ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং নৌ-কমান্ডো

প্রকাশিত: ১১:৫০, ৯ আগস্ট ২০১৯

অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং নৌ-কমান্ডো

১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট দিনটি ছিল সোমবার। এদিন ২নং সেক্টরের পানিয়ারুপ নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী হানাদার সেনাদের এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ্যামবুশ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। বগুড়া জেলার সাবগ্রামে গেরিলা বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে পাকবাহিনীর ৫ জন সৈন্য নিহত ও ৬ জন আহত হয়। পাকহানাদার বাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার শিবগঞ্জ থানায় মুক্তিবাহিনীর কালিবাড়ী অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীকে প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে কালিবাড়ী অবস্থান ত্যাগ করতে হয়। পিরোজপুরে মুক্তিবাহিনী কাউখালি থানা আক্রমণ করে। এই অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা কাউখালি থানা ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। এই দিন ড. এম মনসুর আলী শেষবারের মতো ভারত চলে যান। টেট্যা যুব ক্যাম্পের ২০০ জন যুবককে গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য চাকুলিয়া প্রেরণ করা হয়। ডাকবাংলোতে শান্তি কমিটির মিটিং চলাকালে গ্রেনেড চার্জ করা হয়। পাওয়ার হাউসেও একটি অভিযান চালায় এবং পাকসেনাদের একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। এসব যুদ্ধ ছাড়াও ৭টি গেরিলাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন সেলিমসহ ৫৫ জন পাকসেনা এবং প্রায় ১০০ রাজাকার ও আলবদর মারা যায়। ইদ্রিস ও কালু নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা এবং রতন, খোকন, মোহাম্মদ ও খোকাসহ আরও ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। ছাচিয়াদহ বাজারে ১৩২টি তেরখাদায় ২০০টিসহ সম্পূর্ণ এলাকায় ৩০০০ বাড়িঘর তারা লুট করে এবং পুড়িয়ে দেয়। প্রায় ১৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সেক্টরের কোটেশ^র পাক অবস্থানের ওপর মর্টার দিয়ে আক্রমণ করে এবং ৬ জনকে হত্যা করে। বিজয় নগরে ৯ রাজাকার হত্যা এবং তিনজনকে আহত করে। হরিনা ক্যাম্প থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ পরিচালনার জন্য বাছাইকৃত ৬০ জন তরুণকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ১ এবং ২ নম্বর গ্রুপ স্থলপথে মিরসরাই এবং চট্টগ্রাম শহর হয়ে কর্ণফুলীর পূর্বপাড় চরলক্ষার সর্বশেষ ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। ৩ নম্বর গ্রুপ চরলক্ষায় উপনীত হবে নৌকাযোগে। তিনটি গ্রুপেরই সার্বিক কমান্ডে থাকবেন একজন কমান্ডার। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রদান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর থেকে ঘোষণা করা হয় : পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও অন্যান্য অভিযোগে বিশেষ সামরিক আদালতে বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে। আগামী ১১ আগস্ট বিচার শুরু হবে। বিচারের বিবরণ গোপন রাখা হবে। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থন ও আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেয়া হবে। কনভেনশন মুসলিম লীগ সেক্রেটারি জেনারেল মালিক মোহাম্মদ কাসেম তিন মুসলিম লীগকে একীভূত করার লক্ষ্যে আলোচনার জন্য ঢাকা আসেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জন কিং বলেন, কয়েক সপ্তাহ আগে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে বলে প্রথম যে খবর বের হয় সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাব পাকিস্তান সরকারকে জানিয়ে দেয়া হয়। টাঙ্গাইল জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাকিম হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে একত্র হয়। সভায় জেলা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আবদুল খালেক সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবেলা করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ভারতীয় ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই পাকিস্তান বিরোধী ধ্বনির উৎপত্তি হয়েছিল। একদিকে ভারতের প্রজাতন্ত্র এবং অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই চুক্তির ব্যাপারে একমত হন এবং এটি সম্পন্ন করতে নিম্নলিখিত রাষ্ট্রদূতরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পক্ষে: সরদার শরণ সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে: জনাব এ গ্রমিকো, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তাদের প্রতিটি সম্ভাবনা আলোচনা করেন যা সঠিকভাবে ক্রমান্বয়ে নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী জনগণের পূর্ণ সমর্থন উপভোগ করছিল, পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের ক্রমাগত সন্ত্রাস সৃষ্টি সত্ত্বেও জনগণের নৈতিকতাবোধ অনেক উন্নত ছিল। ঈষধৎব ঐড়ষষরহমংড়িৎঃয লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লিখেন, ‘যখন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা ধারে কাছে থাকে না তখন গ্রামের মানুষজন বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিলেট জেলার উত্তরপূর্ব এলাকায় শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যজনক আক্রমণে ৫০ জন পাকসৈন্য খতম হয়েছে। গেরিলা যোদ্ধারা ৪ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে জীবন্ত অবস্থায় আটক করতে সক্ষম হয়েছে। যশোরের নাভারন এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা রাজাকারদের ওপর এক অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ৯৩ জন শত্রু নিহত ও বহু আহত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর : সিলেটের লাতু অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের আট ঘণ্টাব্যাপী প্রচ- সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ৫৫ জন হানাদারকে খতম করে ও ৬৫ জনকে গুরুতর আহত করে। রংপুরের চিলমারি থানার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গেরিলারা একজন অফিসারসহ ৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে গুলি করে হত্যা করে। ঝিকরগাছার পুলিয়ানি গ্রামে হানাদার সৈন্যরা লুটপাট করতে গেলে একজন মুক্তিযোদ্ধা একটি বাগান থেকে গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে একজন হানাদারকে খতম করে। স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা হালকা মেশিনগান ও রাইফেল দিয়ে অন্য একটি আক্রমণে ৩ জন শত্রু সৈন্যকে হতাহত করে। ভারতের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় প্রকাশিত দি ইয়ার্স অব এন্ডিভার থেকে জানা যায়, সংসদ ১৯ মার্চ শুরু হয় এবং ২৫ ও ২৬ মার্চ বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা বিশ্বকে মর্মাহত করেছে। বাংলাদেশের জনগণ একই উদ্দেশ্য নিয়ে লড়ছে যার জন্য আপনি এবং আমি আমাদের দেশে একটা দীর্ঘ সংগ্রামের সময় অতিবাহিত করেছি। বাংলাদেশের ঘটনা সঙ্কট সৃষ্টি করছে। ৭৩ লাখ মানুষ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যার কারণে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের আমন্ত্রণ জানাইনি। কিভাবে আমরা তা করতে পারি? আমাদের নিজের দেশে অনেক কিছুর ঘাটতি আছে। সুতরাং, কিভাবে আমরা তাদের আসতে বলি? আমাদের নিজের জনগণের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এতে। এটা আমাদের কোনো দোষ না যে তারা এসেছেন। তারা তাদের দেশ ছেড়ে বিপদে পরে তাদের দুঃখ কষ্ট থেকে অব্যাহতি পাবার আশায় এখানে এসেছেন। ... যারা সবসময় সত্যাগ্রহের বিপক্ষে ছিল তারাই বাংলাদেশ ইস্যুতে সত্যাগ্রহের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে সত্যাগ্রহের কোণ মানে নেই। সত্যাগ্রহের মূল্য ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। যখন সত্যাগ্রহ জানত না যে তাদের ৭ বছর বা ১০ বছর কারাগার যাপন করতে হবে। সেটি ছিল সত্যাগ্রহের দিন। কিন্তু এখন উপহাস করা হচ্ছে। সত্যাগ্রহের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান। আমরা কখনোই বলিনি যে আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব না। সরকার সাবধানে সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এবং তখন সেটি আমাদের জনগণ দ্বারা সমর্থিত হবে। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে এটা আমাদের ও বাংলাদেশের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে কিনা। আপনাদের সত্যি বলছি, সরকার তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। সরকার সব সময় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যা আমাদের জনগণের এবং বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আপত্তি আসতে পারে কেন আমি অন্য দেশের মানুষের কথা উল্লেখ করছি? কিন্তু সচেতনভাবে খেয়াল করলে দেখবেন কিভাবে সেখানকার ঘটনা আমাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ আজ উদ্বাস্তুদের এই বিশাল অন্তঃপ্রবাহ বরণ করে নিবে না এবং তাদের সাহায্য দিতে প্রস্তুত হতে পারবে না। আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের পক্ষে এই বোঝা গ্রহণ করা খুব অস্বস্তিকর। একমাত্র পথ ছিল যে বর্ডারে ঢুকতে চাওয়ার সময় গুলি করার ভয় দেখানো। এছাড়া এত বিপুল সংখ্যক লোকের অন্তপ্রবাহ বন্ধ করার কোন পথ ছিল না। এই সমস্যার আরেকটি দিক রয়েছে। আমরা জানি যে, এই লোকগুলোকে ঢুকতে দেয়া না হলে তাদের দেশেই তাদের হত্যা করে ফেলা হবে- এটা জেনেও কি আমরা তাদের প্রবেশে বাধা দিতে পারি? আমরা নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে এমনটা করতে পারি না। আমাদের ঐতিহ্য হলো ভারত সবসময় আর্তপীড়িতদের পাশে থেকেছে তাতে আমাদের যত সমস্যাই হোক। আমরা যতটুকু সম্ভব তাদের সাহায্য করছি এমনকি আমাদের জনগণও এইসব লোকদের জীবন বাঁচানোর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×