ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘ক্রাচের কর্নেল’

প্রকাশিত: ১৩:০১, ৮ আগস্ট ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘ক্রাচের কর্নেল’

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের বাঁধভাঙ্গা এক আবেগের স্থান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এই জাদুঘরে ২৮০ আসন বিশিষ্ট একটি সুন্দর মিলনায়তন রয়েছে। মঞ্চ নাটকের জন্য মিলনায়তনটি বেশ চমৎকার। এখানে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ইতোমধ্যে কয়েক বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এই কয়েক বছরে মঞ্চ নাটক বা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আয়োজন সচরাচর হতে দেখা যায়নি। তবে বছর খানেক আগে খুব সম্ভবত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় তাদের ‘ওপেন কাপল’ নাটকটি মঞ্চায়ন করেছিল। সেই শুরু; সেই শেষ! মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মিলনায়তনকে কেন্দ্র করে ঢাকার ওই অঞ্চল বিশেষ করে মোহাম্মদপুর-মিরপুর এলাকার মানুষের একটি অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে জায়গাটি। এ রকম একটি অবস্থাতেই তারুণ্যদীপ্ত নাটকের দল ‘বটতলা’ সাহস করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তাদের বহুল মঞ্চায়িত নাটক ‘ক্রাচের কর্নেল’ নিয়ে হাজির হয় গত ২ আগস্ট শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায়। ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে প্রথম মঞ্চায়িত ২ ঘণ্টা ব্যাপ্তিকালের নাটকটি তাদের ৯ম প্রযোজনা এবং এটি ছিল ৪৬তম মঞ্চায়ন। ক্রাচের কর্নেল এক ভাগ্য বিড়ম্বিত বীর কর্নেল তাহেরের জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্বাপর রাজনৈতিক বাস্তবতার এক অসাধারণ আলেখ্য। সেই জীবনটি এবং ওই সময়টিকে সুনিপুণ মুন্সিয়ানায় আমাদের চোখের সামনে তুলে এনেছে বটতলা। কর্নেল তাহের কে তা আমাদের বর্তমান প্রজন্ম জানে না। এই না জানার কারণটি হল ষড়যন্ত্রের রাজনীতি তাহেরকে আমাদের কাছ থেকে অন্ধকারে রেখেছে। সেই অন্ধকারকে আলোর পথ দেখিয়েছে প্রথমত এর লেখক শাহাদুজ্জামান এবং দ্বিতীয়ত, নাটকের দল বটতলা এটিকে মঞ্চে উপস্থাপন করে। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মহিউদ্দিন আহমেদ আর বিবি অশরাফুন্নেছার দশ ছেলেমেয়ের মধ্যে চতুর্থ সন্তান নান্টুর একজন কর্নেল তাহের হয়ে উঠবার গল্প আমাদের সামনে একের পর এক উপস্থাপিত হতে থাকে। মহড়া কক্ষে মাঝে মাঝে অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে দ্বন্দ্বও হতে দেখা যায়। কাজী রোকসানা রুমার কণ্ঠে, ‘জিয়া মালটা কিন্তু অত সহজ লোক ছিল না।’ তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ শোনা যায়, ‘একজন শহীদ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আমরা এভাবে কথা বলতে পারি না।’ এই সংলাপ যেন আমাদের সীমাহীন বিভেদপূর্ণ বাংলাদেশের আপামর জনতার কথা জানিয়ে দেয়। দশজন অভিনয় শিল্পী অসংখ্য চরিত্রের মাঝে ঢুকেছেন আবার বেরিয়েছেন। শরীরে জড়ানো এক টুকরা অতিরিক্ত কাপড়ের সামান্য আড়ালে, লাঠির ব্যবহারে এবং একবার পাপেট সদৃশ্য পুতুলের মুখোশের আড়ালে প্রতিনিয়ত বদলে গেছে চরিত্র। মুক্তিযুদ্ধে তাহেরের পা হারানো এবং যুদ্ধ শেষ পর্যায়ে লুৎফার সঙ্গে তাহেরের কণ্ঠে উচ্চারিত সংলাপ, ‘যুদ্ধটা আসলে হাতছাড়া হয়ে গেল। ঠিক স্বাভাবিক বিজয় হলো না আমাদের। একটা নতুন দেশের জন্ম হলো ঠিকই কিন্তু হলো অনেকটা ফোরসেপ ডেলিভারির মতো, অন্যের সাহায্য নিয়ে।’ কিংবা বুদ্ধিজীবী হত্যার হিসেব মিলাতে গিয়ে অভিনয় শিল্পীদের কণ্ঠে করুণ সুর বেজেছে। দর্শকের চোখ জল ছল ছল করেছে। কর্নেল তাহের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে ক্যান্টনেমেন্টের চৌহদ্দি থেকে বের করে গণমুখী সামরিক বাহিনী গড়বার প্রচেষ্টা তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করে। অবশেষে সেনাবাহিনী থেকে চাকরি ছেড়ে দেয়টাও তার এক আপোসহীন চরিত্র তুলে ধরে। এরপর ৭৫-এর ঘটনাপ্রবাহ এবং তৎপরবর্তী একজন বিশ্বাসঘাতক জিয়াউর রহমানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আমাদের এক নিদারুণ ভাবাবেগ তৈরি করে। নাটকের শেষ দৃশ্যে কর্নেল তাহেরের শেষ পরিণতি আমাদের চেখের জলে ভাসিয়ে দেয়।
×