ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ॥ দু’ঘণ্টার রাস্তা যেতে লাগছে ৫ ঘণ্টা

৪০ রুটে যাত্রী ভোগান্তি

প্রকাশিত: ১১:০২, ৭ আগস্ট ২০১৯

৪০ রুটে যাত্রী ভোগান্তি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ টাঙ্গাইলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৪০টির বেশি রুটের যানবাহন ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক ব্যবহার করে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কে বছরের পর বছর চলছে নানামুখী দুর্ভোগ। সড়ক বিভাগ ও উন্নয়ন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট লোকজনসহ স্থানীয় সিটি কর্পোরেশনের উদাসীনতার কারণে ভোগান্তির যেন শেষ নেই। অথচ দেশের অন্যতম মহাসড়কের এটি একটি। পরিবহন সংশ্লিষ্ট লোকজন, স্থানীয় মানুষ, যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোজার ঈদের চেয়ে কোরবানির ঈদে এই রুটে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। আগামী কয়েকদিনের পরিবহনের চাপে সমস্যা মাত্রা ছাড়াতে পারে এমন শঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। তারা বলছেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১১ পয়েন্ট এখন যানজটের বিষফোঁড়া হিসেবে চিহ্নিত। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ১১২ কিলোমিটার। এরমধ্যে মহাখালী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত মাত্র ৩০কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করতে সময় লাগছে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। টঙ্গী ব্রিজ থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার সড়কে সঙ্কট সবচেয়ে বেশি। যা যাত্রী ও পরিবহন চালকদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের নাম। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটারের বেশি সড়ক অতিক্রম করতে সময় লাগে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় ঘণ্টা! এবারের ঈদ-উল-আজহায় এই সড়কে ভোগান্তির নতুন মাত্রা যোগ করেছে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প ও বছরের পর বছর সড়কের দু’পাশে ড্রেনে সংস্কার কাজ শেষ না হওয়া ও রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে থাকা। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে সড়কের ভাঙ্গাচোরা, বাজার, রাস্তার ওপর মাটি রাখা, অবৈধ পার্কিংসহ ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠানামা করানো, অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচলের দৌরাত্ম্য। যাত্রী ও চালকরা বলছেন, সব পক্ষের আন্তরিক উদ্যোগ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে পাঁচ ঘণ্টার দুর্ভোগ কমিয়ে আনতে পারে। এমন বাস্তবতায় জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ফোর লেন প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন না যাত্রীরা। স্থানীয়রা বলছেন, টানা বৃষ্টিপাতের কারণে টঙ্গী-গাজীপুর পর্যন্ত যানজটের ভোগান্তি বেড়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েকদিনে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এসব পয়েন্ট ঘিরে যানজট নিরসনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হলে ঘরমুখো মানুষকে খুব একটা বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে না। যদিও রোজার ঈদে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট নিরসনে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হলেও অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তখন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে সময় লাগে ২০ ঘণ্টারও বেশি। আড়াই মাস আগে শেষ মুহূর্তের অভিজ্ঞতা সুখকর না হওয়ায় এবারের ঈদেও যানজটের আশঙ্কা কাটছে না। তাই সব পক্ষের লোকজন বলছেন, অভিজ্ঞতার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার। কোরবানির ঈদের কারণে এবার এই সড়কে পশুবাহী ট্রাকের চাপ বাড়বে। তাই শেষ সময়ে সড়কে যেন সহনীয় যানজট থাকে তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা। স্থানীয় পুলিশ ও সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা সব রকমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যে কোন মূল্যে মালিক, শ্রমিকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখার চেষ্টা করা হবে। ঈদের আগেই বন্ধ করা হবে বিআরটির কাজ। সেইসঙ্গে ভাঙ্গাচোরা সড়ক দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ হবে। রোজার ঈদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চার লেনের তিনটি সেতু খুলে দেয়া হয়েছে। এতে এই মহাসড়কে তেমন কোন সমস্যা নেই। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বেশ কয়েকটি সেতু, আন্ডারপাস খুলে দেয়ায় এই মহাসড়কেও যানজটের আশঙ্কা করছেন না সংশ্লিষ্টরা। তবে এবারের ঈদে পশুবাহী গাড়ির কারণে এই মহাসড়কের ভোগান্তি হতে পারে। সায়েদাবাদ থেকে ঢাকা-সিলেট রুটে চলা গাড়িগুলোও এবার নানামুখী উদ্যোগের কারণে যানজটে পড়তে হবে না। যানজটের আশঙ্কা শুধু টঙ্গী-জয়দেবপুর পয়েন্টেই বেশি। এবারের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত কাজ ঈদের আগে অন্তত তিন দিন শেষ করার তাগিদ দিয়ে সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দিনরাত আমাদের লোকজনকে প্রস্তুত রাখতে হবে যাতে অতিরিক্ত কাজ করে মেরামত করা যায়, সে রকম নিশ্চয়তা দিতে হবে। কারণ জনগণ এমনিতেই একটা আতঙ্ক নিয়ে দেশের বাড়িতে যাচ্ছেন, সেখানে রাস্তার অবস্থাটা যদি পাসেবল না হয়, তাহলে দুর্ভোগটা হবে। সমস্যার ১১ পয়েন্ট ॥ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত বৃহত্তর ময়মনসিংহের পরিবহন টঙ্গী-জয়দেবপুর হয়ে যাতায়াত করে। এছাড়াও টাঙ্গাইল, উত্তরাঞ্চল, সিলেট অঞ্চলেরও কিছু যানবাহন এই রুটের অংশবিশেষ ব্যবহার করে। সমস্যার শুরু মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকেই। টঙ্গী সেতু পার হওয়ার পর যানজটের মহা ভোগান্তিতে পড়তে হয় পরিবহনগুলোকে। প্রথমেই টঙ্গী বাজার। এরপর স্টেশন রোড, চেরাগ আলী মার্কেট, বাটা গেট, কলেজগেট, গাজীপুরা বাসস্ট্যান্ড, বোর্ড বাজার, ছয়দানা, ভোগড়া বাইপাস, বাসন সড়ক সর্বশেষ জয়দেবপুরের চান্দনা চৌরাস্তা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এসব পয়েন্টে কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি জমে আছে। পানিতে সড়কের এক লেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাত্র এক লেন দিয়ে যানবাহন চলছে। ফলে যানজট বেড়েছে। এছাড়া ড্রেন নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় মাটি তুলে রাখা হচ্ছে রাস্তার ওপর। এ কারণে কোথাও কোথাও এক লেন সড়ক বন্ধ হয়ে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি সমস্যা হলো, রোজার ঈদের থেকে এবারের ঈদে বিআরটি কাজের পরিধি বেড়েছে অনেক। যেসব পয়েন্টে নির্মাণ কাজ চলছে সেখানেই রাস্তা সঙ্কুচিত হয়েছে। ঈদ দরজায় কড়া নাড়লেও কাজ বন্ধ হয়নি। কোথাও কোথাও রয়েছে রাস্তার ভাঙ্গাচোরা। পুলিশের হিসেবে অন্তত ১২টি পয়েন্টে রাস্তা খারাপ রয়েছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে যানবাহনের ইচ্ছেমতো ইউটার্ন নেয়া, এক পাশের গাড়ি অন্যপাশে যাওয়া, সড়কের দু’পাশে পার্কিং, ইচ্ছেমতো সড়কের মাঝখানে যাত্রী ওঠানো-নামানোর কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া কিছু কিছু পয়েন্টে দূরপাল্লার গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে সড়ক সঙ্কুচিত হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে ভাসমান বাজার, সড়ক দখলেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতি বছর এই সড়কে ঈদকে সামনে রেখে বাজার বসার প্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে ঈদ-উল-আজহায় বিচ্ছিন্নভাবে পশুর বাজার বসতে দেখা যায়। এতে সমস্যা বাড়ে। গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে মহাসড়কে যানজট নিরসনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এছাড়া আনসারসহ কমিউনিটি পুলিশ যানজট রোধে সড়কে কাজ করবে। পাশাপাশি পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারাও যানজট রোধে কর্মী দিয়ে সহযোগিতা করার আশ^াস দিয়েছেন। রাস্তায় পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা বন্ধের বিষয়ে আমরা কাজ করব। সেইসঙ্গে কোন অবস্থাতেই সড়কে বাজার বসতে দেয়া হবে না। জানতে চাইলে এনা পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ আতিকুল আলম বলেন, এই রুটে বিআরটি প্রকল্প চলমান কাজ যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এ প্রকল্পের কাজের কারণে অনেক পয়েন্টে চার লেনের সড়ক এক লেন হওয়ায় যানজট বাড়ছে। বিআরটি প্রকল্পের পাশাপাশি ড্রেনের মাটি রাখা হয়েছে রাস্তার ওপর। বৃষ্টির কারণে এক লেন সড়ক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে ভোগান্তি বাড়ছে। এখন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ দুই ঘণ্টার রাস্তা যেতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা লাগছে। তিনি বলেন, জয়দেবপুর থেকে মহাখালী পর্যন্ত যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টার বেশি। যানজটের কারণে ৫০টি গাড়ি দিয়ে যাত্রীসেবা দেয়া আমাদের কঠিন হচ্ছে। তিনি বলেন, জয়দেবপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের জন্য সড়ক সিঙ্গেল লেন হওয়ায় দ্রুত যানজট ছড়ায়। ঈদ উপলক্ষে প্রকল্পের কাজ বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, কাজ বন্ধ না হলে গাড়ির চাপ বাড়ায় ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে। বিআরটি আর ড্রেনেজ সমস্যা পুরনো ॥ পরিবহন সংশ্লিষ্টসহ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে তিন বছরের বেশি সময় আগে ড্রেনেজ প্রকল্পের সংস্কার কাজ শুরু হলেও অদৃশ্য কারণে তা দিনের পর দিন বন্ধ রয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলে রাস্তার এক লেনের বেশি অংশ পানিতে ডুবে থাকে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে মোট সড়কের অর্ধেক পানিতে ডুবে থাকায় এক লেনে যানবাহন চলতে পারে। তাছাড়া সড়কের বেশকিছু স্থানে বিভিন্ন মিল কারখানার পানি জমে থাকে। এ সমস্যা চলছে দীর্ঘ সময়। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি ঈদ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা। তা না হলে এই সড়কে মহাদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের কাজ বন্ধে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও টঙ্গী ব্রিজ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কজুড়ে আছে অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচলের দৌরাত্ম্য। নানা উদ্যোগের পরও এসব যানবাহন কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। চালু করা সম্ভব সহচ্ছে না বিকল্প পরিবহনও। দেড় কিলো সড়ক বন্ধ থাকে সারাবছরই ॥ এ যেন মামা বাড়ির আবদার। গাড়ি নিজের। অথচ পার্কিং করা হচ্ছে না নিরাপদ স্থানে। একটি ব্যস্ততম মহাসড়কের পাশে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর। এতে যানজটের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে লাখো যাত্রীকে। টঙ্গী মিল গেট থেকে চেরাগআলী পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার সড়কের চিত্র এটি। রাস্তার দু’পাশে হাজারো পণ্যবাহী ট্রাক রাখা হয়। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। যেন দেখার নেই কেউ। ঈদ উপলক্ষে টঙ্গী-গাজীপুর মহাসড়কে চলা উন্নয়ন কাজ বন্ধ থাকার কথা জানিয়ে গাজীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন জানান, যেসব এলাকায় রাস্তা ভাঙ্গা রয়েছে সেগুলো দ্রুত সংস্কার হচ্ছে। ভোগড়া বাইপাস এলাকায় যানজট রোধে সড়ক সংস্কারের পাশাপাশি যানজট নিরসনে সব রকমের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভারি বর্ষণ হলে সড়ক ডুবে যেতে পারে। এতে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষ ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। তাই পানি নিষ্কাশনের জন্য মেশিনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
×