ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুঁই, সুতা, পুঁতি পাথরে ভাগ্য বদল

শাড়িতে নক্সা করে ৫০ গ্রামের নারীরা আজ স্বাবলম্বী

প্রকাশিত: ১১:০৯, ৬ আগস্ট ২০১৯

শাড়িতে নক্সা করে ৫০ গ্রামের নারীরা আজ স্বাবলম্বী

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ কবিতা ও গানে শাড়ি বন্দনা হয়েছে যুগে যুগে। বাঙালী রমণীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি। বাংলার নারীদের শাড়ি ব্যবহার সেই প্রাচীনকাল থেকেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের শাড়ির প্রচলন। ১২ হাত দৈর্ঘ্যরে শাড়ি অনেক নারীর খুব প্রিয় পোশাক। পুরুষ কবি সাহিত্যিকদের লেখা গল্প-কবিতায় শাড়ি-বন্ধনা দেখেই অনুমান করা যায় শাড়ির মাহাত্ম্য। এদেশে ঐতিহ্যবাহী কত রকমের শাড়িই না রয়েছেÑ সুতি, সিল্ক, জামদানি, বেনারসি, কাতান, কাঞ্জিভরম, মসলিন। আমাদের বাংলাদেশ তো এক সময় মসলিন শাড়ির জন্য বিখ্যাত ছিল। সবই আজ ইতিহাসের অংশ। কুরবানির ঈদ সামনে রেখে স্কুল পড়ুয়া ছোট ছোট শিশুসহ নারীরা নরম হাতের ছোঁয়ায় সুঁই সুতা দিয়ে কারুকাজ করে আজ স্বাবলম্বী হওয়ার পথে ৫ শতাধিক নারী। সুঁই সুতা পুঁতি পাথরÑ এসব অনুষঙ্গ দিয়ে শাড়িতে বাহারি রকমের নক্সা তৈরি করে ভাগ্য বদলের চেষ্টা করছেন অর্ধশত গ্রামের নারী। এতে সফলতাও পেয়েছেন অনেক নারী। কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার কুড়িমারা, দীপেশ্বর, গাঙ্গাটিয়া, পুমদি, ডাংরী, পানান, সৈয়দপুর, কেশেরা, দক্ষিণ গোবিন্দপুর ও নামা সীদলাসহ প্রায় ৫০ গ্রামের নারীরা ঈদকে সামনে রেখে শাড়িতে নক্সা তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সংসারের অভাব অনটন ঘুচাতে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছেন তারা। স্থানীয় কারিগররা বলেন, উপজেলার প্রায় ৮ হাজারেরও বেশি নারী শাড়িতে নক্সার কাজ করেন। কয়েক বছর ধরে তারা নিজ বাড়ির আঙিনায়, উঠান ও ঘরের মেঝেতে শাড়িতে নক্সা তোলার কাজ করেন। ঈদ আসলেই এসব নক্সি শাড়ির চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সুঁই সুতার কাজ করেন বেশির ভাগ নারীরাই। সারাদেশেই তাদের হাতেই নিপূণ কাজের কদর রয়েছে। কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেয়া গেছে, ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন আকর্ষণীয় ও মনোরম ডিজাইনের পুঁতি ও সুতা দিয়ে বাহারি রঙের শাড়িতে নক্সার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের কারিগররা। তাদের সহযোগিতা করছে শিশুরাও। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে রাত দিন একটানা অর্থ উপার্জনের জন্য শাড়িতে নক্সা করে যাচ্ছেন তারা। বাদ যাচ্ছে না স্কুল পড়ুয়া মেয়েরাও। শাহেদল কুড়িমারা, রহিমপুর, আশুতিয়া, দ্বীপেশ্বরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে প্রতিটি বাড়িতে এখন পুরোদমে শাড়িতে পুঁতি ও সুতা দিয়ে বিভিন্ন নক্সা বাহারি রঙের শাড়িতে কাজে ডিজাইন আঁকে কারিগররা। এসব শাড়ি ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছ থেকে এবং এর ডিজাইন আঁকা অবস্থায় নামমাত্র মজুরির চুক্তিতে নিয়ে আসেন তারা। দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুরা মিলে শাড়ির ডিজাইন মতো সুতা ও পুঁতি দিয়ে নক্সা প্রস্তুত করে থাকেন। যেসব শাড়িতে ডিজাইন থাকে বেশি সেসব নাড়িতে নক্সা তৈরিতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগে। একেকটা শাড়িতে ডিজাইন ও প্যাটার্নভিত্তিক মজুরি ভিন্ন হয়ে থাকে। বেশি ডিজাইনকৃত শাড়িতে নক্সার মজুরি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পান তারা। ওই সব শাড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নামীদামী মার্কেটে বিক্রি হয়। কয়েক নক্সাকার বলেন, ‘আমাদের হাতে তৈরি পোশাকের কদর আমরা বুঝি না। যখন মানুষজন এই পোশাকগুলো বড় বড় শোরুম থেকে কিনে ব্যবহার করেন, তখনই আমরা বুঝতে পারি এগুলো আমাদের হাতে তৈরি।’ শাড়িগুলো খচরা বিক্রেতারা ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকে। কথা হয় দ্বীপেশ্বর গ্রামের নক্সার কারিগর ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী চুমকির সঙ্গে। সে জানায়, সংসারের দিনমজুর বাবার পক্ষে ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ ও খাবার জোগাড় করা কষ্টসাধ্য। তাই বাড়তি কিছু উপার্জনের জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি শাড়ির নক্সাতে কাজ করছি। এসব শাড়ির কাজে যে মজুরি পাই তা দিয়ে সংসারের সচ্ছলতা আনার চেষ্টা করি। শাড়ি ব্যবসায়ী ও মহাজনরা শাড়িগুলো অনেক বেশি দামে বিক্রি করে অথচ আমরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। শাহেদল গ্রামের নক্সা কর্মী রহিমা বলেন, আমাদের হাতের তৈরি শাড়িগুলো মহাজনরা নিয়ে বেশির ভাগ সময়ই ভারতে বিক্রি করেন। ভারত ঘুরে একই শাড়ি ফের বাংলাদেশে আসার পরেই এক একটা শাড়ির দাম ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য কাজ করি। শাড়িতে কাজ করে যা পাই তা দিয়ে সংসার ভালই চালাতে পারছি’। কুড়িমারা গ্রামে বিলকিস বলেন, অভাবের তাড়নায় সবাই শাড়িতে নক্সা তৈরির কাজ করে। তবে মহাজনরা যদি আরও বেশি মজুরি দিত, তাহলে ভালভাবেই সংসার চালাতে পারতাম এ জন্য তারা সুঁই সুতার কারিগরদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করেন। ঢাকার শাড়ি ব্যবসায়ী আবদুল কালামসহ অনেকে জানান, পুঁতি-সুতার মূল্য বেশি। পরিবহন খরচ ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাড়ায় তাদের খুব বেশি লাভ থাকে না। তাই সুঁই-সুতার কারিগরদের পারিশ্রমিক বাড়ানো আপাতত সম্ভব নয়। হোসেনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমল কুমার ঘোষ বলেন, বিষয়টি আমি এসব এলাকা অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিদর্শন করি। কুটির শিল্প কারিগরদের ডাটা বেজ তৈরি করে তালিকা করা হচ্ছে। আমরা সমিতির মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়নের কাজ করছি। তারপরও যদি কেউ আলাদা ঋণ সুবিধা নিতে চায় তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।
×