক্যাল স্থাপনার কম্পিউটারে হানা দেয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালের জুনে চাইনিজ হ্যাকাররা একজন মার্কিন সামরিক ঠিকাদারদের কম্পিউটার নেটওয়ার্কে হানা দেয়। অস্ত্র, সেন্সর এবং যোগাযোগের আধুনিক যন্ত্র সম্পর্কিত ৬১৪ গিগাবাইট ফাইল চুরি করে তারা। সরকারী মদদে হ্যাকিংয়ের আঙ্গুল উঠেছে ভিয়েতনামের দিকেও। ২০১৭ সালে বেশকিছু অটোমোবাইল কোম্পানির নক্সা চুরি করতে সাইবার অপারেশন চালায় তারা। উত্তর কোরিয়া যেন কোন রাখঢাক ছাড়াই সাইবার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার উপর হামলা, পরের বছরই সনি হ্যাক, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি এবং ভয়াবহ ভাইরাস ওয়ানাক্রাইয়ের পেছনে যে উত্তর কোরিয়ার হাত আছে এটা নিশ্চিত। অন্তত ৪০০০ হ্যাকার আছে দেশটির। সাইবার হামলার মাধ্যমে দেশটি ৬৭০ মিলিয়ন ডলার চুরি করেছে বলে ধারণা করা হয়। প্রতিপক্ষ দক্ষিণের সাইবার কম্যান্ডের সার্ভারও হ্যাক করেছিল তারা।
×