ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

প্রকাশিত: ১১:০৩, ৭ আগস্ট ২০১৯

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ পবিত্র হিজায ভূমিতে মজনু হজযাত্রীগণ আর ক’দিন পরই তাদের হজের এক একটি রুকন সম্পন্ন করবেন। এ হজ অনুষ্ঠানমালার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে। সর্বপ্রথম হজ করেন হজরত আদম (আ.)। হজের পূর্ণতা আনেন নবী ইবরাহীম ও তার সন্তান ইসমাঈল (আ.)। আল্লাহর নির্দেশে জিব্রাইল (আ.) প্রদর্শিত পন্থায় দু’সম্মানিত নবী ইবরাহীম-ইসমাইল হজ পালন করেন। তারপর থেকে মুসলিম উম্মাহ সে নিয়ম-রীতির অনুকরণে হজ পালন করে আসছে। তখন ইব্রাহীমের (আ.) প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলো এবং মানুষের প্রতি আপনি হজ পালনের প্রকাশ্য আহ্বান জানান, তারা হেঁটে কিংবা দূরবর্তী স্থান হতে কৃশ উটের পিঠে চড়ে আসুক। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণে কত সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে...। - ( সুরা হজ-২৬) জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ.)-এর ডাকে সাড়া দিয়ে মানবকুলের এক বিরাট অংশ তৌহিদের নির্মল আলোয় উদ্ভাসিত হলো। তার পরবর্তী সকল নবী ও স্ব স্ব উম্মতরা হজরত ইব্রাহীমের (আ.) প্রদর্শিত দ্বীনে হানিফকে আকড়ে ধরে ছিলেন, ইসলামী ভাবগম্ভীর পরিবেশে আদায় করতেন পবিত্র হজ। কিন্তু পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই তারা সে পূর্ববর্তী মহাপুরুষদের শিক্ষা ও প্রদর্শিত পথ ভুলে গিয়েছিল এবং অন্য জাহেল জাতির ন্যায় সর্বপ্রকার গোমরাহি ও পাপ প্রথার প্রচলন করে ছিল। যে কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে এককালে এক আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত ও প্রচার শুরু হয়েছিল সে কাবা ঘরে জাহেলরা অবতারণা করল নানা আজব এবং বিকৃত কর্মকা-ের। তারা সেখানে অহরহ খোদার নাফরমানিতে মত্ত থাকত। এক শ্রেণীর পুরোহিত, পাদ্রি সর্বপ্রকার কলাকুশল অবলম্বন করে আরবের বিভিন্ন স্থান হতে আসা লোকজন হতে নজর নিয়ায ও ভেট-বেগাড় আদায় করত। শত শত নবীদের স্মৃতি বিজড়িত, ইব্রাহীম-ইসমাইলের (আ.) পবিত্র স্পর্শে ধন্য, পুণ্যভূমি মক্কায় শুরু হলো হজের নামে সীমাহীন বেহায়াপনা নগ্নতা ও নোংরামী। সেখানে বসত বার্ষিক মেলা। আরবের বড় বড় বংশ ও গোত্রের লোকেরা তথায় দল বেঁধে আস্তানা তৈরি করত। প্রত্যেক গোত্রের কবি ‘কথক’ নিজ নিজ গোত্রের খ্যাতি, বীরত্ব, শক্তি, সম্মান ও বদান্যতার প্রশংসায় আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলত। প্রত্যেক গোত্র-প্রধান নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য ডেগ চড়াত, অন্যকে হেয় করার উদ্দেশ্যে উটের পর উট জবেহ করত। এসব সম্মেলনে নাচ-গান, মদ্যপান, ব্যভিচার এবং সকল প্রকার নির্লজ্জ কাজ কর্মের অনুষ্ঠান বিশেষ জাঁক-জমকের সঙ্গে সম্পন্ন হতো। কাবা ঘরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করত। কিন্তু তার পদ্ধতি এত বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, নারী-পুরুষ সকলেই উলঙ্গ হয়ে একত্রে ঘুরত আর বলত : আমরা আল্লাহর সামনে এমনাবস্থায় যাব, যেমন অবস্থায় আমাদের মা আমাদেরকে প্রসব করেছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে ‘ইবাদত’ (?) করা হতো এ কথা ঠিক; কিন্তু কিভাবে? খুব জোরছে হাততালি দেয়া হতো, বাঁশি বাজান হতো, দেয়া হতো শিংগায় ফুৎকার। আল্লাহর নামও যে সেখানে নেয়া হতো না, এমন নয়। কিন্তু কি রূপে? তারা বলত- ‘আমি এসেছি, আমি এসেছি হে আল্লাহ। আমি এসেছি, তোমার কেউ শরিক নেই কিন্তু যে তোমার আপন, সে তোমার অংশীদার। (না উজুবিল্লাহ) তুমি তারও মালিক এবং তার মালিকানারও মালিক।’ আল্লাহর নামে সেখানে কোরবানিও দেয়া হতো। কিন্তু তার পন্থা ছিল কত নিকৃষ্ট ঔদ্ধত্যপূর্ণ! কোরবানীর রক্ত কাবা ঘরের দুয়ারে ফেলে রাখত। কারণ, তাদের ধারণা মতে, আল্লাহ এসব রক্ত ও গোস্ত তাদের কাছ থেকে কবুল করেছেন। এরূপ ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্নœ অবস্থা কমবেশি দু’হাজার বছর পর্যন্ত ছিল। এ দীর্ঘ সময়ে আরব দেশে কোন নবীর আবির্ভাব হয়নি। আর কোন নবীর প্রকৃত শিক্ষাও সে দেশে পৌঁছায়নি। অবশেষে সাইয়্যিদেনা হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়া পূর্ণ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসল। তিনি কাবা ঘর প্রতিষ্ঠার সময় আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন- আল্লাহ হে! এদেশে একজন নবী এ জাতির মধ্য হতেই প্রেরণ কর, যে এসে তাদের তোমার বাণী শুনাবে; জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবে এবং সংশোধন করবে তাদের নৈতিক চরিত্র।’-এ দোয়া আল্লাহর নিকট মঞ্জুর হয়েছিল, তাই তারই অধস্তন পুরুষে একজন ‘কামেল ইনসান’ আবির্ভূত হলেন, যার পাক নাম মুহাম্মদ (স.) ইবনে আবদুল্লাহ। তিনি এসে হজরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহর মতো সমস্ত কুসংস্কারে করলেন কুঠারঘাত। নির্ঝঞ্জাট ও নিষ্কলুষ ইব্রাহীমী নীতিতে হজ অনুষ্ঠানকে পুনঃদাঁড় করালেন দুনিয়াবাসীর সামনে। তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিলেন (আল্লাহর স্মরণ এবং ইবাদত করার) যে পন্থা আল্লাহ তোমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, ঠিক সে অনুযায়ী আল্লাহর স্মরণ ও ইবাদত কর। যদিও ইহার পূর্বে তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে।’- সুরা বাকারা-১৯৮। সকল অন্যায় ও বাজে কর্মতৎপরতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলো। হজ উপলক্ষে কোন রূপ ব্যভিচার অশ্লীলতা, আল্লাহদ্রোহীতা, ফাসেকি কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ-বিগ্রহ করা যাবে না।’ বাকারা-১৯৭। ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানগণ প্রথম হজব্রত পালন করেন। ৯ম হিজরীতে হজরত রাসুলুল্লাহ বিশেষ কারণে হজে গমন করতে পারেননি। নবী করিম (দ.) আবু বকর সিদ্দিককে (র.) ‘আমিরুল হজ’ নিয়োগ করেন। পরবর্তী বছর ১০ম হিজরী সনে আল্লাহর একত্ববাদের সর্বশেষ নিশানবরদার হুজুর আকরাম (দ.) লক্ষাধিক আল্লাহ প্রেমিক ভক্ত-অনুরক্ত পরবেষ্টিত ‘বিদায় হজ’ সম্পাদন করেন। শিরক-কুফরের কালিমামুক্ত হজরত ইব্রাহীম (আ.)-ইসমাঈল (আ.)-মুহাম্মদ (স.)-এর প্রবর্তিত পাক পবিত্র হজ পালনের মানসে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে আজও প্রতি বছর লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কা নগরীতে লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’র সুমধুর গুঞ্জন ধ্বনি ও মর্মস্পর্শী সুরে মরু আরবে বেহেস্তি সৌরভ বিকিরণ করে থাকে। কতই না সুন্দর সে আকুল করা-ব্যাকুল করা দৃশ্য!
×