ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা একাডেমিতে একক বক্তৃতা

রবীন্দ্র প্রয়াণবার্ষিকী পালিত শান্তি ও কল্যাণের বারতায়

প্রকাশিত: ১১:১৫, ৭ আগস্ট ২০১৯

রবীন্দ্র প্রয়াণবার্ষিকী পালিত শান্তি ও কল্যাণের বারতায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘সেতারেতে বাঁধিলাম তার, গাহিলাম আরবার/মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’Ñএভাবেই কবিতার পঙ্ক্তিমালায় আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ...। বাঙালীর যাপিত জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে আছে সেই রবির কিরণ। আপন সৃষ্টির নির্যাসে প্রতিনিয়ত সুন্দর ও কল্যাণের পথে ধাবিত করেছেন জাতিসত্তার মননকে। পরিণত হয়েছেন অতি আপজনে। শিল্প-সাহিত্যের আলোকধারায় ছুঁয়েছেন বাঙালীর মনপ্রাণ। দেখিয়েছেন বাঙালীর সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার পথের দিশা। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য জাতীয়তার গ-ি পেরিয়ে পেয়েছিল আন্তর্জাতিকতার ঠিকানা। স্বদেশের ঠিকানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিকতায় ঠাঁই করে নিয়েছিল বাঙালিত্বের গৌরববোধ। বাংলা পঞ্জিকার হিসেবে মঙ্গল ছিল বাইশে শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৮তম প্রয়াণবার্ষিকী। বর্ষা ঋতুর রূপময়তা নিয়ে অজ¯্র কাব্য-গীতি রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মানব মনের বিচিত্র অনুভূতিকে কবি বার বার খুঁজে ফিরেছেন বর্ষার বারিধারার মাঝে। সেই বর্ষাকেই সঙ্গী করে ৭৮ বছর আগে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে তিনি পাড়ি জমান দৃষ্টিসীমার ওপারে। প্রকৃতিকে কাঁদিয়ে তাঁর এই মহাপ্রস্থানে শোকার্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেনÑ ‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপারের কোলে/বাংলার কবি শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি তুমি চলে যাবে বলে/ শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে দলে’। প্রস্থানের দিনটিতে হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালবাসায় স্মরণ করা হয়েছে বিশ্বকবিকে। বিশ্বব্যাপী জেগে ওঠা উগ্রবাদ ও হিংসাত্মক আস্ফালনের অস্থির সময়ে কবিগুরুর মহাপ্রস্থানের দিনটিতে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে শান্তির বার্তা। ব্যক্ত হয়েছে হিংসার পথ দূরে ঠেলে মানবতা ও কল্যাণের পথে ধাবিত হওয়ার প্রত্যয়। রবির সৃজনী শক্তির আলোয় অকল্যাণকে হটিয়ে অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে গাওয়া হয়েছে জীবনের জয়গান। কবিগুরুর প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে তাকে নিবেদন করে বিশেষ সংবাদ। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় ছিল বহুমাত্রিক আয়োজন। কোথাও উচ্চারিত হয়েছে দোলায়িত ছন্দে বিশ্বকবির রচিত কবিতার চরণ। আবার কোন চ্যানেলে দিনভর নানা শিল্পীর সুরেলা ধ্বনিতে গীত হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কোথাও বা প্রচারিত হয়েছে রবীন্দ্র রচিত নাটক। বেতারেও হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। প্রয়াণবার্ষিকীতে কবিগুরুকে নিবেদিত অনুষ্ঠানের আয়োজনের বাংলা একাডেমি ও ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। সন্ধ্যায় ছায়ানট সংস্কৃতিক ভবনে পঠিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও কবিতার সংকলন। পরিবেশিত হয়েছে রবীন্দ্র কাব্যনাট্য ও গীতিনাট্য। বিকেলে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানকে তুলে ধরে একক বক্তৃতার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে সংস্কৃতিবান বাঙালী প্রাত্যহিক জীবনাচারে সহজাতভাবেই স্মরণ করেছে কবিগুরুকে। রবীন্দ্র প্রয়াণবর্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার বিকেলে একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। এতে ‘রবীন্দ্রজীবনে ১৯১৯ : তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও সাহসী অবস্থান’ শীর্ষক একক বক্তৃতা করেন অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ড. মালেকা বেগম, পশ্চিমবঙ্গের গবেষক শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, কবি লিলি হক প্রমুখ। একক বক্তৃতায় অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের শতবর্ষপূর্তি হলো এ বছর। ১৯১৯ সালে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে চরম নৃশংস এই ঘটনা ঘটেছিল। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের নাম। তিনি এই নৃশংসতার প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন। এ ঘটনাটি যেমন তাঁর দুরন্ত সাহসের উদাহরণ, তেমনি মানবজাতির প্রতি অসামান্য দায়বোধেরও পরম দৃষ্টান্ত। আরও একটি অনন্য ঘটনার জন্য ওই বছরটি রবীন্দ্রজীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলোÑ শান্তিনিকেতনের ব্রাহ্মচর্য বিদ্যালয়কে বিশ্বভারতীতে রূপান্তরিত করার যাত্রা শুরু আজ থেকে এক শ’ বছর আগে, ১৯১৯ সালে। তিনি বলেন, বিশ্বভারতীর মধ্য দিয়ে যে বিশ্বাত্মবোধ রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, সেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানচর্চার মিলনই ছিল তাঁর একান্তভাবে কাম্য। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী শান্তি ও মানবিক মহত্ত্ব সৃষ্টিতে আকুল রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে নিজের শাণিত অবস্থান ব্যক্ত করে মূলত তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার শুভ পারম্পর্যকেই বজায় রেখেছেন। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে একাকী এবং সুদৃঢ় অবস্থান অন্যায়ের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী অঙ্গীকারেরই প্রমাণবহ। মনুষ্যত্বের অপমান নিজ দেশে কিংবা পৃথিবীর যেখানে সংঘটিত হয়েছে সেখানেই তিনি স্বাদেশিকতা-স্বাজাতিকতার উর্ধে উঠে মানবিক আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রেরণায় তার প্রতিবাদ করেছেন। স্বাগত ভাষণে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবসে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে বলতে হয় জীবনের মতো মৃত্যুকেও তিনি আবিষ্কার করেছেন অমৃত করে কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন মহৎ মানবাত্মার কোন বিলয় নেই। তিনি বলেন, আমরা আনন্দিত যে রবীন্দ্রনাথের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত হলো আহমদ রফিক প্রণীত রবীন্দ্র-জীবন চতুর্থ খ-। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র-কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিক শিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন মহিউজ্জামান চৌধুরী ও অণিমা রায়। তবলায় সঙ্গত করেন এনামুল হক ওমর, গিটার বাজিয়েছেন রিচার্ড কিশোর এবং কী-বোর্ডে ছিলেন এ বি এম তানভীর আলম সজীব।
×