ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১১শ’ কোটি টাকার ক্ষতি ॥ বন্যায় ৩১ জেলায় পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসলহানি

প্রকাশিত: ১১:০১, ৮ আগস্ট ২০১৯

১১শ’ কোটি টাকার ক্ষতি ॥ বন্যায় ৩১ জেলায় পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসলহানি

ওয়াজেদ হীরা ॥ প্রকৃতির বৈরী আচরণ বন্যার কারণে দেশের ৩১ জেলায় আউশ, আমন ও আমনের বীজতলা এবং গ্রীষ্মকালীন সবজিসহ দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ২৮৯ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল। এর মধ্যে বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮০ হাজার ৪৬৩.৫ হেক্টর জমি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণও ৯০ হাজার ৮২৬ হেক্টর জমি। সারাদেশে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে নয় ভাগের ওপরে। এতে ৬ লাখ ৫১ হাজার কৃষকের ১ হাজার ১৫২ কোটি ৬২ লাখ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। যদিও কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মৌসুমের প্রথম দিকে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। এ কারণে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠাও সহজ হবে। ক্ষতি কাটাতে সরকার কৃষকদের জন্য প্রণোদনা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বন্যাকবলিত এলাকায় এই প্রণোদনা দেয়া হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বানের পানিতে ভেসেছে নানান ফসল। আমনের বীজতলা ভেসে গেছে বন্যার তোড়ে। এছাড়াও পাট মরিচ আখ জাতীয় ফসল ডুবেছে পানিতে। এতে বন্যাদুর্গত কৃষকরা অনেকটাই দিশাহারা হয়ে পড়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা আর উৎসাহের কারণে অনেক জায়গায় পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে চাষাবাদ। দেশের অনেক এলাকায় এখন আমনের প্রস্তুতিও চলছে ব্যাপক। কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি ও সরকারের ভাবনা নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের ফসলের বা কৃষকদের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েছে। এখন পানি নেমে যাচ্ছে। আশা করছি এবার আর বন্যা হবে না। আমরা চেষ্টা করব চারা দেয়ার জন্য যাতে আমনটা অন্তত ভাল করে করতে পারে। ইতোমধ্যেই পানি যেহেতু নেমে যাচ্ছে তাই অনেক জায়গাই চাষ শুরু হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, যেসব এলাকায় একেবারেই ধান লাগানো যাবে না সেখানে আমরা রবি ফসল করার জন্য প্রণোদনা দেব। বিনামূল্যে চাষীকে সার, বীজ ও অন্যান্য উপকরণ দেব। কৃষকদের যাতে কোন সমস্যা না হয় তারা যেন ক্ষতির মধ্যে না থাকে সে বিষয়ে আমাদের সরকার আন্তরিক। এ বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তও হয়েছে। আশা করি কৃষক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, কমিউনিটি বেজড বীজতলা তৈরি করে দেয়া হচ্ছে যাতে কৃষকদের পরিবহন খরচও না লাগে। যে পরিমাণ বীজতলা ক্ষতি হয়েছে তার পুরোটাই কভার করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমনের লক্ষ্যমাত্রা খুব একটা হেরফের হবে না আশা করছি। পানি নেমে যাওয়ার পর কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় কৃষকরা মাষকলাই চাষ করতে পারে, সেজন্য মাষকলাইয়ের বীজ দেয়া হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় দেশের ৩১ জেলায় বিভিন্ন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ২৮ জুলাই ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটি চূড়ান্ত করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইং। উইংয়ের উপপরিচালক (মনিটরিং) মিজানুর রহমান বলেন, মাঠ পর্যায়ের সর্বশেষ যে তথ্য পেয়েছি তা চূড়ান্ত। এরপরও যদি কোন এলাকার তথ্য আসে, পরবর্তীতে পানি সম্পূর্ণ নেমে গেলে জানা যায় তা অন্তর্ভুক্ত হবে। অধিদফতরের হিসেবে সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নাটোর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পাবনা, দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, নওগাঁ, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ জেলায় কিছু ফসলের আংশিক ক্ষতি হলেও কোন কোন ফসলের জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার মধ্যে বর্তমানে দ-ায়মান বিভিন্ন ফসলের পরিমাণ ১১ লাখ ২০ হাজার ৩৩৬ হেক্টর। এর মধ্যে ৮০ হাজার ৪৬৩.৫ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৯০ হাজার ৮২৬ হেক্টর ফসলি জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ২৮৯ হেক্টর ফসলি জমি। বন্যায় যেসব ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে আউশ আমন আমনের বীজতলা পাট পানের বরজ আখ কলা ও মরিচ জাতীয় ফসল। এছাড়াও গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবজি জাতীয় ফসলের মধ্যে রয়েছে চিচিঙ্গা করল্লা চালকুমড়া পটোল ঝিঙ্গা কাকরোল ঢেঁড়স ও শসা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বন্যা আক্রান্ত এলাকায় আউশের ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫ হেক্টর জমির মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২১ হাজার ৩২ হেক্টর জমি, আংশিক ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার ৭০ হেক্টর জমির ফসল। এতে দেশের শতকরা সাড়ে পাঁচ ভাগ আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে এ বছর ৯১ হাজার ৮১০ টন ধান কম উৎপাদনের শঙ্কা রয়েছে। ৯৭ হাজার ১২৪ কৃষককে আর্থিক ক্ষতি গুনতে হবে ২৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এছাড়া রোপা আমনে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের পরিমাণ ১১.৪৬ শতাংশ। আর বোনা আমনের ক্ষতি হয়েছে ১৭.৮০ ভাগ। অধিদফতর আরও বলছে, আমনের বীজতলার ৯ হাজার ৬৫ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ও ৭ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বীজতলা ক্ষতির শতকরা হার ১১ ভাগেরও বেশি। গ্রীষ্মকালীন সবজির ১ লাখ ১১ হাজার ৫৬৫ হেক্টর দ-ায়মান ফসলের মধ্যে বন্যায় আক্রান্ত হয় ১৫ হাজার ৪৬৯ হেক্টর। যেখানে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮ হাজার ৪৬৮ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার ১৮ হেক্টর জমির সবজি। সারাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত সবজির পরিমাণও ৮.৮২ শতাংশ। পাট, পান বরজ, আখ, কলা ও মরিচের ক্ষতির মধ্যে ১৩ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমির পাট সম্পূর্ণ ও ৩১ হাজার ৬৬৩ হেক্টর জমির পাট আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতকরার হিসাবে যা ৯.৭০ শতাংশ। অন্যদিকে সারাদেশে বন্যায় পান বরজের ক্ষতি এক ভাগের ওপরে, আখে ৮ ভাগ, কলায় ১১ ভাগ ও মরিচে ১০ ভাগের ওপরে ক্ষতি হয়েছে। মরিচের ক্ষেত্রে ৬ হাজার ১৯৭ হেক্টর দ-ায়মান জমির মধ্যে আক্রান্ত হয় ৮০০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে ৫৪৭ হেক্টর সম্পূর্ণ ২৫৩ আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ৮ হাজার ৮০৩ মরিচ চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কলা চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত চাষীর সংখ্যা ১৫৮০। আখ চাষে ১৮শ’ চাষী ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মীর নূরুল আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কৃষি সম্প্রসারণের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার বলেন, এবার আল্লাহর রহমতে আগাম বন্যায় খুব একটা ক্ষতি হয়নি। তবুও সরকার কৃষকদের স্বার্থে আন্তরিক। কর্মকর্তারা বলেন, আমনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারী পর্যায় বীজতলা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে ভাসমান বীজতলা তৈরির পদ্ধতিও আছে। আর ৩১ জেলার যে ক্ষয়ক্ষতি তা অনেকটা কমই মনে করছেন কর্মকর্তারা। কৃষকদের করণীয় সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।
×