ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অবিনশ্বর মুজিব

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ৯ আগস্ট ২০১৯

অবিনশ্বর মুজিব

বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এবং বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের কলরবে যে জনপদের বাস সেই জনপদের সংস্কৃতিকে সর্বতোভাবে অনুধাবন এবং আত্মস্থ করেছিলেন তিনি। তাঁর রাজনৈতিক চর্চায় তিনি এই জনপদের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। হয়েছিলেন বাঙালী জাতির ইতিহাসের মহানায়ক। এটাই হয়তো তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল! যার মূল্য দিতে হয়েছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরিবারের ১৭ জন সদস্যসহ ঘাতকদের নির্মমতায় জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে। দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে পরিবারের সদস্যসহ ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বর্বর হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ঘাতক খুনিচক্র স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতিকে। ভোর থেকেই দিনটি ছিল বিভীষিকাময়। হত্যাকা-ের পরপরই সকালে জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার করে গৃহবন্দী করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচরদের সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল। সে দিন ঘৃণ্য নরপশুরা শুধু একজন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, তারা একে একে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। জঘন্যতম এ হত্যাকা- থেকে রক্ষা পাননি বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, বেগম আরজু মণি, কর্নেল জামিলসহ ১৭ জন। ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গোলায় মোহাম্মদপুরে কয়েকজন সাধারণ নারী-পুরুষও মারা যায়। এসব হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়। যার ডাকে জেগেছিল সাড়ে সাত কোটি প্রাণ রণাঙ্গনে, সেই কণ্ঠকে স্তব্ধ করাই শুধু নয়, জাতির বিকাশকে স্তিমিত করার ঘৃণ্য চেষ্টাকে অবলোকন করেছে বিশ্ববাসী। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। সেই দিন অতিবিপ্লবের স্লোগানদারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের এজে-া হিসেবে এই মহানায়ককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এ শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা নয়, বাংলাদেশের হৃদয়কে কেটে-ছিঁড়ে রক্তাক্ত করার শামিল। বাঙালী হারিয়েছিল তাদের অবিসংবাদিত প্রিয় নেতাকে। ১৯৯৬ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তখন থেকেই সরকারীভাবে পালিত হচ্ছে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচী। শোকের মাসের ১ম দিন থেকে বঙ্গবন্ধু ও শাহাদাত বরণকারী পরিবারের সদস্যদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে বাঙালী জাতি। শোকাবহ এ মাসটিতে হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা আর শ্রদ্ধাঞ্জলিতে সিক্ত হচ্ছে টুঙ্গিপাড়ার সমাধিস্থল, ধানম-ির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনের প্রতিকৃতি ও বনানী কবরস্থান। ক্যারিশম্যাটিক সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী এই মহান নেতা লক্ষাধিক লোকের চোখের ইশারাকে ঠিকই বুঝে ফেলেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণের দিন। ওইদিন দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তোমাদের কাছে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা বেঁচে থাকবেন বাঙালীর হৃদয়ে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক দেশটি যতদিন থাকবে ততদিন বাঙালীর হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাম। আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী? বিদেশি সাংবাদিকের করা এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই দেশের মানুষকে আমি খুব ভালোবাসি।’ আপনার বড় দোষ কী, সেই প্রশ্নের উত্তরেও তিনি বলেছিলেন, ‘এই দেশের মানুষকে আমি বড় বেশি ভালোবাসি।’ তিনি দেশ এবং দেশের মানুষের মুক্তির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেই রেখেছিলেন। তিনি সব সময়ই দেশের মানুষের জন্য মরতে প্রস্তুত ছিলেন। একটাই স্বপ্ন ছিল তাঁর। বাংলার মানুষের মুক্তি। একটাই লক্ষ্য ছিল তাঁর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি কখনও পূর্ব পাকিস্তান কথাটা মুখে উচ্চারণ করতে চাইতেন না। তিনি বলতেন বাংলা, পূর্ব বাংলা। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনি দেখবেন, ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি করেছি, আপনারা এটাকে বাংলা বলে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে ঐতিহ্য।’ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে, এই চিন্তা তাঁকে ঘুমোতে দিত না। কবে থেকে এই স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন? অন্নদাশঙ্কর রায় এ প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুকে করেছিলেন। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। যখন সোহরাওয়ার্দী আর শরৎবাবুর বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন ব্যর্থ হলো, তখন থেকে। ১৯৬৩ সালের দিকে, যখন আইয়ূব খানের সামরিক শাসন চলছে, তিনি ত্রিপুরায় গিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে ভারত সরকার বাংলাদেশকে কতটা সাহায্য করতে পারবে? ১৯৭৫ সালের সেই ভোরে কি বৃষ্টি হয়েছিল? খুব ভোরবেলা টেলিফোনের শব্দে তার ঘুম ভাঙে, তিনি শুনতে পান আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা হয়েছে, গোলাগুলি হচ্ছে। তিনি টেলিফোন করছিলেন পুলিশকে। কিন্তু তাঁর বাড়িতেও যে হামলা হতে পারে, সেটা তিনি কোন দিনও ভাবেননি। ভারত তাকে সাবধান করে দিয়েছিল, বিশেষ প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়েছিল, আমেরিকানরাও সাবধান করে দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তাঁর মানুষ কোন দিনও ক্ষতি করবে না। পাকিস্তানী জেনারেলরা সাহস পায়নি তাঁর গায়ে হাত তোলার, বাঙালীরা কোত্থেকে পাবে? কিন্তু তিনি যখন দেখলেন, তাঁর বাড়িতেও আক্রমণ করা হয়েছে, বাইরে গোলাগুলি হচ্ছে, তখন কী ভাবছিলেন তিনি? যখন দেখলেন, শেখ কামালের বুলেটবিদ্ধ শরীর থেকে রক্তের ধারা বইছে, তখন এই বাঙালীদের ওপর থেকে তাঁর আস্থা কি টলে যাচ্ছিল? না! কারণ, তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, পাল্টা গুলি করা বন্ধ কর। গুলি বন্ধ হলো। খুনিরা ঢুকে গেল বাড়িতে। তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, হাতে পাইপ আর দেশলাই। ‘তোরা কী চাস?’ তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে ওরা যখন গুলি করল, তখনও কি বাঙালীদের ওপর থেকে তিনি আস্থা হারাননি? আর বেগম মুজিব! যিনি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বন্দী, তাকে নিষেধ করেছিলেন প্যারোলে মুক্তি নিতে, যিনি ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ বিকেলে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, নিজের বিবেকের কথা ঘোষণা দিতে, যিনি মার্চের আলোচনার সময় বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হয়ো না, তাহলে মানুষ তোমার সঙ্গে আর থাকবে না, তখন ইয়াহিয়া তোমাকে মারতে পারবে, আর মানুষ যদি তোমার সঙ্গে থাকে, তাহলে তোমার কোন ক্ষতিই ওরা করতে পারবে না।’ যিনি আজীবন নিজে কষ্ট করে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে রেখেছিলেন দেশের জন্য, তিনি যখন দেখলেন, আপনার বিশাল মহীরুহ দেহটা পড়ে আছে সিঁড়িতে, তার কী মনে হয়েছিল? রাসেল যখন বাড়ির লোক আর পুলিশদের বলছিল, ‘আমাকেও কি ওরা মেরে ফেলবে? আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও,’ খুনিরা বলল, চল, তোকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিই...একে একে সবাই গেল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, তার স্ত্রী...। গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঁড়িতে পড়ে যেতে যেতে নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ওরা বাংলার মানুষ, ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারে না, বলেছিলেন, আমি বাঙালী, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ...আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। পঁচাত্তর সালের পনেরো আগস্ট সকাল ছিল রাতের চেয়েও অন্ধকার। জাতির সৌভাগ্য সেদিনের সেই নৃশংসতার শিকার থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এবং এটা বোধ হয় বাঙালী জাতির জন্য মহান স্রষ্টার আশীর্বাদ ও বাঙালী জাতিকে উন্নয়নের সোপানে এগিয়ে নেবার আলোকবর্তিকা। শেখ হাসিনা পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো করতে পারছেন বলেই আজ জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দর্শন, আদর্শকে আঁকড়ে ধরে বাঙালী জাতীয়তাবাদের পথে চলতে পারছে। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন এবং বিচার কার্যকরীও করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মানবাধিকারের শত্রুদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারও সম্পন্ন করে চলেছেন এবং তা কার্যকরীও করছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের রায় কার্যকর করে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। একইভাবে বাঙালীর আত্মঘাতী চরিত্রের অপবাদেরও অবসান ঘটেছে। দেশের মানুষ এখন অনুধাবন করতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করে দেশে পাকিস্তানী ভাবধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই স্বাধীনতা বিরোধী এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। সেই দিন বাঙালী হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল জাতির জনকের কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন শহীদ এবং পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছিলেন। একাত্তরের পরাজিত শক্তি বাঙালী জাতির অগ্রযাত্রা রুখে দিতে এখনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত! পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর থেকে শোককে শক্তিতে পরিণত করার যে প্রক্রিয়া চলছে সেই শক্তিতেই একদিন বিশ্বমঞ্চে বাঙালী জাতি শির উঁচু করে দাঁড়াবে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বৈশ্বিক রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনগুলো প্রমাণ করে শত আঘাত, চক্রান্তেও এই ভূখ-ের মানুষ মাথা নোয়াতে জানে না। ইতিহাসও তাই বলে। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির চেতনায় অমর-অবিনশ্বর। আজও তার আদর্শ সমুজ্জ্বল। লেখক : সোশ্যাল ওয়ার্কার [email protected]
×