ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবহ সামগ্রীসমূহের প্রদর্শনী

প্রকাশিত: ১১:১২, ৪ আগস্ট ২০১৯

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবহ সামগ্রীসমূহের প্রদর্শনী

মনোয়ার হোসেন ॥ দূর থেকেই চোখে পড়ে কালো রঙের বাইসাইকেলটি। প্রদর্শনালয়ের এক কোনে স্ট্যান্ডের ওপর একাকী দাঁড়িয়ে আছে দুই চাকার বাহনটি। কাছে যেতেই জান যায়, ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই সাইকেলের সম্পর্ক। একসময় এটিতে চড়েই বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন শেখ মুজিব। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারের সময় সাইকেলটি ব্যবহার করেছিলেন জাতির জনক। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু স্মৃতি নিদর্শনের সঙ্গে ঠাঁই করে নিয়েছে সাইকেলটি। সাইকেল ছাড়াও প্রদর্শনীতে দেখা মেলে মুজিবের ব্যবহৃত কপার ধাতুতে গড়া কলমটি। শোকেসে সাজিয়ে রাখা আছে সাটিন কাপড়ের ওপর সিল্ক বর্ডারের লেখা একটি মানপত্র। কলকাতার মৌলানা আজাদ কলেজের ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুকে প্রদান করেছিলেন এই অভিনন্দনপত্রটি। কাচের একটি বাক্সে ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া ইসলামপুরের কাঁসাশিল্পীর উপহারের চকচকে কাঁসার থালাটি। এভাবেই গ্যালারির একাংশে ব্যবহার্যসামগ্রীর মাধ্যমে অনুভূত হয় মুজিবের স্পর্শ। তার ব্যবহৃত সামগ্রীর সঙ্গে তাকে দেয়া বিভিন্ন মানপত্র, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাকে নিয়ে দেশ-বিদেশের পত্রিকার সংবাদের সচিত্র প্রতিবেদন, রাজনৈতিক থেকে পারিবারিক জীবনের প্রতিচ্ছবিময় আলোকচিত্র, মুজিবকে নিয়ে চিত্রিত চিত্রকর্ম এবং তাঁকে নিয়ে রচিত গ্রন্থসম্ভারে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনীটি। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শনিবার থেকে মুজিবময় এই বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। বিস্তৃত পরিসরের গ্যালারির চারপাশের ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে মুজিবের স্মৃতি নিদর্শন, পেপার কাটিংসহ তাকে প্রতিনিধিত্ব করা নানা অনুষঙ্গ। সাদা কাগজের ওপর শাপলার জলছাপের মাঝে একটি অভিনন্দনপত্রে সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আবেগের প্রকাশটি অনুভাব করা যায়। ১৩৭৮ বঙ্গাব্দে ময়মনসিংহ মুমিনুননিসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বরণপত্রটি। সেখানে কলমের কালিতে গোটা গোটা হরফে লেখা রয়েছেÑ কি দিয়ে তোমায় করবো বরণ/মোরা যে রিক্ত সর্বহারা/যাবার আগে বাংলাকে করেছে শ্মশান/ওই পাক দস্যুরা ...। চারপাশের দেয়ালে ঝুলে থাকা আলোকচিত্রগুলোয় পাওয়া যায় তারুণ্য থেকে পরিণত বয়সের মুজিবকে। রাজনীতির ময়দান থেকে অন্দর মহলে। একটি ছবিতে নিজ লাইব্রেরিতে গভীর মনোযোগে বই পড়তে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুকে। আরেক ছবিতে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে চলছে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ের আলাপচারিতা। ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রার্থী মনোনয়নের বৈঠকে তারুণ্যে ভরপুর মুজিবের দেখা মেলে। প্রদর্শনীর এক কর্নারে শোকেসবন্দি ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দেশ বাংলা পত্রিকার একটি সংখ্যা। ছবিসহ প্রধান সংবাদটির শিরোনামে লেখা ‘ওরা মুজিবকে হত্যা করতে চায়’। সেই সংবাদের ইনসার্টে লেখা ‘কিন্তু কাপুরুষের কলিজায় সে সাহস নেই’। অধিকাংশ সাদা-কালো ছবির মাঝে একটি রঙিন ছবিতে বঙ্গবন্ধুর চমৎকার অভিব্যক্তিকে ফ্রেমবন্দী হয়েছেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ইদের নামাজে শামিল হওয়া পিতার সঙ্গে ছোট্ট শেখ রাসেলের ছবিটি আলাদাভাবে দর্শনার্থীর নজর কাড়ে। রাজশাহীর একটি নদীতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নৌকা ভ্রমণের ছবিটি মেলে ধরেছে উভয় নেতার সহজ সম্পর্কের বয়ান। স্মৃতি নিদর্শনের সঙ্গে শতাধিক আলোকচিত্র ও চিত্রকর্মের সঙ্গে গ্রন্থসম্ভারে সাজানো বিশেষ প্রদর্শনীটির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে শেখ মুজিবের স্পর্শ। শনিবার বিকেলে জাদুঘরের সংগ্রহশালা থেকে সজ্জিত মাসব্যাপী এ বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধু’ বিষয়ক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব ড. মোঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান। স্বাগত বক্তব্য দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ রিয়াজ আহম্মদ। মূল প্রবন্ধে সৌমিত্র শেখর বলেন, দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সংবিধান প্রণয়ন করা। ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিগুলো হচ্ছে- বাঙালী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, রণসঙ্গীত নির্ধারণ করা হয়। দেশের পুনর্গঠনে সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সকল অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন, শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, অসামাজিক কর্ম দমন, মুক্তিযোদ্ধা ও নারীদের পুনর্বাসন এবং কল্যাণে ট্রাস্ট গঠন, কৃষিশিল্পের সম্প্রসারণ, ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জনসহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক, তারই তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের পথ দেখাচ্ছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশগঠন একদিন সুসম্পন্ন হবেই। কে এম খালিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় নেতা থেকে আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন ঠিক সেসময় পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট বাঙালীর স্বাধীনতার ধ্বংসকামী ও মানবতার শত্রুরূপী একদল নরপশু দ্বারা নির্মম ও নৃশংসভাবে পরিবারবর্গসহ তিনি শহীদ হন। দেশ হারায় বিশ্বের এক মহানায়ককে। অন্য বক্তারা বলেন, বাঙালীর আপোসহীন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলা ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। শুধু আনুষ্ঠানিকতার বৃত্তে বন্দী না থেকে চিন্তা, মনন ও কর্মে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ ও তা বাস্তবায়ন করতে পারলেই সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। তাঁর স্বপ্নের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়াই হোক জাতীয় শোক দিবসের অঙ্গীকার। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নিদর্শন, আলোকচিত্র, চিত্রকর্ম এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রকাশিত গ্রন্থের প্রদর্শনীটি চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে দশটা এবং বিকেল সাড়ে পাঁচটা এবং শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রদর্শনী বন্ধ থাকবে।
×