ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রবীন্দ্রনাথের নাটক এবং বর্তমান সময়

প্রকাশিত: ১২:৫৯, ৮ আগস্ট ২০১৯

রবীন্দ্রনাথের নাটক এবং বর্তমান সময়

২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। নাট্যপ্রতিভার কিংবদন্তি প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ আজও সমাজ বাস্তবতা আর চিরায়ত বোধে কতখানি আধুনিক এবং চিরকালের মনন শৌর্যে উদ্দীপ্ত ছিলেন প্রয়াণ বর্ষে তারই কিছু সফল গাঁথা। রবীন্দ্রনাথের জন্মলগ্নে আধুনিকতার নব্য ধারা অবিভক্ত বাংলাকে যে উজ্জীবনের নতুন পথ দেখায় কবি ছিলেন তারই যথার্থ উত্তরসূরি। সঙ্গত কারণে নবভাব প্রতিবেশ, ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্যিক পরিম-ল সঙ্গে কবির অসাধারণ সৃজন ক্ষমতায় মনন ও সৃষ্টি বোধে যে নান্দনিক মহিমা সে মাত্রায় বাংলা সাহিত্যে নাটকের আঙ্গিকে অন্যমাত্রার সংযোজন তা শুধু কবির পক্ষেই সম্ভব ছিল। বাংলা সাহিত্যের নাট্যজগত তখন শুধুমাত্র পৌরাণিক উপাখ্যান, মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা সঙ্গে সময়ের কিছু আবেদনের সংমিশ্রণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যখন আধুনিক যুগের প্রভাত রশ্মি সাহিত্যাকাশকে দ্যুতিময় করে দেয় তেমন সময়ে নাটকের এক নতুন ভাব সম্পদ উন্মোচন করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। পরবর্তীতে সমাজ ব্যবস্থার বিদগ্ধ টানাপোড়েনের দীনবন্ধু মিত্র তৈরি করলেন ‘নীল দর্পণে’র মতো এক বৈপ্লবিক ধারার চমকপ্রদ সংযোজন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত নাটক বিনোদন মঞ্চে তার সামগ্রিক আবেদন নিয়ে দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন করেই যাচ্ছে। আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার সার্থক উত্তরসূরি । আধুনিক নাটকের সফল প্রতিনিধিই শুধু নন ঐতিহ্যিক ঐশ্বর্যকে আরও যুগোপযোগী করে মানবিক সম্পর্কের অভাবনীয় রূপ কল্প সঙ্গে সামাজিক অপসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সবটাই হয়েছিল প্রতীভাদীপ্ত মননের এক অসাধারণ শিল্পশৌর্যে। ঐতিহ্যকে সব সময়ই অহঙ্কারের সঙ্গে লালন করতেন, সময়ের ¯্রােতেও ভাসতে বেশি মনোযোগী হতেন, অসাম্য-বৈষম্যকে সৃজনদ্যোতনায় উপেক্ষা করেছেন আর চিরস্থয়ীভাবে সম্পদে নিজেকে সার্বক্ষণিক আচ্ছন্ন করে রাখতেন। ফলে তার নাট্য সৃজন সৌধ শুধুমাত্র সমকাল কিংবা আধুনিক নয় একেবারে চিরকালের যা দাপটের সঙ্গেহ আজও বিনোদন অঙ্গনকে মাতিয়ে বেড়াচ্ছে। সৃজনশীলতার সম্প্রসারিত আঙ্গিনার শুভ মুহূর্ত অতি বাল্যকাল থেকেই। নাটকও শুরু হয় সেই কিশোর বয়সের প্রতিভা স্ফূরণের এক সুবর্ণক্ষণে। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ থেকে শুরু করে ‘বাঁশরী’ পর্যন্ত যে সমৃদ্ধ নাট্য পথপরিক্রমা সেখানে যুগ ও সময়ের নিরন্তর মিছিলে এখনও তা প্রাসঙ্গিক, অপরিহার্যই শুধু নয় সামাজিক বাস্তবতার নিষ্পেশনের এক বিদগ্ধ প্রতিবেদন। গীতিময় ছন্দের অবিস্মরণীয় সৃজন ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের নাটকের আবহেও থাকে সুরের মূর্ছনা। ১৮৮১ সালের ‘বাল্মিকী প্রতিভা’র রচনাকাল। তার কিছুমাত্র আগে দুই বছর বিলেতি সভ্যতাকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করা উদীয়মান রবি তাঁর সৃষ্টিকল্পেও তেমন ভাব সম্পদকে নিয়ে আসবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ট্রাজিক ধারণার যে অনবদ্য রূপকল্প ‘বাল্মিকী প্রতিভায়’ তা শৈল্পিক দ্যোতনায় পরিস্ফুট। নতুন ধর্ম চেতনায় পরিপুষ্ট কবি নিরাকার ব্রহ্মের যে ঐশ্বর্যিক রূপায়ণ তাও বাল্মিকীর প্রতিভায় উদ্ভাসিত। বৈষ্ণব ধর্মের ভক্তি রস এবং বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসবোধ কবিকে নানা মাত্রিকে উদ্ভাসিতও করে। রুদ্রচন্ড কিংবা কালমৃগয়া ও নব্য ধর্মীয় চেতনা, উদার মানবিক বোধ কিংবা প্রকৃতির অবারিত বৈভবে নিঃশর্ত সমর্পণ এ সবেরই মিলিত ভাবোচ্ছ্বাস। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকে প্রকৃতি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথের নৈসর্গ বৈভবের বিরাট সম্ভারের প্রতি তার আকুতিই শুধু নয় জীবনকে ভরিয়ে তোলারও এক অপরিমেয় সাধনা। রবীন্দ্রনাথের ‘ অচলায়তন’ নাটকটিও রক্ষণশীল ধর্মাশ্রিত সমাজের এক কঠিন শৃঙ্খল যা কবি কখনো মানতে পারেননি। ঠা-া মাথায়, স্থির বুদ্ধিতে, সৃষ্টির সুষমায় তাকে বিভিন্ন ভাবে আঘাত করেছেন। যা আজও সময়ের এক বিভাজিত পর্ব। জীবনভর যা বলতে চেয়েছেন তা হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলনই প্রকৃত ধর্ম। আর দ্বিধাবিভক্তি ধর্ম যখন সেখানে আঘাত করে তখন তার যথার্থ বোধ, মাহাত্ম্য কিছুই থাকে না। আজও বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় উম্মাদনা, উগ্র মৌলবাদ হিংসায় উন্মত্ত হয়ে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে প্রায় শতবর্ষ আগে তাকে ঠা-া লড়াইয়ে বার বার প্রতিহত করেছেন। ‘ডাকঘর’ নাটকটিও এক অভাবনীয় শিল্পকর্ম। যা প্রাকৃতিক অবারিত সৌন্দর্যকে গৃহবন্দী অমলের কাছে বার বার নিয়ে আসে। এমন চিন্তা কবির আশৈশব। নিসর্গের উদার হাতছানিতে কবির মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন নান্দনিক দ্যোতনায়। ‘দুই পাখি’ কবিতায় তেমন শৈল্পিক সুষমার অভাবনীয় রূপকল্প। বন্দী পাখি কবি নিজে আর মুক্ত পাখি প্রকৃতি। তেমন ডাকাডাকি তো জীবনব্যাপী কবিকে প্রাণিত করেছে। আজও প্রকৃতির সুরম্য লীলা নিকেতন আমাদের আবিষ্ট করে। শ্যামল বাংলার সীমাহীন সবুজের সমারোহে এখনও আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজেকে হারিয়ে ফেলি। ‘রক্তকরবী’, ‘রথের রশ্মি’র মতো ধনবাদী সমাজের করাল নিষ্পেশনও কবির নান্দনিক শিল্পকর্মে সাধারণ মানুষের প্রতি দিনের যাপিতজীবনের শ্রমশক্তির নিঃশেষ হওয়ার বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরা হয়। পুুঁজির শোষণ আর আগ্রাসনে সাধারণ মানুষের যে নিপীড়িত, নির্যাতিত জীবন কাহিনী তারই শৈল্পিক রূপ কবির দক্ষ হাতে নির্মিত হয়ে আজও সময়ের চাহিদা মিটিয়ে নাটকের রঙ্গমঞ্চকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিনোদন শিল্পে কবির গ্রহণ যোগ্যতা, আবেদন, সৃষ্টির মহিমা এখনও সবাইকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে।
×