ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিজ্ঞায় অনড় ও মনোবলে চাঙ্গা!

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ৭ আগস্ট ২০১৯

প্রতিজ্ঞায় অনড় ও মনোবলে চাঙ্গা!

১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন লর্ড ফিনার ব্রুকওয়ে তার এক মন্তব্যে বলেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিটলারের সময় হতে আজ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে নির্লজ্জভাবে প্রত্যাখানের নজির হলো পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক পূর্ববঙ্গে সামরিক হস্তক্ষেপ। বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটা সত্যি লজ্জাজনক যে, জনদুর্ভোগ লাঘবের জন্য তারা সঠিকসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পূর্ববঙ্গের হত্যাযজ্ঞ ছিল হিরোশিমার ট্র্যাজেডির পর সংগঠিত পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম। ৭নং সেক্টরের গেরিলা প্রধান আহসান হাবিব এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল বগুড়া জেলার সাবগ্রামে হানাদারদের একটি মিলিটারী লরী এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে লরিটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং ৩ জন পাকসেনা নিহত ও একজন আহত হয়। ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযোদ্ধা জুয়েল, বদিউজ্জামান, আলম, পুল, স্বপন ও সামাদ ফার্মগেটের মিলিটারী চেকপোস্টের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর এ অভিযানে পাঁচজন মিলিটারী পুলিশ ও তাদের সহযোগী ছয়জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সেক্টরের হরিমঙ্গলে ২ জন কসবা এলাকায় ৩ জন পাকসেনাকে হত্যা করে ও ৩ জনকে আহত হয়। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী ধোপাখালী বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী সম্মুখযুদ্ধ হয়। ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে শহীদ হন ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। এরা হলেন তৎকালীন ইপিআর সদস্য হাবিলদার আবদুল গফুর, নায়েক আবদুল রশিদ, সিপাহী আবু বকর, সিপাহী আবদুল আজিজ ও সিদ্দিক আলী। তৎকালীন সেনা সদস্য সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সেদিন ভোরে ধোপাখালী বাজারে পৌঁছান। লক্ষ্য পাকবাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ চালানো। ফজরের আজান শেষ হওয়া মাত্রই মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে চারদিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রায় ২ ঘণ্টাকাল উভয়পক্ষের তুমুল যুদ্ধে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য মারা যায়। এ অবস্থায় পাকবাহিনী যশোরের দিকে পালিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষ হলে এলাকার লোকজন ঘটনাস্থলে এসে শহীদ ৫ মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফন করে। এদিকে ঐ যুদ্ধে দলনেতা ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমান পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় সীমান্তরেখা পেরিয়ে ভারতীয় হাসপাতালে পৌঁছাতে সক্ষম হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া ইউনিয়নের কানিকোশালগাঁও গ্রাম থেকে ৬ জন গ্রামবাসীকে ধরে রামনাথ হাটের নুরুল ইসলামের বাড়িতে নিয়ে যায়। ঠাকুরগাঁও দখল করার পর এই বাড়িতেও পাকিস্তানী সেনাছাউনি স্থাপন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের এই নেতার আত্মীয় হওয়ার সুবাদে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সৈন্যরা ৬ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের আগমনের খবর পেয়ে বাড়ির সব নারী, শিশু ও কিশোররা আজিম উদ্দিনের স্ত্রীর ঘরে জড়ো হয়েছিলেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা ওই ঘর থেকে কিশোর রেজাউলকে, বাড়ির অন্যান্য ঘর তল্লাশি করে আজিম উদ্দিন ও আরও ৪ জনকে ধরে সেনাছাউনিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সারারাত অমানুষিক নির্যাতনের পর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। পরে তাদের লাশগুলো রামনাথ হাট সেনাছাউনির পাশে অর্থাৎ এমপিএ ফজলুল করিমের বড় ভাই নুরুল ইসলামের বাড়ির আঙিনায় গর্ত করে মাটি চাপা দেয়া হয়। মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক এই গণহত্যায় ৬ জন আত্মীয়-পরিজন শহীদ হন। কুমিল্লা সেক্টরের শালদা নদী এলাকায় শত্রুবাহিনীর সকল অবস্থানই ধ্বংস করা হয়েছে এবং শত্রুসেনারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে গিয়েছে। শুধু মন্দাবাগ এবং সালদা নদী এলাকায় ৩৩ পাকসেনা নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়েছে। মন্দাবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ১০০ শত্রু বাঙ্কার ধ্বংস করা হয়েছে এবং পুরো এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। কসবা-কুমিল্লা রোডে রেলব্রিজ, কালভার্ট, বৈদ্যুতিক খুঁটি, রেললাইন পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কসবাতে এক সফল এ্যামবুশ চালিয়ে ১৩ পাকসেনাকে হত্যা করা হয়েছে। গেরিলারা গোমতী নদীর চারপাশের এলাকায় বারবার গুলিবর্ষণ এবং এ্যামবুশ করে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সংক্রান্ত শ্বেতপত্রের বিবরণ মিথ্যার বেসাতি বলে মন্তব্য করা হয়। ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দলত্যাগী সৈনিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রকাশ্য আক্রমণ শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম কুষ্টিয়ায় শান্তি কমিটির এক সভায় বলেন, আওয়ামী লীগ ও এর প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিব ও তার ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ সদস্যদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বীর জওয়ানরা যথাসময়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে জনগণের দুর্ভোগের সীমা থাকত না। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সুর্ক থাকার এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের দমনে শান্তি কমিটি, রাজাকার মুজাহিদ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য জামায়াত কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। নেত্রকোনায় বাংলা প্রাইমারী স্কুল প্রাঙ্গণে শান্তি কমিটির নেতা ফারুক আহমদ এক সভায় বলেন, ‘পাকিস্তান টিকে না থাকলে মুসলমানদের ধর্ম, কৃষ্টি, তাহজীব-তমদ্দুন, ইজ্জত কিছুই রক্ষা হবে না। ২৪ বছর পূর্বে এ দেশের মুসলমানরা যেমন অধিকার বঞ্চিত ও অবহেলিত ছিলো, ঠিক তেমনি অধিকারহীন হয়ে হিন্দুদের গোলামে পরিণত হবে। আর এ জন্যেই শেখ মুজিব ও তার বাহিনী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। ‘দি হিন্দুস্তান টাইমসে’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার মধ্যে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সমঝোতার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। সামরিক জান্তার নৃশংসতার একটাই পরিণতি যা গেরিলাদের যুদ্ধের প্রতিজ্ঞাকে অনড় ও মনোবলকে চাঙ্গা করছে। ফরাসীদের বিরুদ্ধে আলজেরীয় গেরিলাদের যুদ্ধ কৌশলের চেয়েও মুক্তি ফৌজ গেরিলাদের যুদ্ধ কৌশল উঁচুমানের ও অধিক কার্যকর ছিল বলে মনে হয়েছে। গেরিলাদের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনঃস্থাপনে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার দক্ষতা আলজেরিয়ায় ফরাসী বাহিনীর চেয়ে নিম্নমানের ছিল। রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করা ছিল তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা ও বাংলাদেশের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা অনেক আগেই শেষ হয়েছে, তাদের নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা বাংলাদেশের জনগণের মনোবলকে আরও দৃঢ় করছে পশ্চিম পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত ও স্বাধীন করতে। আমার বিশ্বাস বিশ্ব জনমত মুক্তি ফৌজকে সহায়তার অজুহাতে পাকিস্তানী বাহিনীর ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপকে মেনে নেবে না। যে কেউ চাইলেই দেখতে পারে যে, মুক্তি ফৌজের অপারেশন বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সংগঠিত হচ্ছে। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক ও খ অঞ্চলের সরকারী আইন প্রশাসক লেঃ জেঃ এ.এ.কে.নিয়াজী পাকিস্তানের ঐক্যসংহতি রক্ষায় বগুড়ার জনসাধারণের একনিষ্ঠ কর্মপ্রচেষ্টার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। পশ্চিম সীমান্ত বরাবর আত্মরক্ষামূলক কাজে সেনাবাহিনী মোতায়েন ব্যবস্থাবলী পরিদর্শনের জন্য জে.নিয়াজী এ এলাকায় একদিনের সফরে গমন করেন। জেনারেল নিয়াজী শান্তি কমিটির সদস্যদের এক যৌথ সভায় প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন যে, আপনারা জাতির জন্য এক অমূল্য সেবা করছেন। তিনি আরও বলেন যে, ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সেবা করার অর্থ হলো ইসলামের সেবা করা এবং আল্লাহ তাদের এ মহান কাজের জন্য অবশ্যই পুরস্কৃত করবেন। জেনারেল নিয়াজী জনসাধারণকে মুসলমানদের অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, ইসলামের অনুশাসন অনুসরণ করেই একদিন তারা বিরাট গৌরব অর্জন করেছিল এবং আমরা যদি ইসলামের অনুশাসন সুতার সঙ্গে অনুসরণ করি তবে আমরাও তা অর্জন করতে পারি। জাতীয় স্বার্থ ব্যাহত করার জন্য যে সব লোক শত্রুর ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে লেঃ নিয়াজী জনসাধারণকে তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দেন। জেনারেল নিয়াজী আরও বলেন, উদ্বাস্তু শিবিরে যারা আমাদের নারী ও শিশুদের প্রতি দুর্ব্যবহার করছে ও আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত করছে তারা কখনোই জনসাধারণের শুভাকাঙ্খী হতে পারে না। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×