ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কোরবানির পশুর হাট ঘিরে ডেঙ্গু নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক

প্রকাশিত: ১১:১১, ৪ আগস্ট ২০১৯

কোরবানির পশুর হাট ঘিরে ডেঙ্গু নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক

ওয়াজেদ হীরা ॥ আতঙ্কের নাম এখন ডেঙ্গু। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই ছড়িয়েছে এই রোগ। এমন অবস্থায় চলতি সপ্তাহেই রাজধানীতে বসছে পশুর হাট। আর হাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন বর্জ্যসহ নানা অপরিচ্ছন্নতার কারণে ভয়াবহ আকার ধারণের শঙ্কা রয়েছে এই ডেঙ্গুর। ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও থাকছে। এখনই হাটকেন্দ্রিক মহামারী আকার রোধে ওষুধ ছিটানোসহ বিভিন্ন তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নয়ত খোলা স্থান থেকে গ্রামের খামারিদের হতে পারে ডেঙ্গু। সেই সঙ্গে হাটে পশু কিনতে আসা ক্রেতারাও থাকছেন ঝুঁকিতে। ঢাকা ছাড়াও দেশের অনেক শহরে এডিস মশা আছে। এরই মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ছাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু এক আতঙ্কের নাম। এমন আতঙ্কের মধ্যেই এবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কোরবানির ঈদ। যদিও ঈদের সময় স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তবে আতঙ্ক যেন কাটছে না। বাসাবাড়ি, অফিস, স্কুল, ফুটপাথ, চায়ের দোকান- সবখানেই ডেঙ্গু নিয়ে অজানা আতঙ্ক। ফলে বন্ধুদের আড্ডাসহ যে কোন আলোচনায়ই এখন স্থান করে নিচ্ছে ডেঙ্গু। এদিকে, মুসলমানদের ধর্মীয় এই উৎসবের অন্যতম বিষয় ত্যাগের মহিমায় কোরবানি দেয়া। স্থায়ীসহ মোট ২৪টি হাট বসছে রাজধানীতে। ক্রেতা-বিক্রেতার গণজমায়েত হবে হাটে। সেই সঙ্গে হাটকেন্দ্রিক নানা অপরিচ্ছন্নতার কারণে হাটে রোগের বিস্তার লাভ করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও একাধিক ডাক্তার জানান, হাট এলাকায় ডেঙ্গু বা এডিস মশা উৎপন্ন হওয়ার আশঙ্কা কম তবে আশপাশের এলাকা থেকে খোলা জায়গায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের অবস্থানের কারণে মশার কামড় দেয়াটা স্বাভাবিক। আর সে কারণে বাড়তে পারে রোগীর সংখ্যাও। জানা গেছে, রাজধানীর যেসব স্থানে হাট বসবে সে সব এলাকায় রাতদিন ২৪ ঘণ্টা সমানতালে পশু বিক্রি হয়। ফলে বর্জ্য পরিষ্কার তেমনভাবে হয় না। আর বিভিন্ন প্রান্তের বেপারিরা এসে মশারি বা কয়েল জ্বালিয়েও অবস্থান করতে পারেন না। অনেক সময় খোলা অবস্থায় তাঁবুর নিচে ঘুমিয়ে যান বিক্রেতারা। দুজন ঘুমালে দুজন জেগে থাকেন। সবাই একই সময় ঘুমানও না। খোলা জায়গায় থাকার কারণে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকছে। সেই সঙ্গে যারা কিনতে যাবেন তারাও এই আশঙ্কার বাইরে থাকছেন না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, নোংরা জায়গা থেকেও মশার কারণে দ্রুত রোগ বিস্তার করে। হাট এলাকা নোংরা থাকবে সব সময়। কেননা মানুষের ভিড়, আগত পশুর ভিড়ে হাট সব সময় ইচ্ছা থাকলেও পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ওষুধ দিলে হয়ত রোগীর সংখ্যা বাড়বে না। যদি অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটে যায় তখন কি সিটি কর্পোরেশন দ্বায় এড়াতে পারবে? তাই এখনই যথাযথ ভূমিকা রাখার কথাও বলেন তিনি। এদিকে, সারাদেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ। যার মধ্যে কোরবানিযোগ্য গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৮২ হাজার এবং ছাগল-ভেড়া ৭২ লাখ। এছাড়াও ৬ হাজার ৫৬৩ অন্যান্য পশু রয়েছে। ঈদ-উল-আজহায় ১ কোটি ১০ লাখ পশুর কোরবানি হতে পারে বলে ধারণা করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গত বছর কোরবানি হয়েছিল ১ কোটি ৫ লাখের মতো। আর সারাদেশের খামারিরা রাজধানীর হাটগুলোতে পশু বিক্রির চিন্তা করে থাকে। অনেক প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও রাজধানীর হাটে আসে পশু। সে হিসেবে রাজধানীর ২৪টি হাটে কয়েক লাখ পশু বিক্রি হওয়ার কথা রয়েছে। পশু, পশুবাহী ট্রাক, পশু খাদ্য, পশুর বর্জ্য সব মিলে হাট এলাকা হতে পারে ময়লার এক ভাগাড়। যা আশপাশ এলাকায় এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য সহায়ক পরিবেশ হতে পারে। কেননা, অপরিচ্ছন্ন ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার লার্ভা, এডিস মশা বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী পরিবেশ। তাই এসব হাটকেন্দ্রিক এডিস মশার বংশবিস্তার বাড়লে রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে কাজ করছেন তারা। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি তবে অন্যান্য কর্মকর্তা জানান, তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। প্রয়োজনে হাট চলাকালে ফগিং মেশিনে স্প্রে করা হবে। আর দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ শরীফ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা পুরো ঢাকা নিয়েই তো কাজ করছি। আর হাটগুলো তো এর মধ্যেই। আর আমাদের বর্জ্য বিভাগও কাজ করছে। আশা করছি এটি নিয়ে কোন সমস্যা হবে না। দক্ষিণ সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মোঃ জাহিদ হোসেন বলেন, প্রতিবছরের মতো আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি। সে মোতাবেক অনেক এগিয়ে গেছি। এবার বর্ষা মৌসুম হাটের বিশেষ করে তিনদিন আগে থেকে যাতে কোন কাদা না হয় সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে বিক্রি করতে এবং কিনতে পারেন সেজন্য হাট পরিচ্ছন্ন রাখব। আর আমাদের মনিটরিং সেল থাকবে, যে কেউ তার সমস্যা জানালে আমরা পদক্ষেপ নেব। মানুষের আতঙ্ক নিয়ে বলেন, এডিস মশা হয় স্বচ্ছ পানিতে। এখানে এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। তবু আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ যেন ওষুধ ছিটায় সেটির অনুরোধ আমরা রাখব। রাজধানীর ফার্মগেটের বাসিন্দা আমানুর রহমান এসব আতঙ্ক আর ঝামেলা এড়াতে অনলাইনে পশু কিনেছেন। কিন্তু তাঁর প্রতিবেশী সোরহাব হোসেন হাটে গরু না দেখে কিনবেন না। তবে তিনি ডেঙ্গুর বিষয় নিয়ে আতঙ্কিতও বটে। চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে কোরবানির প্রসঙ্গে বার বারই বলে যাচ্ছিলেন, কি যে হবে এবার হাটে গিয়ে। হাটে তো আর বাসার মতো পরিবেশ নেই। এবার ডেঙ্গু বুঝি হবেই! অন্য বাসিন্দাও সায় দেন কথায়। হাট এলাকায় অপরিচ্ছন্নতা আর পশুর শরীরেই অনেক মশা থাকে। ফলে ডেঙ্গু হলেও হতে পারে বলে অনেকেই মত দেন। মানুষের আতঙ্কের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ কামাল উদ্দিনের মতে, আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। মানুষ একটা কারণে আতঙ্কিত হয় না। এর পেছনে নানা কারণ থাকে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। অন্য অসুখের ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিয়ে ভাল হওয়া যায়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারাই যাচ্ছে। এ মারা যাওয়া তো আতঙ্কের কারণ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের নিরাপদ পশু হাটে উঠানোর দায়িত্ব। সেখানে কোন অসুস্থ পশু যাতে না ওঠে সেটি আমাদের বিভিন্ন কর্মকর্তা দেখবেন। এটা ঠিক এবার ডেঙ্গুর বিষয়টি আছে এখন থেকেই হাট এলাকায় মশার ওষুধ যেন দেয়া হয় সেটি হবে উত্তম পন্থা। এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, দুই সিটির অধীন যে হাটগুলো আছে হাট শুরুর আগ থেকে একদম শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন ওষুধ দেয়ার বিকল্প নেই। এত মানুষ আসবে আবার ক্রেতারা আছে যদি কোন কারণে এটি ছড়িয়ে যায় তাহলে আমাদের তৃণমূলের খামারিদের ডেঙ্গু নিয়ে গ্রামে ফিরতে হবে। এটি হতে পারে না। দুই সিটি কর্পোরেশনকে বিষয়টি নিয়ে এখনই কাজ করার কথা বলেন। এদিকে ইতোমধ্যেই রাজধানীর পশুর হাট প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। স্থায়ী হাট গাবতলীতে গরুও আসছে। অস্থায়ী হাটে গরু আসলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও উঠানো হয়নি। তবে এ সপ্তাহেই বসতে যাচ্ছে আনুষ্ঠানিক পশুর হাট। আগামী ১২ আগস্ট কোরবানির ঈদ অনুষ্ঠিত হবে আর রাজধানীতে ৮ আগস্ট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পশু উঠানোর কথা রয়েছে। তবে এর আগে থেকেই পশু আসা শুরু হবে বলে হাট ইজারাদাররা মনে করছেন। একাধিক হাটের ইজারাদার বলেন, কখনও বেপারিরা আগেই চলে আসেন তখন তো আমরা নাও করতে পারি না। অনেক এলাকায় বন্যা হয়েছে ফলে অনেকেই পশু রাখার জন্য হলেও আগে আসবেন বলে মনে করছেন। এদিকে রাজধানীর অস্থায়ী-স্থায়ী মিলে মোট ২৪টি হাটে থাকবে ২৪ ব্যাংকের জাল নোট শনাক্তের বুথ। নিরাপত্তায় হাটে হাটে থাকছে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার। এছাড়াও ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্পও থাকছে হাটে। গত কয়েকদিন রাজধানীর একাধিক হাটে প্রস্তুতির দৃশ্য দেখা গেছে। ইতোমধ্যেই রাজধানীর অধিকাংশ হাট প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজধানীর উত্তর সিটির অধীন তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠ প্রস্তুত। হাটের পরিচালক ফারুক আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, হাট প্রস্তুত করা হয়েছে। অনেক কাজ থাকে হাটের। তবে বেপারিরা আগেই আসতে পারেন। মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী সড়কসংলগ্ন (বছিলা) পুলিশ লাইনের খালি জায়গা, উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সেতুর পশ্চিমের ফাঁকা জায়গা, মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা, ভাটারা সাঈদ নগরে কাজও শেষের পথে। এছাড়া ডিএসসিসির উত্তর শাহজাহানপুরের খিলগাঁও রেলগেট-মৈত্রী সংঘ মাঠ, লালবাগ রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ, শ্যামপুর বালুর মাঠ, মেরাদিয়া বাজার, বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গার (আফতাবনগর) অস্থায়ী হাটের ইজারাদারদের প্রস্তুতিও মোটামুটি শেষ পর্যায়ে। এখন অপেক্ষা পশুর। এ বছর মিরপুরের গাবতলী স্থায়ী গবাদি পশুর হাটসহ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) মোট ১০ স্থানে কোরবানির পশু বেচাকেনা হবে। একটি বেড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) কোরবানির পশুর হাট বসবে মোট ১৪ স্থানে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে সব মিলে রাজধানীতে মোট ২৪ হাটে এবার কোরবানির পশু বেচাকেনা হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানায়, সারাদেশে মোট ২ হাজার ৩৬২ কোরবানির পশুরহাটে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রায় বারো শ’ ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। হাটে ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিমের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিম ও বিশেষজ্ঞ টিম থাকবে।
×