ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

বহুমাত্রিক শেখ কামাল

প্রকাশিত: ০৮:২৮, ৫ আগস্ট ২০১৯

বহুমাত্রিক শেখ কামাল

জীবদ্দশায় শেখ কামালের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হয়েছে। তার সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট গুজবেরও শেষ ছিল না। সবই করা হতো তার চরিত্র হননের জন্য। শেখ কামালের ওপর আঘাত তো প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উপরেই আঘাত। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ভাবমূর্তি নষ্টেরই অপচেষ্টা। যারা কাছের তারা বুঝতেন এটা ষড়যন্ত্র। তারা অপপ্রচার এবং গুজবকে পাত্তা দিতেন না। আর যার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, যাকে নিয়ে উদ্ভট গুজব, সেই শেখ কামাল ছিলেন সর্বংসহা। হাস্যমুখে অদৃষ্টকে বরণ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল যেন তার। কুৎসিত ললাট লিখনকে মুহূর্তে মুছে ফেলে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে তিনি করে যেতেন তার সকল কর্মকান্ড। পড়াশোনা, খেলাধুলা, নাটক, গান-বাজনা, রাজনীতি, পরোপকার। কাজের কি শেষ আছে। আর বন্ধু-অবন্ধু সবাইকে নিয়ে ফাঁক পেলেই সে কী প্রাণোচ্ছ্বল আড্ডা। আড্ডার কোন নির্দিষ্ট স্থান ছিল না। যখন যেখানে তখন সেখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র, মধুর ক্যান্টিন, শরীফের চায়ের দোকান, আবাহনী ক্লাব, ছাত্রলীগ অফিস। নিজে পড়তেন সোসিওলোজি ডিপার্টমেন্টে। প্রতিদিন সকালে তাঁর কর্মদিবস শুরু হতো সেখান থেকেই। ডিপার্টমেন্টের সহপাঠী, ছোট বড় সবাইকে নিয়ে ডিপার্টমেন্টের অফিস কর্মচারীদের খোঁজ-খবর নিতেও ভুল করতেন না বলে শুনেছি। শিক্ষকদের প্রতি সম্মান ছিল প্রগার। এ কথাও তাঁর শিক্ষকদের মুখেই শুনেছি। শিক্ষকরাও সরলপ্রাণ শেখ কামালকে খুবই পছন্দ করতেন, ভালবাসতেন। আজ ৫ আগস্ট। বহুমাত্রিক শেখ কামালের জন্মদিন। ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার ঘর আলো করে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে বঙ্গমাতার কোল ভরেছিলেন আরও তিন সন্তান। শেখ জামাল, শেখ রেহানা, শেখ রাসেল। শত দুঃখ-কষ্ট, ঝড়ঝঞ্ঝা, নানামুখী চাপ ইত্যাদির মাঝেও ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িটিতে বয়ে যেত সুখের ফল্গুধারা। থাকত সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির নির্মল আনন্দ। অতি অল্পতেই খুশি থাকত গোটা পরিবার। বত্রিশ নম্বরের পরিবারটির ওপর রাজনৈতিক চাপটাই ছিল সবচেয়ে বড়। বঙ্গবন্ধু ক্রমান্বয়ে গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকছেন, সরকারের রোষানল, ঘনিষ্ঠজনদের চোখ ফিরিয়ে রাখা, বিপদে মানুষকে পাশে না পাওয়া এতসব কঠিন সত্যকে মেনে নিয়ে বঙ্গমাতা ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরকে যেভাবে গুছিয়ে ও সামলে রেখেছিলেন তাতো রীতিমতো দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সন্তানদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মতো দুরূহ কাজটিও তিনি করেছেন গভীর প্রজ্ঞা আর স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টির কারণে। একদিকে সংসার পালন, সন্তানদের সুশিক্ষা প্রদান অপরদিকে চারদিকের অসহনীয় বৈরী চাপ- কী কঠিনতম দায়িত্বই না পালন করতে হয়েছে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। ভালমন্দ যাই আসুক সকল কঠিনকেই তিনি ধারণ করতেন সহজিয়া দৃঢ়তায়। শেখ কামাল বোধহয় নিজ পরিবার থেকেই পেয়েছিলেন সর্বংসহা হওয়ার শিক্ষা। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার চরিত্রেও আমরা একই শিক্ষা প্রত্যক্ষ করি। তাই বিশ্বাস করতে দ্বিধা হয় না, শেখ কামাল তাঁর বিরুদ্ধে সকল কুৎসা, অপপ্রচার, গুজব ইত্যাদি নোংরা বিষয়গুলোকে যে সহজিয়াভাবে পাত্তা দিতেন না- এই শিক্ষা তিনি পরিবার থেকেই পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ছিল পিতা বঙ্গবন্ধুর চারিত্র্যিক দৃঢ়তা এবং লক্ষ্য অর্জনে অনড় অবস্থা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলোর উৎকর্ষতার ব্যাপারে তাঁর দুরদৃষ্টি নিয়েও আজ অনেকে ইতিবাচক কথা বলেন। জীবদ্দশায় যারা তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করেছেন তারাও আছেন এই দলে। মন্দ কি! শেখ কামাল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। জাতির পিতার সন্তান হয়েও তিনি ট্রেনিং ক্যাম্পে এক ফোঁটা বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করেননি। বরং অন্যান্য সহযোদ্ধার মতো কঠিন, কঠোর ট্রেনিং-এ তিনি অংশ নিয়েছেন সমানভাবে। ক্যাম্পের শৃঙ্খলার ব্যাপারে তাঁর একনিষ্ঠতা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রশংসা শোনা যায় তাঁর সহযোদ্ধাদের বর্ণনাতে। জাতির পিতার ছেলে হিসেবে যুদ্ধের ট্রেনিং-এ না গিয়ে প্রবাসে বিলাসী জীবন যাপন করলে কিইবা এসে যেত! অথবা ট্রেনিং-এ বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নিলেই বা কার কি বলার ছিল। অথচ আশ্চর্য! তিনি এসবের ধারে কাছেও না গিয়ে দেশ ও জাতির মুক্তির আদর্শে স্থির প্রতিজ্ঞ ছিলেন। যার পিতা জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা শত্রু শিবিরে বন্দী, মাসহ পরিবারের সবাই বন্দী জীবনে অনিশ্চয়তার ভেতর দিন কাটাচ্ছে তাঁর পক্ষে যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য ট্রেনিং ক্যাম্পের কঠিন দায়িত্ব পালন অন্য কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। শেখ কামালের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। এই একটি কারণেই কিন্তু নিন্দুকদের মুখ বন্ধ থাকা উচিত ছিল। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে শেখ কামাল সংস্কারে মন দিয়েছিলেন। ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে আজ স্পষ্টতই বোঝা যায় যে- শুধু সংস্কারই নয়, বাংলাদেশ ও জাতিকে তিনি এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন অনেক সামনে। বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ছাত্র-যুব উৎসব থেকে ফিরে এসে তিনি বলতেন ‘একদিন আমরাও পারব’। শেখ কামাল সম্পর্কে কুৎসা রটানো, অপপ্রচার, মিথ্যাচার এসব চলে দুই পর্বে। প্রথম, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকাল থেকে ’৭৫ পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘদিন। দ্বিতীয় পর্বের কারণ সহজবোধ্য। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে কুৎসিত বিষোদগার চলেছে প্রকাশ্যে। সেই সঙ্গে দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে নিয়ে মিনি পাকিস্তান বানানোর অপচেষ্টা। এর দীর্ঘ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আজ, এত বছর পর ভাবতে অবাক লাগে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় কিভাবে ষড়যন্ত্রকারীরা অপপ্রচার চালানোর দুঃসাহস পেয়েছিল। শুরু করেছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চক্র। কিন্তু অল্প সময়ের ভেতর জুটল তারাও যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে দাবি করত। চৈনিকপন্থী অভিযান ছিল, ছিল অন্যান্য বামপন্থীরাও। পরবর্তী সময়ে এই দলের নেতৃত্ব চলে আসে জাসদের হাতে। এ ব্যাপারে জাসদ সমর্থিত একটি বাংলা দৈনিক এবং তথাকথিত চৈনিকপন্থী মালিকানার একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকার ভূমিকা ছিল লজ্জাজনক। এসব সুযোগ তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণে। তাছাড়া বিরুদ্ধাচারীকে ভাল হওয়ার সুযোগ দেয়া অথবা সপক্ষে আনার অসীম ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। পাশাপাশি সকল মানুষকে ভালবাসতেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল ছিলেন বঙ্গবন্ধুরই প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর সহজিয়া জীবন দর্শন দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালবাসা- এই বিষয়গুলো শেখ কামালের মধ্যেও ছিল। তাই হয়ত নিজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সকল অপপ্রচার মহানুভবতার সাখে দেখতেন। তাই হয়ত ভাবতেন, এসবের বিরুদ্ধে সময় নষ্ট করা প-শ্রম। হয়ত ভাবতেন কুৎসা রটনাকারীরা একদিন ক্লান্ত হয়ে নষ্টামির পথ ছেড়ে দেবে, চক্রান্তকারীর নখদন্তের ধার ক্রমেই ভোঁতা হবে। উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত শেখ কামালের ভাবমূর্তি বিনষ্টে সকল চক্রান্ত, অপপ্রচার, গুজব ধোপে টেকেনি। ক্রমশ সত্য প্রকাশিত হচ্ছে। উজ্জ্বলতর হচ্ছেন শেখ কামাল। হয়ত সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পুরনো বন্ধুরা সমস্বরে বলি, হ্যাটস অফ টু শেখ কামাল। তুমি ছিলে, আছ, থাকবে। লেখক : আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ gmail.sampritebd.com
×