ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ইনস্টাগ্রাম

প্রকাশিত: ০৯:২২, ৭ আগস্ট ২০১৯

নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ইনস্টাগ্রাম

সোশ্যাল মিডিয়া ইনস্টাগ্রাম এখন এক ভিন্ন ধরনের সঙ্কটের মুখে। এর গ্রাহকদের কাছে নানা রকমের হুমকি, ভয়ভীতি, কুৎসা, অশ্লীল বক্তব্য ও ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। গ্রাহকরা এ নিয়ে বিব্রত ও বিরক্ত। এসব আপত্তিকর বিষয় মোকাবেলা করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। ২০১০ সালে কেভিন সিসট্রোম ও মাইক ক্রাইগার নামে বিশের কোঠার বয়সী দুই তরুণ ইনস্টাগ্রাম চালু করেছিল। তারা তখন আশা করেছিল এই সোশ্যাল মিডিয়ার গ্রাহকরা একটা ফটো শেয়ারিং এ্যাপ ডাউনলোড করবে যা তাদের জীবনকে সুন্দর করে দেখাবে। হয়েছিলও তাই। এক বছরের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে ৫ লাখেরও বেশি নারী-পুরুষ ইনস্টাগ্রামের গ্রাহক হয়। তবে অচিরেই এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, গ্রাহকদের অনেকে কুৎসিত কাজেও এই এ্যাপকে ব্যবহার করছে তরুণ মালিকদ্বয় সোশ্যাল মিডিয়াটির সেই প্রাথমিক দিনগুলোতে নিজেরাই এসব অভব্য, কুৎসিত, অশ্লীল ও বিকৃত মন্তব্যগুলো মুছে ফেলে এবং ট্রলগুলো নিষিদ্ধ করে। ওরা যখন ইনস্টাগ্রাম ছেড়ে চলে যান ততদিনে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১শ’ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এত বিশাল সংখ্যার ওপর নজরদারি করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অন্য যেসব সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম সন্ত্রাসবাদীদের প্রচারণা থেকে শুরু করে শিশু পর্নোগ্রাফির উপকরণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে তাদের মতো ইনস্টাগ্রামও এ কাজে মেশিনকে আশ্রয় করে বসে। ইনস্টাগ্রামকে আরও সদয়, ভদ্র, বিনম্র ও সুশীল স্থান করে তোলার চেষ্টায় এর প্রতিষ্ঠাতারা ফেসবুকের কাছ থেকে ডিপটেস্ট নামে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) হাতিয়ার ধার করে। লোকে প্ল্যাটফর্মে যে ভাষা ব্যবহার করছে সেটাকে বোঝা ও ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভাবন করা হয়েছিল। ইনস্টাগ্রামের প্রকৌশলীরা অসঙ্গত ও অনুচিত শব্দাবলী খুঁজে বের করার জন্য ২০১৬ সালে প্রথম এই হাতিয়ারটি ব্যবহার করেছিল। পরের বছর তারা সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এমনভাবে তালিম দেয় যাতে তা জাতিগত ও বর্ণগত বিদ্বেষ, কুৎসা, অবমাননাকর শব্দাবলীসহ আপত্তিকর এবং বাজে ধরনের মন্তব্য খুঁজে বের করতে ও তা আটকে দিতে পারে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি তারা হুমকি-ধমকি শাসানিযুক্ত মন্তব্য খুঁজে বের করার কাজেও এটা ব্যবহার করছিল। গত অক্টোবরে মোসেরি ইনস্টাগ্রামের দায়িত্ব নেয়ার এক সপ্তাহ পর প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা করে যে তারা পোস্ট করা কোন কিছুর নিচে লেখা তর্জন-গর্জন বা শাসানিযুক্ত মন্তব্য খুঁজে বের করার কাজেই যে শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করবে তা নয়, পোস্টের ভেতরকার শাসানিযুক্ত শব্দের সন্ধান বের করতে মেশিনও ব্যবহার শুরু করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বলাটা সহজ করাটা কঠিন। আজ ইনস্টাগ্রামের কনটেন্ট স্ক্যান করার জন্য তিনটি বুলিং ক্ল্যাসিফাইয়ার রয়েছে। একটি বিষয়বস্তু, একটিকে ফটো এবং অন্যটিকে ভিডিও বিশ্লেষণ করার জন্য ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। তবে এই মেশিনগুলো অনেক পুরনো এবং সেগুলো প্রচুর শাসানিমূলক জিনিস ধরতে পারছে না। একটা মস্কো চ্যালেঞ্জ হলো মেশিনকে নগ্নতার মতো বিষয় বের করার ট্রেনিং দেয়া যথেষ্ট সহজ। প্যান্ট পরা নেই এমন কারোর ছবি বের করা মেশিনের জন্য তেমন সমস্যা নয়। কিন্তু শাসানি বলে গণ্য হতে পারে এমন অজস্র আচরণ চিহ্নিত করতে পারা মেশিনের জন্য সহজ নয়। তাছাড়া সাইবার বুলিংয়ের সুনির্দিষ্ট কোন সতেজতা নেই। একেক জনের কাছে তা একেক রকম। এ অবস্থায় ইনস্টাগ্রাম কার্যকর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই উদ্ভাবনের জন্য কাজ করে চলেছে। যত ধরনের শাসানি, অপমান, গাািলগালাজ হতে পারে তা আরও ভালভাবে বোঝার জন্য ইনস্টাগ্রাম হাজার হাজার ব্যবহারকারীর ওপর জরিপ চালাচ্ছে। শাসানি সম্পর্কে কোম্পানির ব্যাপক কার্যোপযোগী সংজ্ঞাটি হলো এমন এক কনটেন্ট যার উদ্দেশ্য অন্যদের হয়রান করা বা লজ্জা দেয়া। তবে হালে সেই সংজ্ঞাটি ভেঙ্গে ৭টি উপশ্রেণী করা হয়েছে যেমনÑ অপমান করা, লজ্জা দেয়া, হুমকি দেয়া, অসম্মান করা, ব্যক্তিসত্তার ওপর আঘাত হানা, অবাঞ্ছিত যোগাযোগ করা এবং বেইমানি করা। কোম্পানির যে বিশাল পরিকল্পনা আছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভাবন করা যা এই ৭টি শ্রেণীর প্রতিটিকেই বুঝতে পারবে। তবে প্রকৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। তথাপি সমস্যা সমাধানে এটা অনেক উন্নততর কৌশল। ইনস্টাগ্রামের প্রকৌশলীরা নির্দোষ থেকে মন্দ আচরণগুলো পৃথক করার জন্য এ্যাকাউন্টের আচরণ কাজে লাগানোর উপায় নিয়েও গবেষণা চালাচ্ছেন। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় ইংরেজী ‘হো’ শব্দটি যখন কোন পুরুষ কোন মহিলাকে বলে তখন সেটিকে শাসানি বা আপত্তিকর শ্রেণীতে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু সেই একই শব্দ যখন কোন মহিলা তার বন্ধুর উদ্দেশে বলে তখন সেটাকে ওই শ্রেণীভুক্ত করা যায় না। ব্যাপারটা ফটো ও ভিডিওর ক্ষেত্রে এলে ক্লাসিফাইয়ারগুলোর অতটা চর্চা নেই বলে সেগুলো সে রকম পারঙ্গম নয়। তাছাড়া সেগুলো অতটা উন্নতও নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটা স্পিøট স্ক্রিন অনেক সময় শাসানি বা গালিগালাজের লক্ষণ বলে গণ্য হয় বিশেষ করে মেশিনে যদি এটা নির্ণয় করা যায় যে ছবির একদিকে একজন মানুষ ও অন্যদিকে একটা জন্তু আছে। প্রতি সপ্তাহেই গবেষকরা তাদের প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর রিপোর্ট করছে এবং প্রতি সপ্তাহেই শাসানি ও হুমকি-ধমকির এমন সব নতুন রূপ দেখছে যা প্রকৌশলীরা দেখতে পাবেন বলে কখনও ভাবেননি। তবে ফেসবুকের টিম ও সম্পদের সহায়তায় ইনস্টাগ্রামের কর্মচারীরা এই সমস্যা মোকাবেলা করতে পারবে বলে আশাবাদী। তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১২শ’ কর্মচারীর কতজন কিংবা ফেসবুকের ৩৭ হাজার ৭০০ কর্মচারীর কতজন অনলাইনে শাসানি বা আপত্তিকর বিষয় পোস্টিং দেয়া বন্ধের ওপর কাজ করছে ইনস্টাগ্রাম তা জানাতে রাজি নয়। তেমনি জানাতে রাজি নয়, বর্তমানে সক্রিয় ক্লাসিফাইয়ের ভুলের হার। এক হিসাবে দেখা গেছে যেÑ কিশোর-কিশোরীদের ৮০ শতাংশ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে এবং তাদের অর্ধেক শাসানি, হুমকি-ধমকি ও আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হয়। ইনস্টাগ্রামের প্রধান এডাম মোসেরি বিশ্বাস করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের নতুন মান নির্ধারণের মধ্য দিয়ে তার প্রতিষ্ঠান হুমকি-ধমকি বা এ জাতীয় মন্তব্য বন্ধ করতে পারবে। তাছাড়া এমন কর্মধারাও উদ্ভাবন করতে পারবে যেগুলো অন্যান্য প্লাটফর্মও অবলম্বন করতে পারে। ইনস্টাগ্রাম শীঘ্রই দুটোর নতুন কৌশল চালু করতে যাচ্ছে। একটি হচ্ছে মন্তব্য সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়া। ধরা যাক, কেউ একটা পোস্টের ওপর কোন মন্তব্য করতে গেল এবং ইনস্টাগ্রামের বর্ডার লাইন কনটেন্টে তা ধরা পড়ল। তখন ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীকে প্রম্পট দেবে অর্থাৎ শব্দ চয়নের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে তাকে উৎসাহিত করবে। উদ্দেশ্য তাঁকে একটু সতর্ক করে দিয়ে বলা ‘ওহে তোমার এই কথাগুলো আপত্তিকর হতে পারে। ‘অথচ তার পোস্টিংটা আটকে দেয়া হবে না। দ্বিতীয় কৌশলটা হলো ‘রেসট্রিক্ট’। এটা ব্লকিংয়ের এক গোপন সংস্করণ। ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের পোস্ট ব্লক করা হলে তারা বলতে পারে পোস্টটা ব্লক করা হয়েছে। কিন্তু রেসট্রিক্ট করা হলে তারা তা জানতেও পারবে না। যারা আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার তারা এ ধরনের এ্যাকাউন্ট থেকে আসা মন্তব্য অন্য কেউ দেখতে পারার আগে নিজেরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারবে। এরপর তারা সেই মন্তব্য অনুমোদন করতে, ডিলিট করতে কিংবা চিরতরে শিকেয় তুলে রাখা অবস্থায় রাখতে পারবে। যিনি সেই মন্তব্য করেছেন তিনি ছাড়া অন্য আর কেউ তা দেখতে পারবে না। তাদের কাছে তা অদৃশ্য হয়ে থাকবে। সরাসরি বার্তার ক্ষেত্রেও তাদের একই রকমের ক্ষমতা থাকবে। বাজে বা কুৎসিত উক্তিকারী যদি সেই ব্যবহারকারীকে পাবলিক পোস্টে ট্যাগ করার চেষ্টা করে তা হলে ইনস্টাগ্রামের দিক থেকে কোন সাহায্য পাবে না। বাজে উক্তিকারীকে ব্যবহারকারীর নাম জানতে ও সঠিকভাবে টাইপ করতে হবে। ফলে ব্যাপারটা তার জন্য তখন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ইনস্টাগ্রাম নেতিবাচক মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ার আগে সেগুলো চিহ্নিত করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে নতুন হাতিয়ার চালু করেছে তাতে ব্যবহারকারীদের এ ধরনের মন্তব্য পোস্ট করার আগে নতুন করে ভেবে দেখতেও পরামর্শ দিচ্ছে। অন্য ব্যক্তির পোস্টে সেই মন্তব্য শেয়ার করার আগে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীকে জিজ্ঞেস করছে : ‘আপনি কি নিশ্চিত যে এই মন্তব্য আপনি পোস্ট করতে চান?’ এতে অবশ্য নেতিবাচক মন্তব্যকারী ব্যক্তিদের নিবৃত্ত করা যাবে না। তবে এতে তারা মন্তব্যটি পোস্ট করতে যাওয়ার আগে বাতিল করার সুযোগ পাবে। অনলাইনে বাজে বা অশালীন উক্তি এবং নেতিবাচক মন্তব্য মোকাবেলায় ইনস্টাগ্রাম যতটা যা করা উচিত তা করছে না এই মর্মে জোর সমালোচনা ওঠার পর প্রতিষ্ঠানটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নতুন কৌশল চালু করে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে আমেরিকার কিশোর-কিশোরীদের ৫৯ শতাংশ অনলাইনে শাসানি, অশালীন মন্তব্য ও হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। যুক্তরাজ্য ১২ থেকে ২০ বছরের ছেলেমেয়েরা সাইবার বুলির শিকার হচ্ছে। এমন ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। এ অবস্থায় ইংরেজী ভাষাভাষী ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীরা প্রথম ওই নতুন কৌশলটি ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এরপর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার ঘটবে। ইনস্টাগ্রাম প্রধান এডাম মোসেরি বলেন, ‘আমরা জানি বুলিং এক মস্ত চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের জন্য। তবে আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই শিল্পকে নেতৃত্ব দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সূত্র : টাইম
×